জুমবাংলা ডেস্ক : সকাল থেকে শুরু হওয়া মাঝারি বর্ষণ থেমে নেই। কখনো মুষলধারে, কখনো থেমে থেমে বৃষ্টি চলছে। টানা বৃষ্টিপাত ও জোয়ারের কারণে চট্টগ্রাম নগরীর নিম্নাঞ্চলের সড়ক ও অলিগলিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন চট্টগ্রাম নগরবাসী। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালও। এতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা।
রোববার (৬ জুন) ভোর থেকেই চট্টগ্রামে বৃষ্টি শুরু হয়ে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অব্যাহত আছে। গত ২৪ ঘণ্টায় (বিকাল ৩ টা পর্যন্ত) ৭৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৭৫ দশমিক ০৪ মিলিমিটার। আর ভোর ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২ দশমিক ০৪ মিলিমিটার।
চট্টগ্রাম পতেঙ্গা অফিসের আবহাওয়াবিদ ও পূর্বাভাস কর্মকর্তা ড. মু. শহিদুল ইসলাম বলেন, মূলত সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতেই শহর তলিয়ে গেছে। মৌসুমী বায়ূ বাংলাদেশে ঢুকে গেছে। আর এ প্রভাবেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আজ (রোববার) ও আগামীকাল (সোমবার) দুইদিন এ ভারী বর্ষণ চলবে। তবে সমুদ্র ও নদী বন্দরগুলোর জন্য কোন সতর্ক সংকেত নেই।
সরেজমিন দেখা যায়, নগরীর অক্সিজেন, হামজারবাগ, মুরাদপুর, আতুরার ডিপো, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, কাতালগঞ্জ, নাসিরাবাদ, ষোলশহর, চকবাজার, পাঁচলাইশ, ডিসি রোড, খাজা রোড, চান্দগাঁও, মোহরা, বাকলিয়া, চাক্তাই, কোরবানিগঞ্জ, মাস্টারপুল, বৌ বাজার, মিয়াখান নগর, রাজাখালী, দেওয়ানবাজার, আগ্রাবাদ, সিডিএ, হালিশহর, পাহাড়তলী, সরাইপাড়া, সাগরিকা, কাঁচারাস্তার মাথা ও পতেঙ্গার নিম্নাঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বাসা-বাড়িতে কোমর সমান পানি। পানিবন্দি থাকায় এসব এলাকায় বন্ধ হয়ে গেছে রান্নাবান্নাসহ গৃহস্থালীর সব কাজ। পানি ঢুকে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি অফিসেও। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় বন্ধ রয়েছে বিকিকিনি। এছাড়া টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল।
নগরীর হালিশহরের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, পিসি রোডের সরাইপাড়া এলাকায় বৃষ্টিতে পানিতে জমে যায়। এমনিতে রাস্তার অস্তিত্ব নেই। পানি মাড়িয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলছে গাড়ি। জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ চললেও কবে এই দুর্ভোগ নিরসন হবে জানি না।
আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা কাদের জানান, ভারী বর্ষণে বাসার নিচে হাঁটুপানি হওয়ায় সকালে থেকে বের হতে পারেননি। হালিশহর ও রাহাত্তরপুল এলাকার দোকানদাররা জানান, সকালে দোকান খুলতে এসে দেখেন দোকানের ভেতর পানি ঢুকে পড়েছে। যার কারণে তারা দোকান খুলতে পারেননি। দোকানের ভেতর হাঁটু সমান পানি জমে যায়।
জলাবদ্ধতায় ডুবে থাকা অভ্যাস হয়ে গেছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে নয়াবাজার এলাকার বাসিন্দা জীবন আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের তো এসব অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন ক্ষোভ বা আক্ষেপ প্রকাশ করেও কোনো লাভ নেই। একটা শহর এমন হয় নাকি? এর চেয়ে গ্রাম অনেক ভালো। শুধু চাকরির জন্য এখানে পড়ে আছি।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিবছর জোয়ারের পানির উচ্চতা বাড়ছে। ভারী বৃষ্টি ছাড়াই খাতুনগঞ্জের নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। চাক্তাইয়ের চালপট্টি, শুঁটকিপট্টি, মকবুল সওদাগর রোড এবং আছাদগঞ্জ ও তার আশপাশের নিম্নাঞ্চল জোয়ারে হাঁটু পানিতে ডুবে যায়। এ সময় বেচাকেনা বন্ধ করে ব্যবসায়ীদের মালামাল রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়।
শাহ আমানত এন্টারপ্রাইজের মালিক আব্দুর রহিম বলেন, জোয়ারের সময় পানি আটকে দিতে চাক্তাই খালের মুখে একটি স্লুইস গেট বসানোর কাজ দুই বছর আগে শুরু করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। কিন্তু সে কাজ এখনো শেষ হয়নি। খালের মুখে বাঁধ দিয়ে কাজ চলছে। ফলে জোয়ারের পানি ঢুকলেও ভাটার সময়ে দ্রুত পানি সরে যেতে না পারায় জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। এ অবস্থায় ভারী বর্ষণ হলে পুরো চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও আছাদগঞ্জ তলিয়ে যায়।
নগরীর ফ্লাইওভারগুলোতে পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। পানি উপচে ফ্লাইওভার বেয়ে নিচে পড়ছে। ফ্লাইওভার দিয়ে যাওয়া গাড়িগুলোতে পানি ঢুকে রাস্তার মাঝে বিকল হয়ে আছে অনেক যানবাহন।
এদিকে সকাল থেকে টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল । ভেতরের করিডোরও পানিতে থৈ থৈ । জলাবদ্ধতার কারণে চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চলে থাকা এই হাসপাতালে চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩০০ রোগী ভর্তির পাশাপাশি আউটডোর এবং ইনডোরে চিকিৎসা নিতে আসেন অন্তত দেড় হাজার রোগী। এর মধ্যে প্রসূতি মা এবং নবজাতকের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। গত এক যুগের বেশি সময় ধরে এই হাসপাতালে জোয়ারের পানি ঢুকছে। কয়েক বছর আগে নিচতলা ৩ ফুট উঁচু করা হয়। কিন্তু পানি প্রবেশ বন্ধ করা যায়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের রিসেপশনে প্রায় হাঁটু পরিমাণ পানি। এতে রোগীর স্বজনরা খুব বেকায়দায় পড়েছেন। দুর্ভোগের শেষ নেই। রোগীদের কোলে করে আনা নেওয়া করতে হচ্ছে ।
আগ্রাবাদ মা ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. নুরুল হক বলেন, হাসপাতালের নিচে এক ফুটের মতো পানি জমেছে । আমরা আউটডোরের অর্ধেক অন্য বিল্ডিংয়ে শিফট করেছি । আমাদের সেবা অব্যাহত রেখেছি।
এদিকে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় সকাল থেকেই নগরীর ১৮টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিচ্ছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবারকে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান। ধসের আশংকায় নগরীর আকবর শাহ, শাপলা আবাসিক এলাকা, বিশ্বকলোনি, টাইগার পাস, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, বাটালি হিল, বায়েজিদসহ বিভিন্ন পাহাড়ের নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিংও করা হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান বলেন, সকাল থেকে চট্টগ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে শতাধিক পরিবারকে সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া স্থান্তর করা হয়েছে। সেখানে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চট্টগ্রামে মোট ৩০ টি আশ্রয়কেন্দ্রে তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে নগরীর ১৯টি ও জেলার মধ্যে ১১টি।
জুন মাসের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হবে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বিস্তার লাভ করার অনুকূল পরিবেশ থাকতে পারে। চট্টগ্রামে বিভাগে ৭৮৯ মিলিমিটার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হিসেবে ধরা হয়েছে। এই মাসে বঙ্গোপসাগরে দুটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি নিম্নচাপ অথবা গভীর নিম্নচাপে পরিণত হবে। এছাড়া উত্তর মধ্যাঞ্চলে দুই থেকে তিনদিন মাঝারি অথবা তীব্র বজ্রঝড় ও অন্যান্য জায়গায় তিন থেকে চারদিন হালকা অথবা মাঝারি বজ্রঝড় হতে পারে। সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।