জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের জগতে সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ভারতীয় এই জ্যোতিঃপদার্থবিদ নক্ষত্রের বিবর্তন ও জীবনচক্রবিষয়ক গবেষণার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর সবচেয়ে পরিচিত তাঁর আবিষ্কৃত ‘চন্দ্রশেখর লিমিট’ বা ‘চন্দ্রশেখর সীমা’র জন্য। চন্দ্রশেখর সীমা হলো সূর্যের ভরের ১.৪ গুণ। এই সীমার চেয়ে বেশি ভরের তারার ভবিষ্যৎ কী হবে, এ প্রশ্নের উত্তর ১৯৩০ সালের আগে বিজ্ঞানীরা জানতেন না। জানতেন না, নক্ষত্রের মৃত্যুর পর কী হয়।
১৯২৯ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন চন্দ্রশেখর। তাঁর সেই গবেষণাই পরে নক্ষত্রের ভরের সীমা বা চন্দ্রশেখর সীমা নির্ধারণের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। ‘দ্য ম্যাক্সিমাম মাস অব আইডিয়াল হোয়াইট ডোয়ার্ফ’ নামের প্রবন্ধটি লেখেন ভারত থেকে ইংল্যান্ড যাওয়ার পথে জাহাজে। চন্দ্রশেখর বলেন, এ ধরনের নক্ষত্রগুলো নিউট্রন তারা বা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়।
এ নিয়ে ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ আর্থার স্ট্যানলি এডিংটনের সঙ্গে চন্দ্রশেখরের মতবিরোধ শুরু হয়। আর্থার এডিংটন তাঁর বিখ্যাত এডিংটন তত্ত্বের জন্য পরিচিত ছিলেন। সে কালের প্রভাবশালী বিজ্ঞানী ছিলেন, আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ সংগ্রহ করেন তিনি। ১৯৩৫ সালে চন্দ্রশেখরের প্রস্তাবিত চন্দ্রশেখর সীমাকে প্রকাশ্যে উপহাস করেন। এতে চন্দ্রশেখর বড় ধাক্কা খান।
যদিও চন্দ্রশেখর এডিংটনকে সম্মান করতেন, তবু তিনি নিজ গবেষণার স্বার্থে এডিংটনের বিরোধিতা করতে বাধ্য হন। তাঁর গবেষণা স্বীকৃতি না পাওয়ায় ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। বাধ্য হয়ে তাঁকে ১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি যোগ দেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পরিশেষে চন্দ্রশেখরই সঠিক প্রমাণিত হন। তাঁর এ আবিষ্কার মহাকাশবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করা হয়। ১৯৮৩ সালে তাঁকে মার্কিন পদার্থবিদ উইলিয়াম আলফ্রেড ফাউলারের সঙ্গে যুগ্মভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
সুব্রাহ্মনিয়ানের চাচা চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন। সি. ভি. রমন নামে তিনি বিশ্বে পরিচিত। রমন ইফেক্টের জন্য ১৯৩০ সালে ভেঙ্কট রমন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান। সেটাই ছিল বিজ্ঞানে এশিয়ার প্রথম নোবেল জয়। মহাকাশের কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা রহস্যময় আলোর সংকেত ও বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করতে বিজ্ঞানীরা মহাকাশে স্থাপন করেছেন ‘অবজারভেটরি’ বা মানমন্দির।
বাংলায় এগুলোকে বলা হয় নভোমানমন্দির। মহাকাশের বিভিন্ন ঘটনা, যেমন নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু বা বিস্ফোরণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে এসব মানমন্দির। ‘চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি’ বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী নভোমানমন্দিরগুলোর একটি। পৃথিবী থেকে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার কিলোমিটার দূরে থেকে মহাকাশীয় ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করে এ মানমন্দির। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ১৯৯৮ সালের ২১ ডিসেম্বর এটার নামকরণ করে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর নামে।
শিক্ষার্থীদের কাছে চন্দ্রশেখর ছিলেন এক অনুপ্রেরণার নাম। ১৯৩০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ বছর তিনি শিক্ষার্থীদের গবেষণা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি একবার জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের একটি কোর্স নিয়েছিলেন। দুঃখজনকভাবে চন্দ্রশেখরের সেই কোর্সে নিবন্ধন করে মাত্র দুজন ছাত্র। দুজনেই চৈনিক—ইয়াং ঝেনিং এবং ঝাং-দাও লি। পরে তাঁরা দুজনেই নোবেল পুরস্কার পান। ছাত্রদের নোবেল পাওয়ার প্রায় ২৬ বছর পর নোবেল পান চন্দ্রশেখর।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।