চরফ্যাশনের দক্ষিণ উপকূলে ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র ধেয়ে আসার খবরে উপকূলজুড়ে চরম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে প্রবল বাতাস ও জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাসে সাগরপাড়ের মানুষের মধ্যে এক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হয় এবং সাগরের উত্তাল ঢেউ উপকূলীয় এলাকাকে ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
ঘূর্ণিঝড় শক্তি: উপকূলীয় জনপদের বর্তমান অবস্থা
ঘূর্ণিঝড় শক্তি চরফ্যাশনের দক্ষিণ অংশে ভয়ংকর হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে নদী-সাগর উত্তাল হয়ে উঠার ফলে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক দ্বীপাঞ্চল। এর ফলে মানুষের সরে আসার সুযোগ নেই বললেই চলে। চরফ্যাশনের ঢালচর, কুকরী-মুকরী, মুজিবনগরসহ বিভিন্ন এলাকা ইতোমধ্যেই অস্বাভাবিক জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে।
Table of Contents
ঢালচরে যেখানে প্রায় ১৫ হাজার মানুষের বাস, সেখানে মাত্র একটি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে যা সর্বোচ্চ ৫০০ জনকে ধারণ করতে সক্ষম। অপরদিকে কুকরী-মুকরীতে ১৭ হাজার মানুষের জন্য মাত্র ৮টি স্কুল কাম আশ্রয়কেন্দ্র, আর মুজিবনগরে ১৮ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে আছে মাত্র ৫টি স্কুল। এসব আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণক্ষমতা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সম্পূর্ণ অপর্যাপ্ত।
প্রশাসনের প্রস্তুতি ও চ্যালেঞ্জ
চরফ্যাশন উপজেলা প্রশাসন ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র আগমন ঠেকাতে আগাম প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভার আয়োজন করে। সভায় সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাসনা শারমিন মিথি। সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, উপজেলার ২৬৫টি স্কুলকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে এবং শুকনো খাবার মজুদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তুতি হিসেবে ঘূর্ণিঝড় প্রস্ততি কর্মসূচির আওতায় ১৬৫টি ইউনিটে ২৪০০ স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তারা বৃহস্পতিবার বিকাল থেকেই জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার বার্তা প্রচার করছে। তবে এসব প্রচেষ্টা বাস্তব চাহিদার তুলনায় অনেকাংশেই অপ্রতুল, কারণ অধিকাংশ এলাকা এখনও নৌযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে।
স্থানীয় জেলে নুরে আলম জানান, নিকটবর্তী সাগরে থাকা সব জেলেরা নিরাপদে ফিরেছেন, তবে দূরের সাগরে যারা অবস্থান করছেন, তাদের ফেরার বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের আতঙ্ককে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের পুনরাবৃত্তি: উপকূলীয় অবকাঠামোর সংকট
ঘূর্ণিঝড় শক্তি শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দীর্ঘদিনের অবকাঠামোগত দুর্বলতাকেও সামনে এনে দিয়েছে। চরফ্যাশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যেখানে হাজার হাজার মানুষ বসবাস করে, সেখানে পর্যাপ্ত ও নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রের অভাব একটি ভয়াবহ সমস্যা।
ইতোপূর্বেও ঘূর্ণিঝড় আইলা, সিডর কিংবা বুলবুল-এর সময় দেখা গেছে যে, আশ্রয়কেন্দ্রের স্বল্পতার কারণে বহু মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থেকে যায়। সরকারি উদ্যোগে স্কুলগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হলেও তা প্রকৃত বিপদের সময় অনেকাংশেই অকার্যকর হয়ে পড়ে, বিশেষ করে যখন বিদ্যুৎ, পানীয় জল ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা যথাযথ থাকে না।
তীব্র জোয়ার ও প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার রাতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩-৪ ফুট উচ্চতার জোয়ার ঢেউয়ে ঢালচর ও কুকরী-মুকরীর উপকূল প্লাবিত হয়। এই জোয়ার রাতের দিকে আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। অনেকেই নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিচ্ছেন, যদিও সেই স্থানের সংখ্যাও সীমিত।
সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদগুলো এখনো মাঠপর্যায়ে পর্যাপ্ত জনবল এবং ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোর জন্য লড়াই করছে। এমন বাস্তবতায় জনগণের মধ্যে যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, তা মোটেও অমূলক নয়।
তথ্য সচেতনতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার
এই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে তথ্য সচেতনতা ও প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য জানতে সরকারিভাবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট এবং ReliefWeb থেকে নির্ভরযোগ্য আপডেট নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, স্থানীয় প্রশাসনের প্রচার কার্যক্রমে ডিজিটাল মাইকিং, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মোবাইল বার্তা সেবার ব্যবহার লক্ষণীয়।
এই ধরণের পরিস্থিতিতে তথ্য সচেতনতা শুধু জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে না, বরং মানুষের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিবেশও তৈরি করে।
যা প্রয়োজন এখন: দীর্ঘমেয়াদি সমাধান
ঘূর্ণিঝড় শক্তি যে বার্তা দিয়ে গেল তা হলো, আমাদের উপকূলীয় এলাকার দুর্বলতা এবং প্রস্তুতির ঘাটতি। এখনই সময় স্থায়ী এবং টেকসই সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। প্রয়োজন – অধিক সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র, আধুনিক আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রযুক্তি, ও দুর্যোগকালীন দ্রুত রেসপন্স ব্যবস্থা।
পরিবেশ ও দুর্যোগ সংক্রান্ত আরও খবর পড়ুন এবং জাতীয় সংবাদ বিভাগে ভিজিট করুন আপনার এলাকার সর্বশেষ আপডেটের জন্য।
ঘূর্ণিঝড় শক্তি এখনো উপকূলীয় মানুষদের জন্য হুমকি হয়ে আছে। নিরাপদে থাকুন, প্রস্তুত থাকুন এবং স্থানীয় প্রশাসনের দিকনির্দেশনা মেনে চলুন।
FAQs: ঘূর্ণিঝড় শক্তি নিয়ে জানুন
ঘূর্ণিঝড় শক্তি কোথায় আঘাত হানতে পারে?
বর্তমানে এটি চরফ্যাশনের দক্ষিণ উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে, তবে এটি দেশের অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলেও প্রভাব ফেলতে পারে।
কোন কোন এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা সবচেয়ে কম?
ঢালচর ও কুকরী-মুকরী এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা কম এবং মানুষের তুলনায় তা একেবারেই অপর্যাপ্ত।
স্থানীয় প্রশাসন কী প্রস্তুতি নিয়েছে?
২৬৫টি স্কুলকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, ২৪০০ স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং শুকনো খাবারের মজুদ নিশ্চিত করা হয়েছে।
জেলেরা কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন?
প্রবল জোয়ার এবং সাগরের উত্তাল অবস্থায় জেলেরা মাছধরা বন্ধ করে নিরাপদ স্থানে ফিরছেন। তবে অনেকেই এখনও সমুদ্রে অবস্থান করছেন।
জনগণের জন্য প্রশাসনের বার্তা কী?
জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার অনুরোধ করা হয়েছে এবং সকলকে স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা মানার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।