কিছুদিন আগে পর্যন্ত আন্তঃগ্রহ ভ্রমণ নিয়ে গবেষণাকারী বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত ভাবতেন, চাঁদের পরিক্রমা ব্যাপারটা সুদূর ভবিষ্যতের কথা। এরকম একটা যাত্রার কথা কল্পনার সাহায্যেই তো বর্ণনা করেছি। যাহোক, হালের বছরগুলোতে সোভিয়েত বিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়রিং এত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যে, বলা চলে আরও অনেক আগে মানুষ পৌঁছবে চাঁদে।
১৯৫৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) থেকে একটি মহাশূন্যযান উৎক্ষেপ করা হয় চাঁদের দিকে। ১৪ই সেপ্টেম্বর মস্কোর সময় রাত ১২:০২:২৪টায় এটি পৌঁছল চাঁদে। ইতিহাসে এই প্রথম একটি জ্যোতিষ্ক থেকে অন্য জ্যোতিষ্কে যাত্রা সম্পন্ন হলো বাস্তবে, জুল ভার্ন এবং এচ. জি. ওয়েলসের কল্পনাপ্রসূত উপন্যাসে নয়।
বিশ্বের বিজ্ঞানীরা নতুন সোভিয়েত কীর্তিতে বিচলিত হলেন। জড্রেল ব্যাঙ্কে ব্রিটেনের রেডিও-টেলিস্কোপ স্টেশনের ডিরেক্টর অধ্যাপক লভেল বললেন, চাঁদে এই রকেট যাত্রা ‘সোভিয়েত বিজ্ঞান ও টেকনলজির অগ্রগতির চমৎকার এক নিদর্শন বটে…’। আড়াই লাখ মাইল ধরে এ ধরনের জিনিসের পরিচালনা এমন একটা ব্যাপার যে মানুষের মন স্তম্ভিত হয়।
আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী সংঘের সদস্য, ফরাসী অধ্যাপক আনানফ, চন্দ্র গবেষণা যাঁর কাজ, তিনি বললেন, ‘রুশদের সম্ভাব্য শক্তির কথা যতটা জানা আছে তাতে মনে হয় তারা আরও বেশি কিছু করতে পারে। রকেটকে আরও বিস্ময়কর করার ইচ্ছে থাকলে তাতে তারা মানুষ বসাতে পারে।’
পশ্চিম জার্মানির বখুম মানমন্দিরের ডিরেক্টর হাইন্ৎস্ কামিনস্কির মতে, ‘১০ কিলোমিটার দূরে মাছির চোখ ভেদকারী লক্ষ্যবেদ্ধার সঙ্গে তুলনা করা যায় রুশদের…’
তুলনাটা বেশ জুতসই, অত্যুক্তি নয় মোটেই। নিজে পরখ করার জন্য এক টুকরো কাগজ কেটে দশ সেন্টিমিটার ব্যাসের একটা বৃত্ত বানিয়ে দেয়ালে টাঙাও, তারপর এগারো মিটার দূর থেকে দেখ। যে ছোপটা চোখে পড়বে, আয়তনে সেটা আকাশে দেখা চাঁদের মতো।
৪৩ ঘণ্টায় ৩ লাখ ৮০ হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করে এ লক্ষ্যভেদ করতে হয় মহাকাশযানকে। আর টিপটা একটু এগিয়ে করতে হয়, কেননা রকেট উৎক্ষেপের মুহূর্তে স্বয়ং চলমান চাঁদ ছিল লক্ষ্যভেদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা থেকে দেড় লাখ কিলোমিটার দূরে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নির্ভুল গণনা এবং রকেট পরিচালক যন্ত্রপাতিগুলোর সঠিকতা সত্যিই আশ্চর্য। নির্দিষ্ট লক্ষ্য এলাকায় চাঁদকে আঘাত করে রকেটটি, পৌঁছায় প্রায় দুই মিনিট আগে। লক্ষ্যবেদ্ধার মতোই টিপ বটে।
পথ থেকে চুলমাত্র সরে গেলে রকেটটি হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে গিয়ে কখনো পৌঁছত না চাঁদে। রকেটের বেগও অত্যন্ত নিখুঁতভাবে রাখতে হয়, সেকেন্ডে কয়েক মিটার বেগ বাড়লেই রকেট গিয়ে পড়ত সৌরজগতের বিরাট মহাশূন্যে, পরিণত হতো সূর্যের আর একটি গ্রহে। ১৯৫৯ সালের ২ জানুয়ারিতে উৎক্ষিপ্ত প্রথম সোভিয়েত কৃত্তিম গ্রহের মতো (এ বিষয়ে পরে আরও বলব)। যদি একটু আস্তে চলত, তাহলে চাঁদ পর্যন্ত যেত না। পৃথিবীতে ফিরে আসত আমেরিকার প্রথম ও দ্বিতীয় পথদ্রষ্টার মতো।
জ্বালানি পুড়ে যাওয়ার পর বহুপর্যায়ী রকেটটির শেষ পর্যায়টির ওজন ছিল ১ হাজার ৫১১ কিলোগ্রাম; ৩৯০.২ কিলোগ্রাম ওজনের একটি রকেট কক্ষপথে প্রবেশ করলে বিচ্ছিন্ন হয় তা থেকে। চাঁদে পৌঁছনোর মুহূর্ত পর্যন্ত যন্ত্রপাতিতে পাওয়া নানা মাপজোক পৃথিবীতে আসে রেডিওযোগে।
রকেটটি চাঁদে পৌঁছায় স্বচ্ছতা-সাগর ও স্থির সাগরের মাঝখানের একটা জায়গায়। চাঁদে ধাক্কা লাগার সময়ে ধুলোর মেঘ কয়েকটি পর্যবেক্ষক দেখতে পান। রকেটে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতীয় চিহ্ন এবং ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন, সেপ্টেম্বর, ১৯৫৯’ এই কথাগুলো উৎকীর্ণ একটি ধাতু গোলক। মনে হয়, চাঁদে প্রথম অভিযাত্রীরা গোলকটির খোঁজ করবেন, মহান সোভিয়েত কীর্তির কথা উত্তরপুরুষদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য এটিকে রাখবেন স্মৃতিস্তম্ভের ওপর।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।