রাত জেগে তৈরি করা সিভি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রস্তুতি, নতুন জুতোর মধ্যে আটকে থাকা ঘাম—একটি চাকরির ইন্টারভিউ মানেই তো শ্বাসরুদ্ধকর এক যুদ্ধক্ষেত্র! কিন্তু জানেন কি, বাংলাদেশের ৭৩% চাকরিপ্রার্থী শুধুমাত্র ভুল কথার কারণে হারিয়ে ফেলেন স্বপ্নের চাকরি? ঢাকার এমআইএস ট্যালেন্ট একাডেমির ২০২৩ সালের গবেষণায় এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। ইন্টারভিউ বোর্ডে বসা অভিজ্ঞ কর্তৃপক্ষের সামনে অজান্তেই আমরা এমন কিছু বলে ফেলি যা আমাদের যোগ্যতার সবটুকুই ম্লান করে দেয়। আজই জেনে নিন কোন কথাগুলো আপনার মুখে বিষধর সাপের মতো ছোবল দিতে পারে—এবং কীভাবে এড়িয়ে চলবেন এই মারাত্মক ভুলগুলো।
চাকরির ইন্টারভিউতে কী বলবেন না: যে ১০টি বাক্য কেড়ে নিতে পারে আপনার চাকরি
১. “আমার প্রাক্তন বস ছিলেন একেবারে বোকা!”
কেন ক্ষতিকর:
ঢাকার এইচআর কনসালট্যান্ট ফারহানা ইসলামের মতে, “প্রাক্তন বসের সমালোচনা করলে ইন্টারভিউয়ার মনে করেন আপনি দলের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবেন না।” বাংলাদেশের কর্পোরেট সংস্কৃতিতে সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। এমনকি যদি আপনার পূর্ববর্তী কর্মক্ষেত্রে সমস্যা থেকেও থাকে, নেতিবাচক অভিব্যক্তি আপনার পেশাদারিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
কী বলবেন:
“আমার পূর্ববর্তী কর্মক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল, কিন্তু সেখান থেকে আমি টিমওয়ার্কের গুরুত্ব শিখেছি।”
উদাহরণ:
রিয়াদ (২৮), একজন মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ, ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, “আমার ম্যানেজার তো ক্লায়েন্টদেরকেই বোঝেন না!” পরবর্তীতে জানতে পেরেছিলেন, ঐ ম্যানেজার ছিলেন ইন্টারভিউয়ারের ব্যক্তিগত বন্ধু!
২. “এই পদে বেতন কত?”
কেন ক্ষতিকর:
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের ২০২৪ সালের গাইডলাইন স্পষ্ট করে—বেতন আলোচনা প্রথম ইন্টারভিউতে কখনোই আনবেন না। এটি আপনার আর্থিক লোভকে প্রাধান্য দেয় এবং সংস্থার প্রতি কমিটমেন্ট নিয়ে সন্দেহ তৈরি করে।
কখন নিয়ে আলোচনা করবেন:
শুধুমাত্র চাকরির প্রস্তাব পাওয়ার পর বা ফাইনাল রাউন্ডে। বলুন: “আমি এই পদটির জন্য উৎসাহিত, বেতন নিয়ে আমরা পরে কথা বলতে পারি।”
৩. “আমার কোনো দুর্বলতা নেই!”
কেন ক্ষতিকর:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের সমীক্ষায় ৮৯% ইন্টারভিউয়ার বলেছেন—যারা নিজের দুর্বলতা স্বীকার করে না, তারা আত্মবিশ্বাসের ভান করে। এটি অসততা ও আত্মসমালোচনার অভাব নির্দেশ করে।
কী বলবেন:
“আমি প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টে দক্ষ, তবে ডাটা অ্যানালিসিস টুলস শেখার জন্য আমি সম্প্রতি একটি কোর্স শুরু করেছি।”
টিপস: দুর্বলতা বলার সময় অবশ্যই সেটি সংশোধনের পদক্ষেপ উল্লেখ করুন।
৪. “এই প্রশ্নের উত্তর জানি না, কিন্তু…”
কেন ক্ষতিকর:
বেসরকারি ব্যাংকের এইচআর ম্যানেজার তাসনিম ফেরদৌসের ভাষ্য, “অজানা প্রশ্নের ভুল উত্তর দেওয়া সরাসরি অসততা। আমরা প্রায়ই ইচ্ছাকৃতভাবে কঠিন প্রশ্ন করি ক্যান্ডিডেটের সততা যাচাই করতে।
কী বলবেন:
“এই বিষয়টি আমার জ্ঞানের বাইরে, তবে আমি শিখতে আগ্রহী।” অথবা “এটি সম্পর্কে আমার ধারণা নেই, তবে আমি জানি যে…” বলে সম্পর্কিত কোনো তথ্য দিন।
৫. “আমার পারিবারিক সমস্যার কারণে…”
কেন ক্ষতিকর:
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, পরিবারিক সমস্যা কাজে প্রভাব ফেলতে পারে এমন কথা বললে নিয়োগকর্তা বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ঢাকার এডভোকেট শাহনাজ পারভীন সতর্ক করেন, “এটি আপনার প্রাইভেসি লঙ্ঘনের দরজা খুলে দেয়।”
কী বলবেন:
ব্যক্তিগত সমস্যা উল্লেখ না করে বলুন: “আমি কাজের প্রতি সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সময়ানুবর্তিতা আমার জন্য অগ্রাধিকার।”
৬. “আপনাদের প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানে আমি ইন্টারভিউ দিচ্ছি”
কেন ক্ষতিকর:
এটি আপনার আগ্রহকে বিভক্ত করে এবং লয়াল্টি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কর্পোরেট রিক্রুটার্সের ২০২৩ সালের রিপোর্টে দেখা গেছে, ৭৮% নিয়োগকর্তা এমন কথা শুনে ক্যান্ডিডেটকে রিজেক্ট করেন।
কী বলবেন:
“আমি শুধুমাত্র এই পদটির জন্যই আবেদন করেছি, কারণ সংস্থার ভ্যালু ও আমার ক্যারিয়ার গোলের সাথে এটি মেলে।”
৭. “এই কাজের জন্য আমি ওভারকোয়ালিফাইড”
কেন ক্ষতিকর:
একটি সমীক্ষায় (বিআইডিএস, ২০২২) দেখা গেছে, নিয়োগকর্তারা ভাবেন আপনি শীঘ্রই চাকরি ছেড়ে দেবেন বা নিম্নপদে কাজে মনোযোগ দেবেন না। বাংলাদেশের কর্মবাজারে অভিজ্ঞতার অতিরিক্ত প্রকাশও ঝুঁকিপূর্ণ।
কী বলবেন:
“আমার অভিজ্ঞতা এই পদে সংস্থাকে দ্রুত ফল পেতে সাহায্য করবে।”
৮. “আমি শুধু অভিজ্ঞতার জন্য এই চাকরি চাইছি”
কেন ক্ষতিকর:
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার কাউন্সেলর ড. ফাহমিদা হকের মতে, “এটি প্রমাণ করে আপনি দীর্ঘমেয়াদি নন। বাংলাদেশে এখন স্কিল ডেভেলপমেন্টের চেয়ে কমিটমেন্টকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।”
কী বলবেন:
“আমি এই সংস্থায় দীর্ঘস্থায়ী ক্যারিয়ার গড়তে চাই এবং আমার স্কিল দিয়ে অবদান রাখতে চাই।”
৯. “আমি জানি না কেন আপনারা আমাকে নেবেন”
কেন ক্ষতিকর:
এটি আত্মবিশ্বাসের মারাত্মক অভাব দেখায়। বাংলাদেশের ৯৫% সফল চাকরিপ্রার্থী তাদের ইন্টারভিউতে নিজেদের যোগ্যতা স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেন।
কী বলবেন:
“আমার XYZ দক্ষতা ও ABC অভিজ্ঞতা এই পদে সংস্থার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে, বিশেষ করে [কোম্পানির প্রজেক্টের নাম উল্লেখ করে]।”
১০. “আমার তো এই কাজ সম্পর্কে ধারণাই নেই!”
কেন ক্ষতিকর:
নিজের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে গবেষণা না করা চরম অবজ্ঞার পরিচয়। বাংলাদেশে টপ কোম্পানিগুলো রিক্রুটমেন্টের আগে তাদের ওয়েবসাইট ভিজিটের হিসেব রাখে!
কী করবেন:
ইন্টারভিউর আগে অবশ্যই:
- কোম্পানির ওয়েবসাইট ব্রাউজ করুন
- তাদের সাম্প্রতিক প্রজেক্ট সম্পর্কে জানুন
- লিংকডইনে এমপ্লয়িদের প্রোফাইল দেখুন
ইন্টারভিউ সফলতার ৫টি সোনালি নিয়ম: যা বলবেন এবং করবেন
১. গবেষণায় সময় দিন
কী করবেন:
কোম্পানির মিশন, ভ্যালু, সাম্প্রতিক অর্জন নোট করুন। বলুন: “আপনাদের গত বছরের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রজেক্টটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”
২. স্টোরি টেলিং টেকনিক
কী করবেন:
S.T.A.R মেথড অনুসরণ করুন:
- Situation (পরিস্থিতি)
- Task (কাজ)
- Action (করণীয়)
- Result (ফলাফল)
উদাহরণ: “যখন আমাদের টিম লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছিল না (S), আমি ডাটা অ্যানালিসিসের দায়িত্ব নিই (T), ক্রস-ফাংশনাল মিটিং ডাকি (A), ফলে কোয়ার্টারলি টার্গেট ৩০% বাড়ে (R)।”
৩. বডি ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ন্ত্রণ
কী করবেন:
- চোখে চোখ রেখে কথা বলুন
- হালকা হাসি বজায় রাখুন
- হাত দুটি টেবিলের ওপর রাখুন
৪. প্রশ্ন রাখুন ইন্টারভিউয়ারকে
জিজ্ঞাসা করুন:
- “এই পদে সফল হতে কোন স্কিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?”
- “সংস্থাটি এমপ্লয়িদের ক্যারিয়ার গ্রোথে কী সহায়তা করে?”
- “আপনার সংস্থায় কাজ করা সবচেয়ে আনন্দের কী?”
৫. ফলো-আপ মেইল
কী লিখবেন:
ইন্টারভিউর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেইলে লিখুন: “আলোচনা আমার জন্য খুবই শিক্ষণীয় ছিল। বিশেষ করে [ইন্টারভিউতে আলোচিত কোনো পয়েন্ট উল্লেখ করে] নিয়ে আমি আরও জানতে আগ্রহী।”
বিশেষজ্ঞ মতামত: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইন্টারভিউ মনোবিজ্ঞান
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অর্গানাইজেশনাল সাইকোলজি বিভাগের প্রধান ড. মো. রাকিবুল হাসানের মতে, “বাংলাদেশের ইন্টারভিউয়ে সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন:
- বয়সে বড় ইন্টারভিউয়ারকে ‘আপনি’ বলুন
- ধর্মীয় বা রাজনৈতিক মন্তব্য এড়িয়ে চলুন
- অতিরিক্ত আত্মপ্রচার বাংলাদেশে ‘অহংকার’ বলে ধরা হয়”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের কর্পোরেট জব ইন্টারভিউতে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় সাবলীলতা এখন বাধ্যতামূলক। তবে জেলা পর্যায়ে সরকারি চাকরির ইন্টারভিউয়ে মাতৃভাষায় দক্ষতাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।
সরকারি রিসোর্স:
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (BPSC) ইন্টারভিউ গাইডলাইন অনুসারে, “ক্যান্ডিডেটের জ্ঞানের গভীরতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং নৈতিক মূল্যবোধ মূল্যায়ন করা হয়।” বিস্তারিত জানুন এখানে
চাকরির ইন্টারভিউতে কী বলবেন না—এই সচেতনতাই পারে আপনার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিতে! মনে রাখবেন, প্রতিটি ইন্টারভিউ শুধু একটি পদ নয়, আপনার পেশাদার ব্যক্তিত্বের প্রদর্শনী। ভুল কথার ফাঁদে পা না দিয়ে, আত্মবিশ্বাস ও প্রস্তুতির আলোয় ঝলসে উঠুন। আজই এই গাইডলাইনগুলো অনুশীলন শুরু করুন, এবং পরবর্তী ইন্টারভিউয়ে হাঁটুন জয়ের পথে!
জেনে রাখুন
ইন্টারভিউতে বেতন নিয়ে আলোচনা করা কি একেবারেই উচিত নয়?
না, একেবারেই নয়। প্রথম রাউন্ডে বেতন নিয়ে আলোচনা করলে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে যদি ইন্টারভিউয়ার নিজেই这个话题 উত্থাপন করেন, তাহলে গবেষণা করে রাখা মার্কেট রেট বলুন। চূড়ান্ত রাউন্ডে বেতন নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে, তবে তা নমনীয় ভাবেই উপস্থাপন করুন।
ইন্টারভিউতে নিজের দুর্বলতা বলার সেরা উপায় কী?
একটি সত্যিকারের দুর্বলতা বেছে নিন যা চাকরির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নয়, এবং সঙ্গে সঙ্গে বলুন আপনি সেটি উন্নত করার জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছেন। উদাহরণ: “আমার প্রেজেন্টেশন স্কিল আগে দুর্বল ছিল, তাই আমি টস্টমাস্টার্স ক্লাবে যোগ দিয়েছি।”
ইন্টারভিউ শেষে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করলে কি প্রভাব পড়ে?
হ্যাঁ, এটি আপনার আগ্রহ ও প্রস্তুতির অভাব প্রকাশ করে। অন্তত ২-৩টি প্রশ্ন প্রস্তুত রাখুন যা সংস্থার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, টিম কালচার বা ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পর্কিত। প্রশ্ন না করাকে প্রায়ই উদাসীনতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।
ভার্চুয়াল ইন্টারভিউয়েও কি একই নিয়ম প্রযোজ্য?
হ্যাঁ, তবে ভার্চুয়াল ইন্টারভিউয়ের জন্য অতিরিক্ত প্রস্তুতি নিন। ইন্টারনেট সংযোগ, ব্যাকগ্রাউন্ড, লাইটিং পরীক্ষা করে নিন। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথা বলুন এবং হেডফোন ব্যবহার করুন। বাংলাদেশে এখন ৬৮% কোম্পানি হাইব্রিড ইন্টারভিউ নিচ্ছে।
ইন্টারভিউতে খুব নার্ভাস হলে কী করব?
গভীর শ্বাস নিন, পানি পান করুন, এবং মনে রাখুন ইন্টারভিউয়াররাও একদিন আপনার অবস্থানে ছিলেন। প্রস্তুতির মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস বাড়ান। বাংলাদেশে ৯২% ইন্টারভিউয়ার বলেছেন, সামান্য নার্ভাসনেসকে তারা ইতিবাচকভাবেই দেখেন, কারণ এটি আগ্রহের লক্ষণ।
ইন্টারভিউ পরবর্তী ফলো-আপ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি পেশাদার ধন্যবাদ ইমেইল আপনার আগ্রহ ও শিষ্টাচার প্রকাশ করে। তবে বারবার ফোন করে জিজ্ঞাসা করা এড়িয়ে চলুন। বাংলাদেশের ৮০% এইচআর ম্যানেজার বলেছেন, ভালো ফলো-আপ মেইল চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।