শাহীন রহমান, পাবনা: চাটাইয়ের (বাঁশের) ওপর মোহর ঢেলে ভুষালি মালের মতো বিক্রি করা হতো বলে স্থানের নামটি হয়ে গিয়েছিল ‘চাটমোহর’। শুধু তাই নয়, সেকালে মোঘল-পাঠান-পর্তুগীজ-আফ্রিদিরাও সেই মোহরের টানে এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। এসেছিলেন ইরান থেকে ইসলাম প্রচারে পীর আউলিয়াগনও। ফলে পাবনা জেলার ইতিহাস বাতায়নে সবদিক থেকেই চাটমোহর নামটি স্থান দখল করে আছে।
আর এর অন্যতম কারণ হলো ‘চাটমোহর শাহী মসজিদ’। এই মসজিদের মাধ্যমে বাংলার মুসলিম স্থাপত্যে নতুন একটি অধ্যায় সংযোজন হয়েছিল। ৪৪২ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট ঐতিহ্যবাহি মসজিদটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে কালের স্বাক্ষী হয়ে। এটি চাটমোহর পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাবনার অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র চাটমোহর একদা ছিলো মোঘল-পাঠানদের অবাধ বিচরণ ভূমি। আর সে সময়ে ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে মাসুম খাঁ কাবলি নামের সম্রাট আকবরের পাঁচহাজারী এক সেনাপতি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা এখন ‘চাটমোহর শাহী মসজিদ’ নামে পরিচিত। কিন্তু বইপত্রে এখনো মসজিদটি মাসুম খাঁ কাবলির মসজিদ নামে উল্লেখ করা আছে।
মসজিদটির ভেতরে দৈর্ঘ্য ৩৪ হাত, প্রস্থ ১৫ হাত, উচ্চতা প্রায় ৩০ হাত। ক্ষুদ্র পাতলা নকশা খচিত লাল জাফরী ইটে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদের দেয়ালটি সাড়ে চার হাত প্রশস্থ। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির সামনে ইদারার গায়ে কলেমা তৈয়বা লিখিত একখন্ড কালো পাথর এখনো প্রথিত রয়েছে।
তিন গম্বুজ সমৃদ্ধ শাহী মসজিদে গিয়ে দেখা যায়, মসজিদটিতে তিনটি দরজা বিশিষ্ট প্রবেশপথ রয়েছে। মূল প্রবেশ পথটি ছাড়া অন্য প্রবেশপথ দু’টি একই ধরনের। মসজিদটিতে তিনটি প্রবেশপথের সঙ্গে মিল রেখে পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে মোট তিনটি মিহরাব।
কেন্দ্রীয় মিহরাব থেকে দুই পাশের মিহরাবে রয়েছে বড় সুরঙ্গের মতো অপূর্ব নিদর্শন। ভূমি-নকশালঙ্কারে স্থাপত্য। অনুমান করা যায়, সুলতানী-মুঘল স্থাপত্যের রীতিতে মসজিদটি নির্মিত। মিম্বারের পাশে কষ্টি পাথরের মত কালো রংঙের পাথরটি সৌন্দর্যের আরেকটি অংশ।
মসজিদটিতে এক খন্ড কৃষ্ণপ্রস্তরের এক পাশে পারশী ভাষায় নির্মাণের ইতিহাস এবং অপর পাশে ব্রক্ষ্মা, বিষ্ণু ও শিবের মূর্তি অংকিত ছিল। প্রস্তর খন্ডটি বর্তমানে রাজশাহী বরেন্দ্র মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
মসজিদটি প্রায় ধ্বংস হবার প্রাক্কালে ১৯০৪ সালে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর অধিগ্রহণ করে নেয়। মূল কাঠামো অবিকল রেখে অধিদপ্তর থেকে কয়েক দফা সংস্কার করা হয়েছে মসজিদটি। এখন মসজিদটি তার অতীত সৌন্দর্য্য অনেকটাই ফিরে পেয়েছে।
মাসুম খাঁ কাবলি সম্রাট আকবরের পাঁচ হাজার সৈন্যের অধিনায়ক ছিলেন। তার পূর্ব পুরুষ সুলতান হুসাইন শাহ্’র আমলে কাবুল থেকে এদেশে এসে চাটমোহর অঞ্চলে একটি জায়গীর লাভ করেন এবং এখানেই বসবাস শুরু করেন। এখানেই মাসুম খাঁ’র জন্ম হয়। তার পূর্বপুরুষরা কাবুলের খোরাশানের তুরাবতী বংশের কাকশাল গোত্রের সৈয়দ ছিলেন। তার চাচা মীর্জা আজিজ কাকশাল সম্রাটের উজির ছিলেন। মাসুম খাঁ মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সম্রাট আকবরের সৈন্যদলে যোগ দেন। সাহসীকতায় তিনি সহসাই পাঁচহাজারী মসনদদার পদে উন্নীত হন।
কিন্তু সেই মাসুম খাঁ কাবলি বাংলার বারভূঁইয়াদের বিদ্রোহকালে তাদের দলে যোগ দেন এবং আকবরের সেনাপতি ও গভর্ণর শাহবাজ খানের সাথে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরের (গাজীপুর) গহীন অরণ্যে আত্মগোপন করেন। সেখানেই ৪৪ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন।
বর্তমানে মসজিদটির পরিচালনা পরিষদের সভাপতির পদে আছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ মহল। আর পেশ ইমাম হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন হাফেজ কাজী আব্দুস সালাম মাসুদ এবং মুয়াজ্জিন হিসেবে রয়েছেন তরিকুল ইসলাম। পুরাকৃর্তি ও প্রত্মতত্ব অধিদপ্তরের পক্ষে সাইট পরিচালক হিসেবে আছেন শাহজাহান আলী। তিনি তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই শাহী মসজিদের দেখাশুনা করছেন।
শাহজাহান আলী বলেন, নথিপত্রে চাটমোহর শাহী মসজিদ মাসুম খাঁনের নামে পাওয়া গেলেও সুলতানী-মোঘল আমলের শাহী মসজিদ মনে করে সারাবছরে বহু মানুষ আসেন পাবনার চাটমোহরে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রত্মতত্ত্ববিদরা আসেন একসাড়িতে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ ও এর কারূকাজ দেখতে। সংস্কারের মাধ্যমে মুল কাঠামো ও সৌন্দর্য্য ধরে রাখার চেষ্টা চলছে।
মসজিদের ইমাম হাফেজ কাজী আব্দুস সালাম মাসুদ বলেন, দূর থেকে মসজিদটি বিশাল মনে হলেও, ভেতরে মাত্র দুই কাতার লোক নামাজে দাঁড়াতে পারেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও জুমার নামাজ আদায় হয় এই মসজিদে। এছাড়া মসজিদের বাইরে দু’টি ঈদের নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় প্রতিদিন অনেকেই আসেন দেখতে, ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন।
ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এমন একটি মসজিদের ইমাম হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেন তিনি।
ঢাকা থেকে কেউ মসজিদটি দেখতে আসতে চাইলে ঢাকা-ঈশ্বরদী রেলরুটের চাটমোহর স্টেশনে নেমে অটোরিকশা বা ভ্যানে চড়ে সহজে যেতে পারবেন। দূরত্ব মাত্র মাত্র ৪ কিলোমিটার। ঢাকার কমলাপুর থেকে সকালে আন্তঃনগর ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেসে চড়ে চাটমোহরে পৌঁছাবেন দুপুরে, সময় লাগবে মাত্র সাড়ে ৪ ঘণ্টা। চাটমোহরে ভালো মানের খাবার হোটেল রয়েছে। দুপুর থেকে ঘুরে বিকালে পদ্মা এক্সপ্রেসে চড়ে আবার ঢাকা ফিরে যেতে পারবেন। এছাড়া রাত্রীযাপন করতে চাইলেও চাটমোহর-পাবনা ঈশ্বরদীতে রয়েছে আধুনিক সব হোটেল-মোটেল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।