(প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে এক কাপ সুগন্ধী চা। সকালের ঘুম ভাঙানো কড়া লিকার হোক, বিকেলের আড্ডায় এক কাপ লেবু চা, কিংবা কাজের ফাঁকে মন জুড়ানো এক কাপ দুধ চা – বাঙালির আবেগ, সংস্কৃতি আর আতিথেয়তার সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে এই পানীয়টি। কিন্তু প্রশ্নটা বারবার উঠে আসে, চা খাওয়া কি স্বাস্থ্যকর? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ নয়, বরং এক জটিল ও সুন্দর সমীকরণ, যার প্রতিটি দিক আজ আমরা বিস্তারিত জানবো।)
চা খাওয়া কি স্বাস্থ্যকর? জানুন বিস্তারিত
চায়ের স্বাস্থ্যগত প্রভাব সম্পূর্ণ নির্ভর করে চায়ের ধরন, পান করার পরিমাণ, পানের সময় এবং ব্যক্তির স্বাস্থ্য অবস্থার উপর। চায়ের মূল গুণাবলী আসে ক্যামেলিয়া সিনেনসিস গাছের পাতা থেকে, যাতে রয়েছে পলিফেনল (বিশেষ করে ক্যাটেচিন ও এপিক্যাটেচিন), ক্যাফেইন, এল-থিয়ানিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসহ অসংখ্য জৈবসক্রিয় যৌগ।
- হার্টের স্বাস্থ্য: হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষণা (২০২৩) ও আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে প্রকাশিত সমীক্ষা মতে, নিয়মিত ও পরিমিত কালো চা (ব্ল্যাক টি) পান করলে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমাতে এবং রক্তনালীর কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করে। গ্রিন টি-তে বিদ্যমান এপিগ্যালোক্যাটেচিন গ্যালেট (EGCG) নামক শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
- মস্তিষ্কের কার্যকারিতা: ক্যাফেইন সতর্কতা ও মনোযোগ বাড়ায়, অন্যদিকে এল-থিয়ানিন নামক অ্যামিনো অ্যাসিড উদ্বেগ কমিয়ে আরামদায়ক সতর্কতার অনুভূতি দেয়। নিউট্রিয়েন্টস জার্নালের (২০২৪) এক রিভিউ বলছে, এই যুগ্ম প্রভাব সংজ্ঞানাত্মক দক্ষতা (Cognitive Function) এবং স্মৃতিশক্তির জন্য ইতিবাচক।
- টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস: ইউরোপিয়ান জার্নাল অফ এপিডেমিওলজির (২০২৩) বড় আকারের সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত চা (বিশেষ করে গ্রিন টি ও উলং টি) পান করেন তাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস বিকাশের ঝুঁকি কম থাকে। চায়ের পলিফেনল ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করতে পারে।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভাণ্ডার: চায়ে বিদ্যমান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (EGCG, থিয়াফ্লাভিন, থিয়ারুবিজিন) দেহে ফ্রি র্যাডিকেলের ক্ষতিকর প্রভাব (যা কোষের ক্ষতি ও বার্ধক্য ত্বরান্বিত করে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণ হতে পারে) প্রতিহত করে।
- ওজন ব্যবস্থাপনায় সহায়ক: কিছু গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে গ্রিন টি বিপাক ক্রিয়া সামান্য বাড়াতে এবং ফ্যাট অক্সিডেশনকে উৎসাহিত করতে পারে, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এটি কোনো ‘ম্যাজিক বুলেট’ নয়।
সতর্কতাও জরুরি: এই গুণাবলী পরিমিত পরিমাণে চা পানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অতিরিক্ত চা পান (বিশেষ করে অতিরিক্ত কড়া চা বা দিনে ৫-৬ কাপের বেশি) নানান স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
কত কাপ চা পান করা নিরাপদ?
এটি চায়ের প্রকার, ক্যাফেইনের পরিমাণ এবং ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) এর গাইডলাইন অনুযায়ী:
- প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য: সাধারণত দিনে ৩-৪ কাপ চা (মোটামুটি ৪০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইনের নীচে) বেশিরভাগ সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়।
- ক্যাফেইন সংবেদনশীলতা: যারা ক্যাফেইনের প্রতি সংবেদনশীল (অস্থিরতা, অনিদ্রা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি হয়), তাদের দিনে ১-২ কাপ বা ডিক্যাফিনেটেড চা বেছে নেওয়া উচিত।
- গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারী: এইচএসএইচ (হেলথ সাপ্লিমেন্টস হেল্পলাইন) ও আমেরিকান কলেজ অফ অবস্টেট্রিশিয়ান অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টস (ACOG) গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের দিনে ২০০ মিলিগ্রামের কম ক্যাফেইন গ্রহণের পরামর্শ দেয়, যা প্রায় ২-৩ কাপ চায়ের সমান (চায়ের শক্তির উপর নির্ভর করে)।
- কিশোর-কিশোরী: আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্সের মতে, ১২-১৮ বছর বয়সীদের দিনে ১০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন না নেওয়াই ভালো, অর্থাৎ ১ কাপের বেশি নয়।
মনে রাখুন:
- দুধ-চিনি যোগ করলে: দুধ যোগ করলে চায়ের কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের শোষণ কমে যেতে পারে। অতিরিক্ত চিনি যোগ করলে ক্যালোরি বৃদ্ধি ও রক্তে শর্করা ওঠানামার ঝুঁকি বাড়ে।
- খালি পেটে চা: অনেকের খালি পেটে চা পান করলে অ্যাসিডিটি বা বুক জ্বালাপোড়া হতে পারে। বিশেষ করে কড়া লিকার চা।
- খাবারের সাথে: চায়ের ট্যানিন লোহা (আয়রন), বিশেষ করে নন-হিম আয়রনের (উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত) শোষণে বাধা দিতে পারে। তাই খাবারের ঠিক আগে, পরে বা সাথে চা পান না করে অন্তত ১ ঘন্টা ব্যবধান রাখা ভালো।
কোন ধরনের চা সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর?
বিভিন্ন প্রকার চায়ের স্বাস্থ্যগুণে কিছু পার্থক্য রয়েছে:
- গ্রিন টি (সবুজ চা): সবচেয়ে কম প্রক্রিয়াজাত। এতে EGCG নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ সর্বাধিক। হার্টের স্বাস্থ্য, বিপাক, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা এবং ক্যান্সার প্রতিরোধের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত।
- হোয়াইট টি (সাদা চা): সবচেয়ে কচি পাতা ও কুঁড়ি থেকে তৈরি, ন্যূনতম প্রক্রিয়াজাতকরণ। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মাত্রা খুবই উচ্চ, স্বাদ সূক্ষ্ম ও মিষ্টি।
- উলং টি (ওলং চা): আংশিকভাবে জারিত। গ্রিন ও ব্ল্যাক টির মধ্যবর্তী স্বাদ ও গুণ। এটিও বিপাক ও ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হিসেবে পরিচিত।
- ব্ল্যাক টি (কালো চা): সম্পূর্ণরূপে জারিত। ক্যাফেইনের মাত্রা সাধারণত গ্রিন টির চেয়ে বেশি। থিয়াফ্লাভিন ও থিয়ারুবিজিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা হার্টের স্বাস্থ্য ও অন্ত্রের জন্য ভালো। স্বাদ সবচেয়ে তীব্র।
- হার্বাল টি (ভেষজ চা): প্রকৃতপক্ষে চা-গাছের পাতা নয় (ক্যামেলিয়া সিনেনসিস নয়), বরং বিভিন্ন ভেষজ, ফুল, ফল বা মসলার মিশ্রণ (যেমন: পুদিনা, ক্যামোমাইল, আদা, লেবু, তুলসী, হিবিস্কাস)। এগুলিতে সাধারণত ক্যাফেইন থাকে না এবং ভেষজের গুণ অনুযায়ী স্বাস্থ্যগত সুবিধা (যেমন: পাচনে সাহায্য, ঘুমের উন্নতি, প্রদাহনাশক) পাওয়া যায়।
বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে: আমাদের দেশে দুধ চা ও লিকার চা (ব্ল্যাক টি) সবচেয়ে জনপ্রিয়। দুধ চায়ের ক্ষেত্রে দুধের গুণাগুণ যোগ হয়, তবে অতিরিক্ত চিনি ও চর্বি যোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। লিকার চা তুলনামূলকভাবে কম ক্যালোরিযুক্ত, তবে অতিরিক্ত পানে অ্যাসিডিটি বাড়তে পারে।
অতিরিক্ত চা পানের সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিকগুলি
“পরিমিতি“র বাইরে গেলেই সমস্যা শুরু হয়:
- অনিদ্রা ও অস্থিরতা: ক্যাফেইনের অত্যধিক মাত্রা ঘুমের ব্যাঘাত, উদ্বেগ, অস্থিরতা, হাত কাঁপানো এমনকি হৃদস্পন্দন অনিয়মিত (Palpitations) করতে পারে।
- লৌহের ঘাটতি (আয়রন ডেফিসিয়েন্সি): চায়ের ট্যানিন খাদ্য থেকে উদ্ভিজ্জ উৎসের আয়রনের (নন-হিম আয়রন) শোষণে বাধা দেয়। বিশেষ করে যারা নিরামিষাশী বা যাদের রক্তস্বল্পতা আছে, তাদের খাবারের কমপক্ষে এক ঘণ্টা আগে বা পরে চা পান করা উচিত।
- ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা): যদিও চা তরল সরবরাহ করে, ক্যাফেইনের মূত্রবর্ধক প্রভাবের কারণে খুব বেশি চা পান করলে (বিশেষ করে কড়া চা) শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে যেতে পারে। পর্যাপ্ত সাধারণ পানি পান জরুরি।
- অম্লতা ও বুকজ্বালা: খালি পেটে অতিরিক্ত চা পাকস্থলীতে অ্যাসিড নিঃসরণ বাড়িয়ে গ্যাস্ট্রিক, অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা বুকজ্বালার কারণ হতে পারে।
- দাঁতের ক্ষয়: অতিরিক্ত চা পান (বিশেষ করে লেবু চা) দাঁতের এনামেল ক্ষয় করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ও ব্যবহারিক পরামর্শ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট (পুষ্টি ও ডায়েটেটিক্স), ডা. ফারহানা শারমিন বলছেন,
“চা পান নিষিদ্ধ নয়, বরং পরিমিত ও সচেতনভাবে পান করা উচিত। একজন সাধারণ সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কের জন্য দিনে ৩-৪ কাপ চা গ্রহণযোগ্য, তবে তা যেন খুব বেশি কড়া না হয় এবং অতিরিক্ত চিনিযুক্ত না হয়। যাদের অ্যাসিডিটির সমস্যা আছে, তারা দুধ চা বা লিকার চায়ের বদলে আদা চা, গ্রিন টি বা হালকা লিকার চা বেছে নিতে পারেন। খাবারের অন্তত ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা আগে বা পরে চা পান করা ভালো, বিশেষ করে যাদের রক্তস্বল্পতা আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চায়ের সাথে পর্যাপ্ত সাধারণ পানি পান করা।”
গবেষক ও চা বিশেষজ্ঞ, ড. এম এম নাজমুল হক (জাতীয় চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ) যোগ করেন,
“বাংলাদেশি চায়ের (ব্ল্যাক টি) গুণমান বিশ্বমানের। আমাদের চায়েও বিদ্যমান থিয়াফ্লাভিন, থিয়ারুবিজিনের মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হার্টের জন্য উপকারী। তবে, চা তৈরির পদ্ধতিও গুরুত্বপূর্ণ। খুব বেশি সিদ্ধ করলে বা গরম করা পানি বারবার ফুটালে চায়ের উপকারী যৌগ নষ্ট হতে পারে। পানি ফুটে উঠলে তা একটু ঠাণ্ডা করে (৮০-৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে) তারপর চায়ের পাতা দিয়ে ৩-৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে ছেঁকে নিলে সর্বোচ্চ গুণাগুণ ও স্বাদ পাওয়া যায়।”
কিভাবে স্বাস্থ্যকর উপায়ে চা পান করবেন?
- চিনি কমিয়ে ফেলুন: ধীরে ধীরে চিনির পরিমাণ কমান। স্বাদ বাড়াতে দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ বা প্রাকৃতিক মিষ্টির (সামান্য মধু – তবে গরম চায়ে সরাসরি না মিশিয়ে একটু ঠাণ্ডা হলে) ব্যবহার করুন।
- দুধের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করুন: দুধ চা পছন্দ করলে লো-ফ্যাট বা টোনড মিল্ক ব্যবহার করুন এবং পরিমাণটা যুক্তিসঙ্গত রাখুন।
- চায়ের শক্তি (Strength): অতিরিক্ত কড়া চা এড়িয়ে চলুন। পাতার পরিমাণ ও সিদ্ধ করার সময় কমিয়ে আনুন।
- বিকল্প অন্বেষণ করুন: কিছু চা গ্রিন টি, হোয়াইট টি, হার্বাল টি (আদা-লেবু, পুদিনা, তুলসী, ক্যামোমাইল) বা ডিক্যাফিনেটেড চা দিয়ে পরিবর্তন আনুন।
- পানের সময়: খাবারের মাঝখানে নয়। সকালে বা বিকেলের নাস্তার সাথে অথবা খাবারের অন্তত ১ ঘণ্টা পর পান করুন।
- পানি পান: প্রতিটি কাপ চায়ের জন্য অন্তত এক গ্লাস সাধারণ পানি পান করুন হাইড্রেশন বজায় রাখতে।
- ক্যাফেইন মনিটর করুন: দিনের শুরুতে বা দুপুরে চা পান করুন। রাতের দিকে (বিশেষ করে ঘুমানোর ৪-৬ ঘণ্টা আগে) ক্যাফেইনযুক্ত চা এড়িয়ে চলুন।
বাড়িতে তৈরি করুন স্বাস্থ্যকর চা:
- আদা-লেবু চা: এক কাপ গরম পানিতে ১ চা চামচ কুচি করা আদা ও ১ চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে ৫ মিনিট ঢেকে রাখুন। চিনি ছাড়াই পান করুন। সর্দি-কাশি, হজমে দারুণ!
- তুলসী-পুদিনা চা: কয়েকটি তুলসী ও পুদিনা পাতা গরম পানিতে ফুটিয়ে ছেঁকে নিন। মন ও পেট দুইই ভালো রাখে।
- গ্রিন টি: এক কাপ গরম (ফুটন্ত নয়, ৮০-৮৫°C) পানিতে ১ চা চামচ গ্রিন টি পাতা ২-৩ মিনিট ডুবিয়ে রাখুন। ছেঁকে নিন। সামান্য লেবুর রস বা মধু মেশাতে পারেন।
চা নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা
- ভুল ধারণা: “চা পান করলে পানিশূন্যতা হয়।“
সত্য: চায়ে বিদ্যমান পানি শরীরে তরলের যোগান দেয়। যদিও ক্যাফেইনের মৃদু মূত্রবর্ধক প্রভাব আছে, পরিমিত চা পান সামগ্রিকভাবে হাইড্রেশনে অবদান রাখে, শুধু অতিরিক্ত নয়। - ভুল ধারণা: “চায়ের কোনো পুষ্টিগুণ নেই।“
সত্য: চা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, পলিফেনলসহ নানান জৈবসক্রিয় যৌগে সমৃদ্ধ, যা বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সুবিধা প্রদান করে। - ভুল ধারণা: “সব ধরনের চায়ে সমান ক্যাফেইন থাকে।“
সত্য: ক্যাফেইনের মাত্রা চায়ের প্রকার, প্রস্তুত প্রণালী ও সিদ্ধ করার সময়ের উপর নির্ভর করে। সাধারণত ব্ল্যাক টি > উলং টি > গ্রিন টি > হোয়াইট টি। হার্বাল টিতে ক্যাফেইন নেই বললেই চলে।
জেনে রাখুন (FAQs)
প্রশ্ন: দিনে কয় কাপ চা পান করা ভালো?
উত্তর: বেশিরভাগ সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কের জন্য দিনে ৩-৪ কাপ চা (মোটামুটি ৪০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইনের নীচে) সাধারণত নিরাপদ। তবে এটি চায়ের ধরন (ব্ল্যাক, গ্রিন ইত্যাদি), কতটা কড়া এবং আপনার ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য (গর্ভাবস্থা, ক্যাফেইন সংবেদনশীলতা, অ্যাসিডিটি, রক্তস্বল্পতা) এর উপর নির্ভর করে। গর্ভবতী নারীরা দিনে ১-২ কাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখুন।
প্রশ্ন: খালি পেটে চা পান করা কি ঠিক?
উত্তর: খালি পেটে চা পান, বিশেষ করে কড়া লিকার চা, অনেকেরই অ্যাসিডিটি, বমি বমি ভাব বা বুকজ্বালার কারণ হতে পারে। চায়ের ট্যানিন পাকস্থলীর অ্যাসিড নিঃসরণকে উদ্দীপিত করতে পারে। তাই সকালে উঠে খালি পেটে চা না খেয়ে, এক-দুই টুকরো বিস্কুট বা হালকা কিছু খেয়ে তারপর চা পান করাটাই স্বাস্থ্যসম্মত।
প্রশ্ন: গ্রিন টি কি ব্ল্যাক টির চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যকর?
উত্তর: গ্রিন টি কম প্রক্রিয়াজাত হওয়ায় EGCG নামক শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি থাকে, যা বিভিন্ন গবেষণায় বিশেষভাবে আলোচিত। তবে ব্ল্যাক টিও থিয়াফ্লাভিন, থিয়ারুবিজিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ এবং হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উপকারী। উভয়েরই নিজস্ব গুণ আছে। পছন্দ ও সহ্য ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে যেকোনো একটি বা উভয়ই পরিমিত পরিমাণে পান করা যেতে পারে।
প্রশ্ন: চা পান কি রক্তস্বল্পতা (অ্যানিমিয়া) বাড়ায়?
উত্তর: চায়ে থাকা ট্যানিন খাদ্য থেকে নন-হিম আয়রনের (উদ্ভিদজাত খাবার যেমন: ডাল, শাক-সবজি, বাদাম থেকে প্রাপ্ত লৌহ) শোষণে বাধা দিতে পারে। যাদের আয়রনের ঘাটতি আছে বা যারা নিরামিষাশী, তারা খাবারের অন্তত এক ঘণ্টা আগে বা পরে চা পান করলে এই সমস্যা কম হয়। মাংস, মাছ বা ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের (যেমন: লেবু, ক্যাপসিকাম) সাথে থাকা হিম আয়রনের শোষণে চায়ের ট্যানিন তেমন প্রভাব ফেলে না।
প্রশ্ন: ডায়াবেটিস রোগীরা কি চা পান করতে পারবেন?
উত্তর: হ্যাঁ, তবে শর্তসাপেক্ষে। বিনা চিনি বা অতি অল্প চিনি/চিনির বিকল্প দিয়ে চা পান করা যেতে পারে। চিনিযুক্ত চা রক্তে শর্করা দ্রুত বাড়িয়ে দিতে পারে। গ্রিন টি বা ব্ল্যাক টি (বিনা চিনিতে) ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভালো বিকল্প। কিছু গবেষণায় গ্রিন টি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করতেও সাহায্য করতে পারে বলে জানা যায়।
প্রশ্ন: হার্বাল টি (ভেষজ চা) কি নিরাপদ?
উত্তর: সাধারণত হ্যাঁ, কারণ এগুলিতে ক্যাফেইন থাকে না এবং বিভিন্ন ভেষজের নিজস্ব গুণাগুণ থাকে (যেমন: পুদিনা – হজমে সাহায্য করে, ক্যামোমাইল – উদ্বেগ কমায় ও ঘুমে সাহায্য করে, আদা – বমিভাব দূর করে)। তবে, নির্দিষ্ট কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা (গর্ভাবস্থা, কিডনি রোগ, নির্দিষ্ট ওষুধ সেবন) থাকলে বা দীর্ঘদিন ধরে বেশি পরিমাণে কোনো একটি হার্বাল টি পান করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
চা শুধু একটি পানীয় নয়; এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সান্ত্বনা, সামাজিক বন্ধনের মাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। তবে, চা খাওয়া কি স্বাস্থ্যকর – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা জেনেছি, এর সুফল ও কুফল দুটিই বিদ্যমান। চায়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, হার্ট ও মস্তিষ্কের জন্য উপকারিতা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি অতিরিক্ত বা অসচেতনভাবে পান করলে অ্যাসিডিটি, অনিদ্রা বা আয়রন শোষণের সমস্যাও দেখা দিতে পারে। মূল মন্ত্র হলো ‘পরিমিতি’ ও ‘সচেতনতা’। আপনার পছন্দের চায়ের কাপটি উপভোগ করুন, তবে দিনে ৩-৪ কাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখুন, অতিরিক্ত চিনি পরিহার করুন, খাবারের সাথে সময় মেনে চলুন এবং নিজের শরীরের সংকেতকে গুরুত্ব দিন। আপনার স্মার্টফোন বা ডিভাইসে এই তথ্যগুলো মনে রাখুন, এবং আজ থেকেই স্বাস্থ্যকর উপায়ে চা পান করার অভ্যাস গড়ে তুলুন – এক কাপ সুস্বাদু চায়ের সাথে সুস্থতাকে সঙ্গী করুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।