গড়ে প্রতিমাসে আমাদের চুলের দৈর্ঘ্য বাড়ে প্রায় ১ সেন্টিমিটার। অন্যদিকে আঙুলের নখ বাড়ে প্রায় ৩ মিলিমিটার। এটা গড় হিসেব। সবার ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। অনেকে ক্ষেত্রে নখ ও চুল অনেক দ্রুত বাড়ে। কিন্তু কেন? চুল ও নখের মূল উপাদান কেরাটিন নামে একধরনের প্রোটিন। আমাদের ত্বকের নিচে ম্যাট্রিক্স কোষ থেকে তৈরি হয় চুল ও নখ। কোষ বিভাজনের ভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়।
নখের গোড়ায় ত্বকের নিচে থাকে বিশেষ ধরনের টিস্যু। মোটাদাগে একে বলা হয় ম্যাট্রিক্স টিস্যু। এখানকার কোষগুলো বিভাজিত হয়ে নখে নতুন কোষ তৈরি করে। নতুন কোষ তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরানো কোষগুলোকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়। নতুন কোষগুলো নখের প্লেটের (নখের সাদা ও শক্ত অংশ) ওপর দিয়ে পিছলে সামনের দিকে এগোয়।
ফলে নখ বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে নখের যে অংশ প্লেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেটাকেই আমরা কেটে নখ পরিপাটি রাখি। এগুলো মৃত কোষ হওয়ায় এখানে কোনো স্নায়ু সংযোগ থাকে না। তাই নখ কাটার সময় ব্যথা পাওয়া যায় না।
নখের মতো চুলের জন্মও শুরু হয় ত্বকের নিচে থাকা ম্যাট্রিক্স কোষ থেকে। ম্যাট্রিক্স কোষ বিভাজিত হয়ে প্রথমে চুলের শ্যাফট বা দৃশ্যমান শক্ত কালো, সাদা, লাল, ধূসর বা বাদামি রঙের কোষ তৈরি করে। আমরা একে চুলের বীজ হিসেবে চিন্তা করতে পারি। এরপর চুলের শ্যাফট স্থিতিস্থাপক কোষে তৈরি একধরনের থলের মধ্যে চলে যায়। এই থলে আমাদের কাছে হেয়ার ফলিকল নামে পরিচিত। চুলে স্নায়ু সংযোগ না থাকলেও হেয়ার ফলিকলে থাকে। একারণেই চুল টানলে চুলের গোড়ায় ত্বকের নিচে ব্যথা পাই।
স্নায়ু ছাড়াও এখানে থাকে তেল নিঃসরণের গ্রন্থি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পেশির সংযোগ। তেল চুলকে পিচ্ছিল করে রাখে হেয়ার ফলিকলের ভেতর। আর পেশিগুলোর কারণে ঠান্ডায় বা ভয় পেলে চুল দাঁড়িয়ে যায়। হেয়ার ফলিকলে পুষ্টি যোগানোর কাজ করে পেপিলা নামে সংযোগ-টিস্যু দিয়ে তৈরি অঙ্গাণু।
এটি হেয়ার ফলিকলের একদম গোড়ায় বসে থাকে। প্যাপিলার কাছাকাছি থাকা ম্যাট্রিক্স কোষগুলো ক্রমাগত বিভাজিত হয়ে শক্ত শ্যাফট বা চুল তৈরি করে। শ্যাফটের কোষের পরিমাণ যত বাড়ে, চুল ততই বড় হয়। একদময় ত্বক ভেদ করে ওপরে উঠে আসে। ম্যাট্রিক কোষ যত বিভাজিত হয়, চুল তত বাড়তে থাকে।
চুল ও নখের জন্ম এবং বৃদ্ধির বিষয়টা বোঝা গেল। শুরুতেই বলেছিলাম, সবার ক্ষেত্রে চুল বা নখের বৃদ্ধির হার সমান হয় না। কারণটা মূলত জিনগত। ব্যাক্তিভেদে চুলের বৃদ্ধি কমবেশি হয়। তবে একই পরিবারের মানুষেরদের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার মোটামুটি এক থাকে। নখের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভাইবোনের বিশেষ করে আইডেন্টিক্যাল টুইনের ক্ষেত্রে সমানভাবে বাড়ে।
তবে এটা ছাড়া আরও কিছু বিষয় আছে। বয়সের কারণে চুল ও নখের বৃদ্ধি কম-বেশি হয়। স্বাস্থ্যবান মানুষের ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা যায়। বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে হজম শক্তি ও কোষ বিভাজন কমে। অল্পবয়সী মানুষের বেলায় নখ ও চুলের বৃদ্ধি তুলনামূলক বেশি হয়।
হরমোনের পরিবর্তনও এ ক্ষেত্রে ভালো প্রভাব ফেলে। গর্ভকালীন অবস্থায় অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের প্রবাহ বেড়ে যায় মায়েদের দেহে। ফলে অনেকের চুল ও নখ বৃদ্ধির হার বেড়ে যায়। আবার মেনোপজ (অর্থাৎ যখন থেকে মেয়েদের ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যায়) অবস্থায় কিংবা স্ট্রেস হরমোনের কারণে বৃদ্ধির হার কমে যায়।
নখ ও চুলের বৃদ্ধিহার পরিবর্তনের পেছনে নিউট্রেশন বা পুষ্টির অবদানও কম নয়। চুল ও নখের মূল উপাদান কেরোটিন হলেও, এতে পানি চর্বি ও বিভিন্ন খনিজ পদার্থ থাকে। ফলে পুষ্টি কমে গেলে স্বাভাবিক হিসেবেই বৃদ্ধির হার কমে যায়। চুল ও নখের বৃদ্ধির হার ধরে রাখার জন্য সুষম খাবার খাওয়া এবং সুস্বাস্থ্য ধরে রাখা জরুরি। পুষ্টির ঘাটতি হলে নখ ও চুলের গঠনেও পরিবর্তন আসে। যেমন, শরীরে আয়রন ও জিংকের ঘাটতি হলে চুল ও নখ ভঙুর হয়ে যায়। ফলে জিনগতভাবে দ্রুত চুল ও নখ বাড়লেও তা দ্রুত ভেঙে যাওয়ার কারণে মনে হয়, বৃদ্ধি যথাযথ হচ্ছে না।
মোটকথা, চুল বা নখ ব্যাক্তিভেদের কম-বেশি হওয়ার পেছনে একক কোনো কারণ নেই। বংশগত বা জিনগত কারণ, খাদ্যভাস, মানসিক চাপ ইত্যাদি অনেক কিছু এর সঙ্গে যুক্ত। তবে এটুকু বলা যায়, শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের সঙ্গে চুল ও নখ বৃদ্ধির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মৃত কোষ হলেও চুল আর নখ তো শরীরেরই অংশ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।