(প্রাকৃতিক আলোয় পড়তে থাকা একটি কুরআন শরীফের পাশে রাখা চশমার ছবি কল্পনা করুন। দৃশ্যটি প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণ প্রকাশ করছে।)
গভীর রাত। ঢাকার মোহাম্মদপুরের এক ছোট্ট ফ্ল্যাটে রুমানা আপু (৪২) টেবিল ল্যাম্পের নরম আলোয় কুরআন তিলাওয়াত করছেন। হঠাৎ চোখে অস্বস্তি, ঝাপসা দেখা। চোখ দুটি ক্লান্ত, শুষ্ক। দীর্ঘদিন স্ক্রিনের সামনে অফিসের কাজ, রাত জেগে ইবাদত, আর সকাল সকাল সন্তানদের স্কুলের প্রস্তুতি— সব মিলিয়ে চোখের ওপর চাপ বাড়ছিলই। একদিন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. এহসানুল হকের চেম্বারে গিয়ে জানলেন, চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। চিকিৎসকের পরামর্শের পাশাপাশি তিনি খুঁজতে লাগলেন, ইসলাম তো প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হেফাজতের নির্দেশ দেয়। তাহলে চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক কী? কীভাবে এই অমূল্য নিয়ামতের যত্ন নেওয়া যায় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে?
Table of Contents
আমাদের চোখ শুধু দেখার অঙ্গই নয়, এটি অন্তরের দরজা, জ্ঞানের বাহন, আল্লাহর সৃষ্টি নিদর্শন অবলোকনের মাধ্যম। কুরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা অসংখ্যবার দৃষ্টিশক্তির গুরুত্ব ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথা বলেছেন। সূরা মুলকে ইরশাদ হয়েছে, “বলুন, চিন্তা করো তো, যদি আল্লাহ তোমাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেন এবং তোমাদের অন্তরসমূহ মোহর করে দেন, তবে আল্লাহ ছাড়া কোন সত্তা আছে কি যে এগুলো তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেবে?” (সূরা আল-আন’আম, ৬:৪৬)। এই আয়াত একদিকে যেমন দৃষ্টিশক্তির মহান নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, অন্যদিকে তাগিদ দেয় এর যথাযথ হেফাজতের। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও চোখের যত্ন নিতেন, চোখে সুর্মা ব্যবহার করতেন এবং অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিতেন। চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক শুধু শারীরিক যত্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি সমন্বিত জীবনব্যবস্থার অংশ— যেখানে আধ্যাত্মিকতা, স্বাস্থ্যবিধি, পবিত্রতা এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা একসূত্রে গাঁথা।
চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক: কুরআন-সুন্নাহর আলোকে দৃষ্টিশক্তির হেফাজত (H2)
ইসলাম মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে। চোখের মতো অমূল্য নিয়ামতের হেফাজতও এর ব্যতিক্রম নয়। চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক-এর প্রথম স্তম্ভ হলো এই নিয়ামতের প্রকৃত মূল্য অনুধাবন করা এবং এর জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। শুকরিয়া শুধু মুখে বলার বিষয় নয়, বরং নিয়ামতকে সঠিক পথে ব্যবহার করা, তার ক্ষতি থেকে বাঁচানো এবং তার যথাযথ যত্ন নেওয়ার মাধ্যমেই তা পূর্ণতা পায়।
- দৃষ্টিশক্তি আল্লাহর আমানত: ইসলাম শিক্ষা দেয় যে, আমাদের শরীর ও এর সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানতস্বরূপ প্রাপ্ত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই তোমাদের দেহেরও তোমার উপর হক আছে।” (সহীহ বুখারী)। চোখ এই দেহেরই অপরিহার্য অংশ। এর সুরক্ষা ও সুস্থতা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। এই আমানতের খেয়ানত করা, অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে চোখের ক্ষতি সাধন করা বা এর প্রয়োজনীয় যত্ন না নেওয়া ইসলামে নিন্দনীয়।
- অনাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টি থেকে হিফাজত: ইসলামে ‘গজরে বাস’ বা কুদৃষ্টির ধারণা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কুদৃষ্টি সত্যি এবং তার প্রভাব ভয়ানক।” (সহীহ মুসলিম)। অন্যকে ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে বা হিংসাভরে তাকানো থেকে বিরত থাকা যেমন জরুরি, তেমনি নিজেকেও অন্যের কুদৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। এখানেই চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্র্যাকটিক্যাল দিক এসে যায়:
- সূরা ফালাক ও নাসের আমল: কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য নিয়মিত সূরা ফালাক ও সূরা নাস তিলাওয়াত করা, বিশেষ করে সকাল-সন্ধ্যায়।
- দোয়া পড়া: রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আলী (রা.)-কে শিখিয়েছিলেন: “أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ” – “আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালিমাসমূহের আশ্রয় নিচ্ছি তাঁর সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে।” (তিরমিজি)
- পর্দা: ইসলামে পুরুষ ও নারীর জন্য পর্দার বিধান শুধু শালীনতাই রক্ষা করে না, বরং তা অযাচিত দৃষ্টি ও তার সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব (মনস্তাত্ত্বিক চাপ, অশ্লীলতার প্রতি আকর্ষণ যা মস্তিষ্ককে বিষিয়ে তুলতে পারে) থেকে চোখ ও অন্তরকে সুরক্ষা দেয়।
- সুন্নাহতে চোখের পরিচর্যা:
- সুর্মা (কাজল) ব্যবহার: রাসূলুল্লাহ (সা.) নিয়মিত সুর্মা ব্যবহার করতেন। তিনি বলেছেন, “তোমরা ইস্মিদ (প্রাচীনকালে ব্যবহৃত এক ধরনের প্রাকৃতিক সুর্মাপাথর) দ্বারা সুর্মা লাগাও, কেননা তা দৃষ্টিশক্তি বাড়ায় এবং চোখের পাপড়ি গজায়।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিসটি হাসান পর্যায়ের)। আধুনিক গবেষণাও প্রমাণ করে যে, নির্দিষ্ট কিছু প্রাকৃতিক উপাদানের সুর্মা চোখকে জীবাণুমুক্ত রাখতে, জ্বালাপোড়া কমাতে এবং কিছু ক্ষেত্রে দৃষ্টিশক্তি রক্ষায় সহায়ক হতে পারে। তবে অবশ্যই খাঁটি ও স্বাস্থ্যসম্মত সুর্মা ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চক্ষু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নির্দেশিকা দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
- ঘুম: রাসূলুল্লাহ (সা.) রাতের শেষ তৃতীয়াংশে তাহাজ্জুদ পড়তেন বটে, কিন্তু তিনি পর্যাপ্ত ঘুমেরও গুরুত্ব দিতেন। অপর্যাপ্ত ঘুম চোখের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, যা ড্রাই আইজ, দৃষ্টি ঝাপসা এবং দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক সমস্যার কারণ হতে পারে।
- নিয়মিত ওযু: দিনে পাঁচবার ওযুর সময় চোখে পানি দেওয়া চোখকে পরিষ্কার ও সতেজ রাখতে সহায়তা করে।
এই সমস্ত নির্দেশনা শুধু রুটিনের অংশ নয়; এগুলোই চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক-এর প্রাণ, যা আমাদের দৈনন্দিন আমলের সাথে চোখের স্বাস্থ্যকে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে দেয়।
দৃষ্টিশক্তি রক্ষায় দৈনন্দিন আমল ও খাদ্যাভ্যাস: ইসলামিক জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ (H2)
চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক শুধু কিছু বিচ্ছিন্ন আমলে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি সামগ্রিক জীবনদর্শনের প্রতিফলন। ইসলাম যে ভারসাম্যপূর্ণ ও প্রাকৃতিক জীবনযাপনের শিক্ষা দেয়, তা সরাসরি চোখসহ সমগ্র শরীরের স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত।
- ইবাদতে ভারসাম্য: ইসলাম কঠোর পরিশ্রম বা ইবাদতের নামে শরীরের ক্ষতি সাধনকে নিষেধ করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই তোমার দেহেরও তোমার উপর হক আছে।” (সহীহ বুখারী)। রাত জেগে কুরআন তিলাওয়াত বা জিকির-আজকার করা মহান সওয়াবের কাজ হলেও, যদি তা চোখের প্রচণ্ড ক্লান্তি, শুষ্কতা বা দৃষ্টি সমস্যার কারণ হয়, তবে তা ইসলামের এই ভারসাম্যের শিক্ষার পরিপন্থী। দীর্ঘক্ষণ একটানা পড়াশোনা বা ইবাদতের মাঝে ছোট বিরতি নেওয়া, দূরের বস্তুর দিকে তাকানো (২০-২০-২০ নিয়ম: প্রতি ২০ মিনিটে ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরের দিকে তাকানো), চোখের পলক ফেলা এবং পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক-এরই বাস্তব প্রয়োগ।
- খাদ্যাভ্যাস: আল্লাহর দেওয়া প্রাকৃতিক ওষুধ: কুরআন ও হাদিসে এমন অনেক খাবারের কথা উল্লেখ আছে যেগুলো চোখের জন্য বিশেষ উপকারী। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও কিছু খাবার বিশেষ পছন্দ করতেন।
- খেজুর: রাসূল (সা.) প্রায়ই খেজুর খেতেন। খেজুরে রয়েছে ভিটামিন এ, যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধে এবং দৃষ্টিশক্তি রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পূর্ববর্তী নিবন্ধ “ইসলামিক খাদ্যাভ্যাসে সুস্থ জীবন” এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
- জয়তুনের তেল: কুরআনে বারবার বরকতময় গাছ হিসেবে উল্লিখিত জয়তুন। এর তেল ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডে সমৃদ্ধ, যা চোখের রেটিনার জন্য অপরিহার্য এবং ড্রাই আইজ প্রতিরোধে সাহায্য করে। রাসূল (সা.) জয়তুনের তেল খাওয়া ও শরীরে মাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
- গাজর, কুমড়া, সবুজ শাকসবজি: ভিটামিন এ, সি, ই, লুটেইন ও জিয়াজ্যানথিনে ভরপুর এই খাবারগুলো চোখের লেন্স ও রেটিনাকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এবং বয়সজনিত দৃষ্টিহানি (ম্যাকুলার ডিজেনারেশন) প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- মাছ: বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ (স্যামন, টুনা) ওমেগা-৩ এর চমৎকার উৎস।
- পানি: প্রচুর পানি পান করা সমগ্র শরীরের পাশাপাশি চোখের আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য অত্যাবশ্যক। রাসূলুল্লাহ (সা.) খালি পেটে পানি পান করতে নিষেধ করেছেন, তবে পরিমিত ও প্রয়োজনমতো পানি পান করাকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
- মধু: প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণে ভরপুর মধু চোখের সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে (বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবহার নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে)। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া চোখে মধু ব্যবহার করা উচিত নয়।
- নিয়মিত চেকআপ ও চিকিৎসা গ্রহণ: ইসলাম অসুস্থ হলে চিকিৎসা নেওয়ার প্রতি জোরালো তাগিদ দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি, যার নিরাময়ও তিনি সৃষ্টি করেননি।” (সুনানে আবু দাউদ)। চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক-এর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো বছরে অন্তত একবার চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে দৃষ্টি পরীক্ষা করানো এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বা চশমা ব্যবহার করা। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখাও চোখের সুস্থতার জন্য জরুরি।
আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ: ডিজিটাল ডিভাইস ও ইসলামিক সুরক্ষা কৌশল (H2)
আজকের যুগে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এই ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহার চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক-এর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ‘ডিজিটাল আই স্ট্রেইন’ বা ‘কম্পিউটার ভিশন সিন্ড্রোম’ এখন খুবই সাধারণ সমস্যা। ইসলামের ভারসাম্যের নীতিই এখানে আমাদের পথ দেখাতে পারে।
- সময় ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ: ইসলাম সব কিছুর মধ্যে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, অতিরিক্তি করো না।” (সহীহ বুখারী)। স্ক্রিন টাইম সীমিত করা, বিশেষ করে বিনোদনের জন্য, ইসলামের এই মধ্যপন্থার শিক্ষার প্রতিফলন। অপ্রয়োজনীয় দৃশ্য, ভিডিও বা সামগ্রী দেখা থেকে বিরত থাকা গজরে বাস ও অন্তরের কঠোরতা থেকে রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি চোখের উপর অযাচিত চাপ কমাতেও সাহায্য করে।
- প্রযুক্তিগত সুরক্ষা:
- ২০-২০-২০ নিয়ম: ইসলামে ইবাদতের মাঝেও ছোট বিরতির সুযোগ আছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতি ২০ মিনিট অন্তর ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরের দিকে তাকানো।
- স্ক্রিন ব্রাইটনেস ও কন্ট্রাস্ট: অতিরিক্ত উজ্জ্বল বা অতিরিক্ধ অন্ধকার স্ক্রিন চোখের জন্য ক্ষতিকর। পরিবেশের আলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মাঝারি মাত্রার ব্রাইটনেস সেট করা উচিত।
- ব্লু লাইট ফিল্টার/নাইট মোড: সন্ধ্যার পর থেকে ফোন বা ল্যাপটপে ব্লু লাইট ফিল্টার চালু করা। এই নীল আলো মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণে বাধা দেয়, যা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। আর রাত জাগা চোখের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
- পর্দা থেকে দূরত্ব: ডিভাইসের স্ক্রিন থেকে উপযুক্ত দূরত্ব বজায় রাখা (ফোন: ১৬-১৮ ইঞ্চি, ল্যাপটপ/ডেস্কটপ: ২০-২৬ ইঞ্চি)।
- আলোর গুরুত্ব: রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্ধকারে কুরআন পড়তে নিষেধ করেছেন (সুনানে আবু দাউদ)। কারণ এতে চোখের উপর বাড়তি চাপ পড়ে। পড়ার সময়, কাজ করার সময় বা ডিভাইস ব্যবহারের সময় পর্যাপ্ত ও সঠিক আলোর (প্রাকৃতিক আলো বা উষ্ণ সাদা এলইডি) ব্যবস্থা করা চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক-এরই অংশ।
দুআ ও জিকির: চোখের সুস্থতার আধ্যাত্মিক শক্তি (H3)
ইসলামে দুআ বা প্রার্থনা হল ইবাদতের মগজ। চোখের সুস্থতা কামনাও এর অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন সময়ে চোখের রোগ বা কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে নির্দিষ্ট দুআ শিক্ষা দিয়েছেন:
সাধারণ চোখের অসুস্থতার দুআ:
“اللَّهُمَّ مُصَرِّفَ الْقُلُوبِ صَرِّفْ قُلُوبَنَا عَلَى طَاعَتِكَ، اللَّهُمَّ مُصَرِّفَ الْعُيُونِ صَرِّفْ عُيُونَنَا عَنْ مَعَاصِيكَ”
“হে আল্লাহ! হৃদয়সমূহের ঘূর্ণনকারী, আমাদের হৃদয়গুলো তোমার আনুগত্যের দিকে ঘুরিয়ে দিন। হে আল্লাহ! চোখসমূহের ঘূর্ণনকারী, আমাদের চোখগুলো তোমার নাফরমানি থেকে ফিরিয়ে রাখুন।”
(এটি একটি দুআ, যদিও সরাসরি চিকিৎসার বিকল্প নয়, আধ্যাত্মিক সুরক্ষা ও আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি ও সুস্থতার পরিবেশ তৈরি করে)।কুদৃষ্টি বা অনিষ্ট থেকে সুরক্ষার দুআ: ইতিপূর্বে উল্লিখিত সূরা ফালাক, সূরা নাস এবং “أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ…” দুআ নিয়মিত পড়া।
- কোনো বেদনা বা রোগের সাধারণ দুআ:
“أَسْأَلُ اللَّهَ الْعَظِيمَ رَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ أَنْ يَشْفِيَكَ”
“আমি মহান আরশের অধিপতি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তোমাকে শিফা দান করেন।” (সুনানে আবু দাউদ, তিরমিজি)
অথবা চোখে হাত রেখে পড়া:
“بِسْمِ اللَّهِ، اللَّهُمَّ أَذْهِبْ عَنْهُ الْبَاسَ، رَبَّ النَّاسِ، اشْفِهِ وَأَنْتَ الشَّافِي، لَا شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لَا يُغَادِرُ سَقَمًا”
“বিসমিল্লাহ। হে আল্লাহ! তার কষ্ট দূর করে দিন। হে মানুষের রব! তাকে সুস্থ করুন, আপনিই তো আরোগ্য দানকারী। আপনার আরোগ্য ছাড়া কোনো আরোগ্য নেই। এমন আরোগ্য দিন যাতে কোনো রোগ অবশিষ্ট না থাকে।”
এই দুআ ও জিকির চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক-এর আধ্যাত্মিক স্তম্ভ। এগুলো মনকে প্রশান্ত করে, আল্লাহর উপর ভরসা বাড়ায় এবং সুস্থতার জন্য একটি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। তবে মনে রাখতে হবে, দুআর পাশাপাশি প্রাকৃতিক উপায়ে চিকিৎসা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করাই সুন্নত।
বাস্তব জীবনে প্রয়োগ: সিলেটের একজন শিক্ষকের গল্প (H3)
আহমেদ হোসেন (৫০), সিলেটের এক প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। দীর্ঘদিন বোর্ডে লিখা, খাতা দেখা, কম্পিউটারে রেজাল্ট তৈরি করা— এসবের চাপে তার চোখে শুরু হয়েছিল প্রচণ্ড ব্যথা ও দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসার সমস্যা। ডাক্তার ডিজিটাল আই স্ট্রেইন ও প্রেসবায়োপিয়ার কথা বললেন। আহমেদ স্যার শুধু চশমা নিলেন না, বরং খুঁজতে লাগলেন চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক। তিনি শুরু করলেন:
- ২০-২০-২০ নিয়ম: ক্লাসের ফাঁকে বা খাতা দেখার সময় প্রতি ২০ মিনিট পর দূরের জানালার বাইরে সবুজ গাছের দিকে তাকাতেন।
- সকাল-সন্ধ্যায় সূরা ফালাক-নাস: কুদৃষ্টি থেকে সুরক্ষার জন্য নিয়মিত পড়া শুরু করলেন।
- খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন: প্রতিদিনের খাবারে গাজর, পালং শাক, মিষ্টি কুমড়া ও মৌসুমী ফল বাড়ালেন। রাতে ঘুমানোর আগে এক চামচ মধু খাওয়া শুরু করলেন।
- স্ক্রিন টাইম ম্যানেজমেন্ট: ফোনে সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কমিয়ে দিলেন। রাত ১০টার পর সব ডিভাইস বন্ধ রাখা এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানো বা কুরআন তিলাওয়াতকে প্রাধান্য দিলেন।
- পর্যাপ্ত ঘুম: নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ার পরও তিনি ভোররাতের দিকে একটু বেশি ঘুমানোর চেষ্টা করলেন।
কয়েক মাসের মধ্যে আহমেদ স্যারের চোখের ব্যথা ও ক্লান্তি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। শুধু চোখ নয়, তার সার্বিক স্বাস্থ্য ও মানসিক প্রশান্তিও বেড়েছে। তার এই গল্প প্রমাণ করে চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক শুধু তত্ত্ব নয়, বরং বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্য ও ফলপ্রসূ একটি জীবনপদ্ধতি।
চোখ ভালো রাখার ইসলামিক দিক মানে শুধু চশমা বা ড্রপ নয়; এটা আল্লাহর দেওয়া অমূল্য নিয়ামতের প্রতি শ্রদ্ধা, এর সঠিক ব্যবহার, ক্ষতিকর দৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষা, প্রাকৃতিক উপায়ে যত্ন নেওয়া এবং অসুস্থ হলে চিকিৎসা নেওয়ার মাধ্যমে এক সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপনের নাম। এই দৃষ্টিভঙ্গি আপনাকে শুধু দৃষ্টিশক্তিই সুরক্ষিত রাখবে না, বরং দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতার পথও দেখাবে। আজই শুরু করুন: অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম কমান, পুষ্টিকর খাবার খান, নিয়মিত চোখের চেকআপ করান, সূরা ফালাক-নাসের আমল করুন এবং এই মহান নিয়ামতের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ে সচেষ্ট হোন। আপনার চোখই দেখবে দুনিয়ার সৌন্দর্য এবং কিয়ামতের দিন আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের মহিমা।
জেনে রাখুন (H2)
প্রশ্ন: চোখে সুর্মা লাগানো কি সুন্নত? হাদিসে এর কী ফজিলত বলা হয়েছে?
উত্তর: হ্যাঁ, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিয়মিত সুর্মা ব্যবহার করতেন এবং উম্মতকেও উৎসাহিত করেছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ইস্মিদ (এক প্রকার প্রাকৃতিক সুর্মাপাথর) দ্বারা সুর্মা লাগালে তা দৃষ্টিশক্তি প্রখর করে এবং চোখের পাপড়ি গজায় (সুনানে ইবনে মাজাহ)। তবে খাঁটি ও স্বাস্থ্যসম্মত সুর্মা ব্যবহার করা জরুরি।প্রশ্ন: ইসলামে চোখের অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া কি জরুরি? নাকি শুধু দোয়াই যথেষ্ট?
উত্তর: ইসলাম অসুস্থ হলে চিকিৎসা নেওয়ার উপর জোর দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর…” (সুনানে আবু দাউদ)। দোয়া করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা ইবাদত, কিন্তু দোয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক উপায়ে এবং যোগ্য ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করা সুন্নতের অনুসরণ। দোয়া ও চিকিৎসা একে অপরের পরিপূরক।প্রশ্ন: কুরআন পড়ার সময় চোখে চাপ পড়লে ইসলাম কী নির্দেশনা দেয়?
উত্তর: ইসলাম ভারসাম্যের শিক্ষা দেয়। দীর্ঘক্ষণ একটানা পড়ার ফলে চোখে চাপ পড়লে, বিরতি নেওয়া উচিত। রাসূল (সা.) অন্ধকারে পড়তে নিষেধ করেছেন (সুনানে আবু দাউদ)। পর্যাপ্ত আলো, উপযুক্ত দূরত্ব, মাঝে মাঝে দূরে তাকানো এবং প্রয়োজনে চশমা ব্যবহার করা উচিত। ইবাদতে শরীরের হক নষ্ট করা ঠিক নয়।প্রশ্ন: চোখ ভালো রাখার জন্য ইসলামে বিশেষ কোন খাবারের কথা উল্লেখ আছে কি?
উত্তর: সরাসরি চোখের জন্য নির্দিষ্ট খাবারের উল্লেখ না থাকলেও, রাসূল (সা.) যে সকল খাবার পছন্দ করতেন বা গুরুত্ব দিয়েছেন (যেমন খেজুর, জয়তুনের তেল, মধু) এবং কুরআনে বরকতময় ফল হিসেবে উল্লিখিত খাবারগুলো (আঙ্গুর, ডুমুর, জয়তুন) ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ, যা চোখসহ সমগ্র শরীরের জন্য উপকারী। ইসলামিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে আরও জানুন এখানে।প্রশ্ন: মোবাইল ফোনের নীল আলো থেকে চোখ রক্ষার ইসলামিক উপায় কী?
উত্তর: ইসলামিক উপায় হলো সময়ের ভারসাম্য ও প্রযুক্তির সতর্ক ব্যবহার:
১. স্ক্রিন টাইম সীমিত করা (বিনোদনের জন্য বিশেষ করে)।
২. ব্লু লাইট ফিল্টার/নাইট মোড চালু করা (বিশেষ করে সন্ধ্যার পর)।
৩. ২০-২০-২০ নিয়ম মেনে চলা।
৪. রাত জাগা কমিয়ে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা (নীল আলো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়)।
৫. অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর দৃশ্য দেখা থেকে চোখ ও মনকে হিফাজত করা।- প্রশ্ন: চোখের জন্য বিশেষ কোন দুআ কি আছে?
উত্তর: হ্যাঁ, রাসূলুল্লাহ (সা.) চোখের ব্যথা বা অসুস্থতায় হাত রেখে সাধারণ রোগের দুআ পড়তেন (যেমন উপরে উল্লিখিত “بِسْمِ اللَّهِ، اللَّهُمَّ أَذْهِبْ عَنْهُ الْبَاسَ…”)। কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য সূরা ফালাক, সূরা নাস এবং “أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ…” দুআ পড়া খুবই ফলপ্রসূ। নিয়মিত আল্লাহর কাছে সুস্থতার জন্য দোয়া করা উচিত।
⚠️ দ্রষ্টব্য: এই নিবন্ধে প্রদত্ত তথ্য ইসলামিক নির্দেশনা ও সাধারণ স্বাস্থ্য পরামর্শের সমন্বয়। এটি চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়। চোখের কোনো সমস্যা অনুভব করলে অবশ্যই একজন যোগ্য চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।**
<
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।