তোফায়েল আহমেদ: এ বছর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপন করছে। ১৯৭৩-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে নেতাকর্মীর পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস।’ বাঙালির আধুনিক কালের ইতিহাস অনুযায়ী কথাটি আক্ষরিক অর্থেই সত্য। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ- এই চারটি নাম সমার্থক। বাঙালি জাতিসত্তাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় সত্তায় অভিষিক্ত করতে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার সুদীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অসীম ত্যাগ ও অবদান অনস্বীকার্য।
নিজ জাতির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাসের প্রতিটি ধাপে অগ্রণী ভূমিকা পালনের এমন দৃষ্টান্ত আন্তর্জাতিক ছাত্র রাজনীতিতে দুর্লভ। এ জন্য বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগকে অভিহিত করেছিলেন অগ্রগামী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে। অগ্রসর ভূমিকা পালনে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছাত্রলীগ গৌরবময় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি ধাপেই আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করতে হারিয়েছে অসংখ্য নেতাকর্মী। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামে এই মহত্তর আত্মদান একটি ছাত্র সংগঠনের জন্য বিরল গৌরবের।
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের জয়যাত্রা শুরু হয়। মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ লোক যে উর্দু ভাষায় কথা বলে, সেই জনবিচ্ছিন্ন ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ ও শাসক মুসলিম লীগের প্রতারণামূলক অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুসলিম লীগের তরুণ নেতৃত্ব গঠন করে ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংগঠিত করে ছাত্রসমাজের মাঝে রাজনৈতিক অধিকারের চেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে ‘৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গঠিত হয় ছাত্রলীগ। গঠন প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, নূরউদ্দিন আহমেদ, এমএ ওয়াদুদ, নঈমউদ্দিন আহমেদসহ ১৪ জন প্রগতিবাদী ছাত্রনেতা।
প্রতিষ্ঠার মহতী লগ্নে গঠনমূলক ১০টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে ছাত্রলীগের অগ্রযাত্রা শুরু- শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি, দেশরক্ষা, স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ছাত্রসমাজকে দলীয় রাজনীতিমুক্ত রাখা, নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে জিহাদ, আধুনিক ধ্যান-ধারণা ও কৃষ্টির মাধ্যমে উন্নত চরিত্রের অধিকারী বিপ্লবী কর্মী সৃষ্টি, জাতি ও দেশের কল্যাণে ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা, জনকল্যাণে নিয়োজিত থাকা ও গণস্বার্থবিরোধী কর্মে সংগ্রাম, প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি আদায়, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ও চোরাকারবারিদের উচ্ছেদ সাধন এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছাত্র আন্দোলন পরিচালনার যে রেওয়াজ প্রচলিত, তার ধ্বংস সাধন। উপরোক্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ধারক-বাহক ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছাত্রসমাজের অধিকার শুধু নয়; গোটা বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামী চেতনার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্যে গড়ে তোলা সব আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। প্রতিষ্ঠাকালীন ছাত্রলীগের আদর্শ-উদ্দেশ্য ছিল বাংলার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ‘প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকার’-এর দাবি। ‘৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা তা অর্জন করি। আমাদের অর্জিত সাফল্যের পথ ধরেই ‘৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ‘৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়। ‘৭০-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা এবং ছাত্রসমাজের ১১ দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে।
‘৭১-এর ৩ জানুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করান স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন ও শাসনতন্ত্র তৈরি করার জন্য অধিবেশনে মিলিত হতে না দিয়ে ‘৭১-এর ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে পূর্বঘোষিত ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্রনেতাদের ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। একমাত্র ছাত্রলীগ নেতারাই সব ধরনের ঝুঁকির মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেন।
২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ম্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় এবং তাঁর নির্দেশে কলাভবনে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র-খচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন স্বাধীনতার অমোঘ মন্ত্র- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আর ৮ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের রক্তঝরা দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর মোট ৩৫টি ঐতিহাসিক নির্দেশের প্রতিটি বাঙালির কাছে হয়ে উঠেছিল অবশ্যপালনীয় অলঙ্ঘ্য বিধান। এর পর ২৫ মার্চ কালরাতে নজিরবিহীন গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের সাবেক ও তৎকালীন নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘মুজিব বাহিনী’ তথা বিএলএফ। মুজিব বাহিনী গঠন করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ৩০ লাখ প্রাণ আর ২ লাখ মা-বোনের সুমহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করি।
‘৪৮-এর ১১ মার্চের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের যে জয়যাত্রা সূচিত হয়েছিল; ‘৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ‘৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৪-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ আন্দোলন, ‘৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণআন্দোলন, ‘৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং ‘৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ পালন করে অগ্রগামী ভূমিকা। এসব মহিমান্বিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ অর্জন করে গণতান্ত্রিক তথা নিয়মতান্ত্রিক আচরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জয় করে নেয় বাংলার মানুষের হৃদয় আর সৃষ্টি করে ইতিহাস। সুনির্দিষ্ট আচরণবিধি, নিয়মানুবর্তিতা, সংগঠনের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ সৃষ্টি করে অসংখ্য বিপ্লবী ও সংস্কৃতিমান নেতাকর্মী। ছাত্রলীগের সম্মেলন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি বছর ২১ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। তা না হলে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির কাছে নেতৃত্ব তুলে দিতে হতো। এটিই ছিল বিধান এবং গঠনতান্ত্রিক বিধি-বিধানের অন্যথা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে ছাত্রলীগ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে শামিল হয়ে যে রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনা অর্জন করেছিল; তা সংরক্ষণ, লালন ও অব্যাহত চর্চা সময়ের দাবি।
আজ অতীতের সেই সোনালি দিনগুলোর দিকে যখন ফিরে তাকাই, স্মৃতির পাতায় দেখি- সেদিনের ছাত্রলীগ ছিল বাংলার গণমানুষের অধিকার আদায়, মুজিবাদর্শ প্রতিষ্ঠার ভ্যানগার্ড। আমি ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলাম বলে গর্ব বোধ করি। সংগঠনের কর্মী হিসেবে ছাত্রলীগ আমাকে মুজিবাদর্শ ধারণ করে রাজনীতি করার পথই শুধু উন্মুক্ত করে দেয়নি; সেই সঙ্গে দেশসেবা ও দেশ গঠনের মহতী কর্মে আজীবন প্রয়াসী থাকার সুযোগ অবারিত করে দিয়েছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে আজ একটি কথাই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে- এ সংগঠনের অতীত গৌরবময়। এর বর্তমানকে করে তুলতে হবে আরও তাৎপর্যপূর্ণ; আর ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের গড়ে তুলতে হবে প্রতিশ্রুতিশীল হিসেবে। ছাত্রসমাজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক নির্লোভ, ত্যাগী শক্তি বলে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রী মহল তাদের ভাবমূর্তি নষ্টের নানা ষড়যন্ত্র করেছে। দু’বারের সামরিক শাসন মাদক, অস্ত্র আর অর্থ ঢেলে ছাত্রসমাজের চরিত্র হননের চেষ্টা করেছে। আমি বিশ্বাস করি, ছাত্রলীগসহ অপরাপর সমমনা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন এই কুৎসিত ষড়যন্ত্র থেকে নিজেদের রক্ষা করে, ছাত্র আন্দোলনের সুমহান ঐতিহ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে।
তোফায়েল আহমেদ: আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
[email protected]
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।