জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মৃত্যুর মিছিলে চলছে স্বজন হারানোর হাহাকার। উপস্থিত মানুষের চোখে-মুখে বিরাজ করছে অজানা আতঙ্ক। ওয়ার্ড থেকে আইসিইউ-সর্বত্রই স্বজনের ছোটাছুটি। চিকিৎসকরা নিরলস কাজ করে গেলেও কোনো আশার বাণী শোনাতে পারছেন না। ছোট ছোট শিশু শিক্ষার্থীর আর্তনাদে সেখানকার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। নিয়মিত বিরতি দিয়ে পোড়া শিশুদের মৃত্যুর সংবাদে সবাইকে বিচলিত করে ফেলছে।
মঙ্গলবার আরও তিনজনকে নতুন করে ভর্তি করা হয়েছে। বিকাল পৌনে ৪টা পর্যন্ত বার্ন ইনস্টিটিউটে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভর্তি আছে ৪৮ জন। আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে ৬ জনকে। লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে ৩ জনকে। পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে ভর্তি ২০ জন। তবে ২৩ জনের অবস্থাই সংকটাপন্ন। মঙ্গলবার দিনভর বার্ন ইনস্টিটিউট ঘিরে ছিল শত শত মানুষের জটলা। তাদের বেশির ভাগই রোগীর স্বজন। ভেতরে ঢুকতে না পেরে তারা বাইরে দাঁড়িয়ে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
মঙ্গলবার বিকাল পৌনে ৪টা পর্যন্ত যারা মারা গেছে, তাদের মধ্যে ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সি ৮ জন। তারা হচ্ছে-তানভীর, আফরান ফায়াজ, এবি শামীম, সায়ান ইউসুফ, বাপ্পি, এরিকশন, আরিয়ান ও নাজিয়া। বাকি দুজন শিক্ষিকা-মাহেরীন চৌধুরী (৪৬) ও মাসুকা (৩৭)। দুপুরের দিকে হাসপাতালে ঢুকতেই দেখা যায়, স্বজনদের কেউ দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছেন। কারও দুই চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। কেউ আবার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যান্ডেজ করা শিশুকে কোলে নিয়ে অঝোরে কেঁদে চলছেন। কেউ আবার হারিয়ে যাওয়া শিশু শিক্ষার্থীর রক্তমাখা ব্যাগ ও টিফিন বাক্স আঁকড়ে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। কে কাকে সান্ত্বনা দেবেন একসঙ্গে এত পোড়া রোগী দেখে সবাই যেন স্তম্ভিত ও বাক্হারা।
কথা হয় জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ডা. নাসির উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন আরও ২২-২৩ জন। তাদের মধ্যে ৯-১০ বছরের ফুটফুটে শিশুও রয়েছে। চিকিৎসক থেকে নার্স, হাসপাতালের কর্মী-সবাই সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বিশ্বমানের সাপোর্টও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দগ্ধদের অবস্থা এতই ভয়াবহ যে, অনেককেই বাঁচানো সম্ভব হবে না। অনেকেই শতভাগ পোড়া শরীর নিয়ে ভর্তি আছেন।
যাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক শাওন বিন রহমান জানান, সোমবার রাত ২টা ২০ মিনিটে এরিকশনের মৃত্যু হয়। তার শরীরের ১০০ শতাংশ দগ্ধ ছিল। এর ১০ মিনিট পর রাত ২টা ৩০ মিনিটে আয়ানের মৃত্যু হয়, তার শরীরের ৯৫ শতাংশ দগ্ধ ছিল। নাজিয়াও মারা যায় রাতে এবং তার শরীরের ৯০ শতাংশ দগ্ধ ছিল। সায়ান ইউসুফের শরীরের ৯৫ শতাংশ দগ্ধ ছিল। ভোর ৫টার দিকে তার মৃত্যু হয়েছে। বাপ্পির মৃত্যু হয় রাতেই, তার শরীরের ৪০ ভাগ পুড়ে গেছে। শিক্ষিকা মাসুকার ও মাহেরীনের মৃত্যও হয় রাতে। তাদের শরীর ৮০-৮৫ শতাংশ দগ্ধ ছিল।
ইংলিশ ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. মাহতাব রহমান ভূঁইয়ার (১৫) শরীরের প্রায় ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। সে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।
কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার রাজামেহার ইউনিয়নের চুলাশ ভূঁইয়াবাড়ির মো. মিনহাজুর রহমান ভূঁইয়া ও নাসরিন আক্তারের একমাত্র ছেলে মাহতাব। তারা ঢাকার উত্তরায় বসবাস করেন। প্রতিদিন মাহতাবকে স্কুলে নিয়ে যেতেন তার বাবা। বাবা মিনহাজুর রহমান বলেন, আমার একমাত্র ছেলে। নিজেই স্কুলে নিয়ে যেতাম, আনতাম। এই সন্তানকে ঘিরেই আমাদের পুরো পরিবারের স্বপ্ন। মাহতাব মাইলস্টোন স্কুলের ৭ম শ্রেণিতে পড়ত। ক্লাসে সে প্রথম হতো। তার রোল নম্বর ১।
ছেলেকে যখন স্ট্রেচারে তোলা হচ্ছিল, তখন চিনতেই পারিনি। চিকিৎসকরা বলেছেন, তার শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। ঘটনার পর খেকে এখনো জ্ঞান ফেরেনি। আমার একমাত্র ছেলের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। মানুষের দোয়ায় আমার ছেলেকে যেন ফিরে পাই। ছেলে যেন আমার বুকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। ১০ বছরের শিশু নাজিয়ার মৃত্যু হয়েছে সোমবার রাত ৩টায়। শিশুটির লাশ বের করা হয় ভোরে। অপরদিকে তারই ছোট ভাই রাফি এখনো বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। সোমবার দুজনকেই এখানে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার এ দুই সহোদরের বাবা আশরাফুল ইসলাম নীরবের বন্ধু আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাজিয়া ও নাফি মা-বাবার সঙ্গে উত্তরার কামারপাড়া এলাকায় থাকত।
এদিকে মঙ্গলবার ভোর থেকে ইনস্টিটিউটে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রোগী, আত্মীয় এবং স্টাফ ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি সেনাবাহিনীর অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতে পারছেন না সাংবাদিকও। ইনস্টিটিউটের প্রধান ফটকের সামনে আনসার সদস্য এবং প্রবেশমুখে সেনাসদস্যদের কড়া নিরাপত্তায় দেখা গেছে। জনসমাগম সামাল দিতে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে কর্তৃপক্ষ। ইনস্টিটিউটে প্রবেশে কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও পরিচয়পত্র দেখাতে হচ্ছে। রোগীর স্বজনদেরও জানাতে হচ্ছে রোগীর নাম এবং কোন ওয়ার্ডে আছে। পরিচয় নিশ্চিত হলেই মিলছে প্রবেশাধিকার।
সিঙ্গাপুরের চিকিৎসক টিম ঢাকায় : এদিকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেছেন, আহতদের চিকিৎসায় মঙ্গলবার রাতেই সিঙ্গাপুর থেকে আসছে চিকিৎসক টিম। তিনি বলেন, ‘এই হাসপাতালের সঙ্গে এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) আছে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে, হাসপাতাল থেকে তাদের কেস রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। তাদের একজন সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও দুজন নার্স মঙ্গলবার রাতে এসে পৌঁছবেন। বুধবার থেকেই তারা এই (চিকিৎসক) টিমে জয়েন করতে পারবেন।’
বার্ন ইনস্টিটিউটে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা : বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসার খোঁজ নিতে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে যান স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে ইনস্টিটিউটে পৌঁছান তিনি। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান তাকে ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখান এবং দগ্ধদের চিকিৎসা, সেবার মান ও অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।