বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রতিদিন ধরা পড়ছে প্রচুর ছোট মাছ। এর বড় একটি অংশ বিশেষ করে পোয়া মাছ দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত থেকেছে। রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ, গুণগতমানের অনিশ্চয়তা আর ন্যায্য বাজারমূল্যের অভাবে এই মাছগুলো প্রায়শই অপচয়ের শিকার হয়।
তবে এবার সেই মাছ দিয়েই তৈরি হচ্ছে ‘সুরিমি’ এক ধরনের মাছের পেস্ট। যা বিশ্বজুড়ে ফিশ বল, সি-ফুড সসেজ, ইমিটেশন ক্র্যাবের মতো জনপ্রিয় খাবারের মূল উপাদান। এখনো অনেকের কাছে অচেনা হলেও, এই ‘সুরিমি’ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে নতুন সম্ভাবনাময় এক সংযোজন। উপকূলীয় এলাকায় ছোট ট্রলার ও নৌকা থেকে প্রতিদিনই ধরা পড়ে পোয়া মাছ। কিন্তু এই মাছ বাজারে বিক্রির পরিবর্তে দীর্ঘদিন ধরে শুকনো মাছ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এতে যেমন পচন ও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তেমনি দরিদ্র জেলেরা পান না ন্যায্যমূল্য।
এই সমস্যার টেকসই সমাধানে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) কোষাধ্যক্ষ ও প্রকল্পের প্রধান প্রফেসর ড. মো. কামালের নেতৃত্বে এবং প্রকল্পের সহকারী গবেষক হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক চয়নিকা পণ্ডিত ও সিভাসুর ফিসারিজ অনুষদের প্রধান প্রফেসর ড. মো. ফয়সালের সহযোগিতায় সাতজন শিক্ষার্থী বেছে নিয়েছেন পোয়া মাছের সুরিমি প্রক্রিয়াকরণ। রোদে শুকানোর পরিবর্তে যদি মাছ থেকে উন্নত প্রক্রিয়ায় সুরিমি তৈরি করা যায়, তাহলে একদিকে পুষ্টিগুণ অক্ষুণম্ন থাকবে, অন্যদিকে বাড়বে বাজার মূল্য। উদাহরণস্বরূপ, যে পোয়া মাছ কাঁচা অবস্থায় কেজি প্রতি ১০০-১২০ টাকা, তা প্রক্রিয়াজাত হয়ে হতে পারে কেজি প্রতি ৮০০-৮২০ টাকার পণ্য।
কারখানায় নতুন দিগন্ত : বাংলাদেশের মাছ প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দীর্ঘদিন ধরে চিংড়ি কেন্দ্রিক। কিন্তু এ শিল্পের একটি বড় অংশ এখন উৎপাদন সক্ষমতার নিচে রয়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখাচ্ছে সুরিমি। কারণ, এটি নতুন পণ্য যুক্ত করার পাশাপাশি বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে। চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় অঞ্চলে পোয়া মাছ সারা বছর সহজলভ্য। এটি সুরিমি তৈরির জন্য আদর্শ মাছ। অর্থাৎ, কাঁচামালের জোগানও নিশ্চিত।
পাইলট প্রকল্পের সফলতা : ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্প (এসসিএমএফপি) ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির (সিভাসু) প্রযুক্তিগত সহায়তায় চালু হয় এই পাইলট প্রকল্প। সেখানে আন্তর্জাতিক মানের সুরিমি তৈরি করে তা দিয়ে ফিশ বল, ফিস বার্গার, ফিস নাগেট, ফিস রুল, সসেজ, ক্র্যাব স্টিক ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই উদ্যোগ শুধু রপ্তানিমুখী শিল্পের পথই তৈরি করেনি, বরং দেশের বাজারেও নতুন খাবারের প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন পথ : শুধু বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান নয়, সুরিমি উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনের মাধ্যমে সুযোগ তৈরি হচ্ছে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্যও। বড় কারখানা থেকে আধা-প্রক্রিয়াজাত সুরিমি সরবরাহ পেলে স্থানীয় নারী-পুরুষরাও গড়ে তুলতে পারবেন ফিশ বল, ফিশ কেক কিংবা স্ন্যাকস তৈরির ছোট কারখানা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকার নারী-তরুণদের কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তার এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।
যেভাবে তৈরি হয় সুরিমি : মাছের মাথা, কাটা ও আবর্জনা বাদ দিয়ে যে অংশ থাকে তা দিয়ে যে পেস্ট তৈরি হয় তাকে সুরিমি বলে। পেস্ট তৈরির জন্য মাছের মাংস ভালোভাবে ধুয়ে কিমা করা হয়। কিমা করার পর মাছের মাংস থেকে প্রোটিন বের করার জন্য আরও কয়েকবার ধোয়া হয়। কিমা করা মাছের মাংসের সাথে চিনি, লবণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান যোগ করে ভালোভাবে মেশানো হয়। এই মিশ্রণটি একটি মসৃণ পেস্টে পরিণত হয়।
পরিবেশ রক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি : এই উদ্যোগ পরিবেশগত দিক থেকেও প্রশংসনীয়। কারণ, এটি বড় মাছের ওপর চাপ কমিয়ে ছোট, কম ব্যবহৃত প্রজাতির মাছের সর্বোচ্চ ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করছে। সেইসঙ্গে সুরিমি কেন্দ্রিক শিল্পের মাধ্যমে মাছ আহরণ ও ব্যবহারে টেকসই চর্চা বাড়ছে। জেলেদের সমবায় গঠনের মতো অংশীদারিত্বমূলক কাঠামো গড়ে উঠলে এ প্রক্রিয়া হবে আরও শক্তিশালী।
সুরিমি মেলা: এই সাফল্যকে উদযাপন ও ছড়িয়ে দিতে গতকাল চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) মৎস্য অনুষদের একটি গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে পোয়া মাছ দিয়ে সুরিমি তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা হয়েছে। সেখানে প্রদর্শিত হয়েছে সুরিমি-ভিত্তিক ছয় ধরনের ফাস্ট ফুড। ছিল সুরিমির ফিস বার্গার, ফিস বল, ফিস নাগেট, ফিস রুল, এতে অংশ নেন উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী, নীতি-নির্ধারক ও গবেষকরা। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প পেতে যাচ্ছে বিশ্ব প্রতিযোগিতার উপযোগী নতুন রূপ। ছোট মাছ, বড় ভাবনা। সুরিমি নিয়ে বাংলাদেশের এই যাত্রা শুধু একটি নতুন পণ্যের সংযোজন নয়- এটি একযোগে অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সময় এখন, সমুদ্রের সম্ভাবনাকে শিল্পে রূপ দেওয়ার।
Optical illusion: কি দেখতে পাচ্ছেন? এটি বলে দেবে আপনার ব্যক্তিত্ব কেমন
প্রকল্পের প্রধান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামাল বলেন, পোয়া মাছের তৈরি সুরিমি বাংলাদেশের মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে এবং ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধি ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার পথ উন্মুক্ত করবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।