মোঃ রাকিবুল ইসলাম: পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বর্তমানে মানুষের অস্তিত্বের উপর হুমকী হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ এ পরিবর্তন জীববৈচিত্র্য, কৃষি, বন, জলাশয়, প্রাণীসম্পদ, এবং মানব স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের মূল কারণগুলো হলো বায়ু ও পানি দূষণ, জলাশয় ভরাট, অপরিকল্পিত বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা, বন উজাড়করণ, উন্মুক্ত স্থানের সংকোচন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পরিবেশের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে।
বাংলাদেশ একটি জলবায়ু সংবেদনশীল দেশ। এ কারণে বর্তমান বিশ্ব-নীতির ‘বৈশ্বিক উন্নয়ন এবং পরিবেশের অবক্ষয় রোধ’ -এ শ্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতসমূহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্প ও কৃষি উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সেবা খাতসহ যাবতীয় আর্থিক কার্যকলাপের মূলে রয়েছে অর্থ। আর এ অর্থই ব্যাংক ও আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে পরিবেশের অবক্ষয় রোধ করে টেকসই ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করণে ব্যাংকিং খাত ‘গ্রীন ব্যাংকিং’ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
‘গ্রীন ব্যাংকিং’ শব্দটি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়। এটি পরিবেশের অবক্ষয় রোধের মাধ্যমে পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার এক নতুন ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা। সাধারণত গ্রীন ব্যাংকিং পরিবেশকে সবুজ রাখার জন্য ব্যাংকিং খাতের প্রচেষ্ঠাকে বোঝায়। ব্যাংকিং পরিসেবা, ব্যবসা বাণিজ্য ও মানব জীবনের দৈনন্দিন কার্যকলাপে এমনভাবে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে থাকে যা পরিবেশ দূষণ হ্রাস করার মাধ্যমে গ্রীন হাউস প্রভাবগুলোকে হ্রাস করে। তাই এ ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সবুজ ব্যাংকিং বা পরিবেশ বান্ধব ব্যাংকিং বা টেকসই ব্যাংকিং ব্যবস্থাও বলে।
প্রথম শিল্প বিপ্লবের পর থেকে পরিবেশকে উপেক্ষা করে যেভাবে শিল্পায়ন হয়েছে, তার ফল বর্তমানে ভোগ করছে সারা বিশ্ব। পরিবেশ নিয়ে হেলাফেলা করায় সমগ্র মানবজাতির জীবনধারা সংকটের মুখে পড়েছে। এজন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে বনায়ন অন্যতম। কিন্তু যে হারে কাগজের চাহিদা বাড়ছে এবং কাগজের যোগান দিতে গিয়ে গাছ কাটা হচ্ছে- তাতে করে এ বনায়ন কার্যক্রম ও প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ঝুঁকির মুখে পড়ছে। গাছ বাঁচাতে এবং পরিবেশের ক্ষতি প্রশমনে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই কাগজবিহীন অফিসিয়াল কার্যক্রমটি বেশ সাড়া ফেলে। ব্যাংকিং খাতও পরিবেশগতভাবে টেকসই এবং সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ বিনিয়োগকে উন্নীত করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে মধ্যবর্তী ভূমিকা পালন করছে।
গ্রীন ব্যাংকিংয়ের ধারণাটি পশ্চিমা দেশগুলিতে বিকশিত হয়েছিল। পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে ২০০৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রীন ব্যাংকিং শুরু হয় । তারপরে নিরক্ষীয় নীতিমালা (ইপি) চালু করা হয়েছিল। প্রথমে কিছু শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক ব্যাংক যেমন- সিটিগ্রুপ ইএনসি, রয়্যাল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ড, ওয়েস্টপ্যাক ব্যাংকিং কর্পোরেশন এ নীতি গ্রহণ করেছিল। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্য ক্রিস ভ্যান হোলেন মার্কিন সরকারের মালিকানাধীন গ্রীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গ্রীন ব্যাংক আইন চালু করেন । এটি প্রবর্তনের পরে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ছিল ব্যাংকিংয়ের কাজগুলিতে কাগজের ব্যবহার হ্রাস করা, কারণ কাগজ তৈরীতে কাঁচামাল হিসাবে গাছের প্রয়োজন। যা প্রাকৃতিকভাবে এটি অক্সিজেন হ্রাস করে এবং কার্বনকে নিঃসরণকে বাড়িয়ে তোলে ।
গ্রীন ব্যাংকিং বা সবুজ ব্যাংকিং অনুশীলনের দুটি উপায় রয়েছে। একটি হলো ইন-হাউস গ্রীন ব্যাংকিং, যেমনঃ অনলাইন ব্যাংকিং, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকের ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন এবং উচ্চ মাইলেজ যানবাহন ব্যবহার, শব্দ দূষণ হ্রাস, হোম অফিস, শারীরিক বৈঠকের পরিবর্তে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের জন্য ওয়েবক্যাম ব্যবহার, অনলাইন বিবৃতি, ই-মেইল করার নথিগুলি অভ্যন্তরীণ গ্রীন ব্যাংকিংয়ের অন্তর্ভুক্ত । আরেকটি হল সবুজ বিল্ডিং, ফরেস্টেশন, সবুজ গ্রকল্পের অর্থায়ন যেমন বায়োগ্যাস প্লান্ট, সোলার / রিনিউয়েবল এনার্জি প্লান্ট, বায়োসার প্লান্ট, এফ্লয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) ইত্যাদির প্রকল্প, নির্দিষ্ট সবুজ প্রকল্পে কাজ করা, ব্যাংকের স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম ইত্যাদি ।গ্রীন ব্যাংকিং নবায়নযোগ্য, অ-নবায়নযোগ্য, মানবিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের দক্ষ ব্যবহারের পাশাপাশি অর্থায়ন করার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষায় এবং জলবায়ু পরিবর্তন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে । মূলতঃ গ্রীন ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূল লক্ষ্যই পরিচালিত হয় জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রার ১৭ টি লক্ষ্য আর্জনকে বিবেচনা করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে ২০১৩ সালে সমস্ত তফসিলী ব্যাংক তাদের নিজস্ব গ্রীন ব্যাংকিং নীতি এবং গ্রীন ব্যাংকিং ইউনিট তৈরী করেছে। পরিবেশগত ঝুকিহ্রাসে তখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলি ১০,৮৬৮টি প্রকল্পে ৭,৯৩,৫৬১.২৫ মিলিয়ন টাকা বিতরন করেছিল। ২০১২ সালে ব্যাংকগুলি গ্রীন ফাইন্যানসিং-এ ২,০০,৯২১.৫৩ মিলিয়ন টাকা বিতরণ করার উদ্যোগ গ্রহন করে। ব্যাংকগুলি গ্রীন ব্যাংকিং কার্যক্রম এবং সবুজ প্রকল্পগুলোতে কর্পোরেট সামিাজিক দায়বন্ধতা হিসাবে ২৫৮.৮৯ মিলিয়ন টাকা ব্যবহার করে এবং ৯০.৪২ মিলিয়ন টাকা ব্যবহার করে গ্রীন মার্কেটিং প্রশিক্ষণ ও বিকাশে মনোনিবেশ করে। ইতোমধ্যে সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকগুলির সবকয়টি শাখায় সম্পূর্ণভাবে অনলাইন ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও এসএমএস ব্যাংকিং চালু করেছে।
বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিএ, জাইকার মত বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলি পরিবেশগত প্রভাব মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক গাইড লাইন অনুসরণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারে, বাংলাদেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক ইতোমধ্যে গ্রীন ব্যাংককে অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের পাশাপাশী গ্রীন প্রকল্পেও অর্থায়ন জোরদার করেছে, যা আমাদের দেশের জন্য কল্যাণকর।
প্রায় দশ বছর ধরে গ্রিন ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশ। মূলত দুটি মূল উদ্দেশ্য সামনে রেখে চলছে গ্রিন ব্যাংকি কার্যক্রম। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য থেকে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ মাস অবধি দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৩ হাজার ৮১৩টি শাখার মধ্যে ৮৩টি শাখার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে। এছাড়া এসব ব্যাংকের ৩৭০টি এটিএম বুথের মধ্যে সৌরশক্তি নির্ভর বুথ মাত্র ৪টি।
গ্রিন ব্যাংকিংয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকের অবস্থা কিছুটা সন্তোষজনক। দেশের প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর ৫ হাজার ৬০৮টি শাখার মধ্যে ৬১২টি শাখার কারগরি কার্যক্রমে সৌরবিদ্যুত ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া এসব ব্যাংকের ৯ হাজার ৫৮৬টি এটিএম বুথের মধ্যে ২০৬টি বুথ সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। দেশের সামগ্রিক হিসাব থেকে দেখা যায়, ১১ হাজার ২২টি ব্যাংকের শাখার মধ্যে সৌরবিদ্যুতে চালিত ৭০২টি ও ১০ হাজার ১৮১টি এটিএম বুথের মধ্যে ২১৪টি বুথ সৌরবিদ্যুতশক্তি ব্যবহার করে পরিচালিত হচ্ছে।
সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো পিছিয়ে থাকলেও এগিয়ে গেছে অনলাইন ব্যাংকিং কার্যক্রম। বিশেষ করে মোবাইল ব্যাংকিং এতে করে ব্যাংকে না গিয়ে কোনো ধরনের কাগজের ব্যবহার না করে, নিজের হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল ফোন দিয়ে চলছে লেনদেন, টাকা ট্রান্সফার, ই-স্টেটমেন্ট আদায় থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক অনেক কাজ। দিনকে দিন ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে বাড়ছে গ্রাহক সংখ্যা।
মূলত দেশের তরুণ সমাজের কাছে মোবাইল ব্যাংকিং ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং দিনকে দিন জনপ্রিয়তা লাভ করছে। এছাড়া স্মার্টফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি, ব্যাংকিং অ্যাপগুলোর কার্যক্রম সাবলীল হওয়া, নানা ধরনের বিল পরিশোধ ও টাকা ট্রান্সফারের সুবিধা পাওয়ার ফলে কাগজবিহীন এ ব্যাংকিং সেবাকে এরইমধ্যে সফল বলা যায়।
দ্য কনজারভেশনের তথ্যমতে, কেবল কাগজ তৈরির জন্য সারা বিশ্বে প্রতিদিন ১ লাখেরও বেশি গাছ কাটা হয়। ১ টন কাগজ তৈরিতে গড়ে ২৪টি গাছের প্রয়োজন হয়। যেভাবে দিনকে দিন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে, এতে করে কাগজের চাহিদা মেটাতে এ হারে গাছ কাটতে থাকলে পৃথিবীর অনেকাংশ বিরানভূমিতে পরিণত হবে, যা সামগ্রিক পরিবেশের জন্য আশঙ্কাজনক। এক্ষেত্রে কাগজবিহীন কাজের সংস্কৃতি তৈরিতে গ্রিন ব্যাংকিংকে একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ বলছেন সংশ্লিষ্ট পরিবেশবিদরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।