মো. রাকিবুল ইসলাম, নিউ ইয়র্ক থেকে : জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফোরামে ভাষণ দেওয়া ও বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব পালন করা নতুন কিছু নয় ড. ইউনূসের জন্য। তবে এবারের সাধারণ অধিবেশনে তাঁর অংশগ্রহণ জাতিসংঘের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। সবকিছু ঠিক থাকলে এবার যুক্তরাষ্ট্রে নতুন রূপে দেখা যাবে বিশ্ব-বরেণ্য এ ব্যক্তিত্বের। এবার কোনো অতিথি বক্তা হিসেবে নয় বরং দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে তুলে ধরবেন তিনি।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে নতুন এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে যাচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার সফর ঘিরে জাতিসংঘে নতুন দৃশ্যের অবতারণা হতে চলেছে। আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে শুরু করে বিশ্বনেতাদের নজর থাকবে বিশ্ব বরেণ্য এ অর্থনীতিবিদের দিকে। তার মুখ থেকে নতুন বাংলাদেশের কথা শুনবে বিশ্ব।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ অধিবেশন ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। বেশিরভাগ বিশ্বনেতারা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় আজ রাত সাড়ে ১০টায় জেএফকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করেছেন ড. ইউনূস। আগামীকাল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করার কথা রয়েছে তাঁর।
সূচি অনুযায়ী, ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে ভাষণ দেবেন ড. ইউনূস। তার ভাষণ ঘিরে রয়েছে সমগ্র বিশ্ব-নেতাদের আগ্রহ। কারণ, বাংলাদেশে হওয়া ইতিহাসের বিরলতম ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নজর ছিল সারা বিশ্বের। যে গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে একনায়কতন্ত্র চালানো শেখ হাসিনার।
জানা গেছে, জাতিসংঘের অধিবেশনে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা তুলে ধরবেন প্রধান উপদেষ্টা। একই সঙ্গে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্র মেরামতের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রম বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করবেন তিনি।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সারাবিশ্বেই জনপ্রিয় ও পরিচিত এক মুখ। তার ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ তত্ত্ব আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এর আগে তিনি জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন নামি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ভাষণ দিয়েছেন ইউএস সিনেটসহ অনেক রাষ্ট্রের আইনসভায়। তবে এবারের জাতিসংঘ অধিবেশন সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ, তিনি হাজির হয়েছেন সরকারপ্রধান হিসেবে। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান ও সংস্থার প্রধান নিজ থেকে ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
কর্মকর্তারা আরও জানান, মূল অধিবেশনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি সাইট ইভেন্টে যোগ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। বিভিন্ন সংস্থার প্রধান ও রাষ্ট্র প্রধানের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা রয়েছে। সফর খুবই সংক্ষিপ্ত হওয়ায় অনেকের সঙ্গে তার বৈঠক সম্ভব হবে না। তবে এবার জাতিসংঘে সবার নজর যে তার দিকে থাকবে সেটা আগে থেকেই আঁচ করা যাচ্ছে।
তারা বলছেন, জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার আন্দোলন সারা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে। গত ৫০ বছরে এমন ছাত্রবিক্ষোভ বিশ্ববাসী দেখেনি। তাই এবার জুলাই বিপ্লব নিয়ে ইউনূসের মূখ থেকে শুনতে আগ্রহী বিশ্বনেতারা।
নিউ ইয়র্কের কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, ৩০ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধানের সঙ্গে অধিবেশনের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে ইউনূস-বাইডেন বৈঠকের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। এ কারণেই ২৪ সেপ্টেম্বরের পরিবর্তে ড. ইউনূস আজ (২৩ সেপ্টেম্বর) নিউ ইয়র্কে এসেছেন।
সাধারণত জাতিসংঘ অধিবেশনে নির্ধারিত বক্তৃতার দিন সকালে নিউ ইয়র্কে পৌঁছান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তিনি সেদিন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতা দেন। এরপর বিকেলে অধিবেশনে আগত রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করেন।
সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলার ফাঁকে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দ্বিপক্ষীয় সাক্ষাৎ প্রায় বিরল। অতীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সবসময় সংবর্ধনায় দেখা হয়েছে বা কথা হয়েছে। গত তিন দশকে জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের কোনো শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কোনো বৈঠক হয়নি, যা এবার হতে যাচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সম্মানের। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল গত ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফর করে গেছে। তার দুই সপ্তাহের মাথায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বৈঠক করতে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে।
এ ছাড়া, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিরা। আর্থিক, সাংবিধানিকসহ বিভিন্ন খাতের সংস্কারসহ বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত, নিউ ইয়র্কের আসন্ন বৈঠক তারই ইঙ্গিত বহন করছে।
জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক বিগত তিন দশকে হয়নি। এটা নিঃসন্দেহে সম্মান ও গৌরবের।
তিনি আশা করেন, নতুন বাংলাদেশ ঘিরে ড. ইউনূসের চিন্তাভাবনা, রাষ্ট্র সংস্কারের ভাবনা সেখানে স্থান পাবে। এটা অবশ্যই দেশের জন্য গর্ব করার মতো একটা ঘটনা। বাইডেন-ইউনূসের এই বৈঠকে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বনেতারাও নজর রাখবেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
জো বাইডেন ছাড়াও তিনদিনের সংক্ষিপ্ত এই সফরে প্রফেসর ড. ইউনূস বিভিন্ন সংস্থার প্রধান ব্যক্তি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক।
এ ছাড়া, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গেও দেখা করার কথা রয়েছে তার।
ইউনূসের সঙ্গে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি, বাহরাইনের ক্রাউন প্রিন্স হামাদ বিন ইসা আল খালিফা, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক শফ, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম খান, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক সামান্থা পাওয়ার, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মহাপরিচালক গিলবার্ট এফ. হংবোসহ জাতিসংঘের আরও অনেক সংস্থার প্রধান ড. ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
সফরের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম বলেন, জাতিসংঘে নিঃসন্দেহে বিশ্বনেতাদের নজর কাড়বেন ড. ইউনূস। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা সংস্থারা যেভাবে এগিয়ে আসছেন তা বিস্ময়কর। তারা বাংলাদেশের সংস্কার ও রাষ্ট্র মেরামতে সাহায্যের আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
শফিকুল আলম বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, আর্থিক খাত ও প্রশাসনিক রিফর্ম বা সংস্কার করতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন হয়। এসব সংস্কারে বিশ্ব ব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থা আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে।
‘সংস্কার মিশন’ সম্পন্ন করতে ড. ইউনূসের পাশে থাকার ঘোষণা সেনাপ্রধানের
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।