জানাজার নামাজ পড়ার নিয়ম: মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত
জানাজার নামাজ ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজে কিফায়া ইবাদত, যা একজন মুসলমান মারা গেলে বেঁচে থাকা মুসলমানদের পক্ষ থেকে আদায় করা হয়। এই জানাজার নামাজ মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাত, দয়া এবং জান্নাত কামনার একটি সম্মিলিত দোয়া। চার তাকবিরবিশিষ্ট এই নামাজে রুকু বা সেজদা না থাকলেও প্রতিটি তাকবিরের পর নির্দিষ্ট দোয়া পড়া হয়—যেমন: প্রথম তাকবিরের পর ‘সানা’, দ্বিতীয় তাকবিরের পর ‘দরূদ শরীফ’, তৃতীয় তাকবিরের পর মৃতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং চতুর্থ তাকবিরের পর সংক্ষিপ্ত দোয়া শেষে সালাম। একজন মুসলমানের মৃত্যুর পর জানাজার নামাজের নিয়ম মেনে নামাজ পড়া তার প্রতি জীবিতদের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব।
জানাজার নামাজ কিভাবে পড়তে হয় তা জানা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি একজন মুসলিম ভাই বা বোনের প্রতি শেষ বিদায় জানানো এবং আখিরাতের মঙ্গল কামনার একটি উপায়। জানাজার নামাজের দোয়া শুধুমাত্র মৃতের জন্য নয়, জীবিতদের জন্যও শিক্ষা ও নসিহতের উৎস। এটি সমাজে পারস্পরিক সহানুভূতি, দয়া এবং ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলে। জানাজার নামাজের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ একত্রিত হয়ে মৃতের জন্য প্রার্থনা করে, যা ইসলামের সামাজিক ও আত্মিক বন্ধনের একটি চমৎকার উদাহরণ। যারা জানাজার নামাজের নিয়ত, দোয়া ও নিয়ম ভালোভাবে জানেন, তারা মৃত্যুর বাস্তবতা উপলব্ধি করে আরও সৎভাবে জীবন পরিচালনায় সচেষ্ট হন।
Table of Contents
জানাজার নামাজ কী এবং এর গুরুত্ব
‘জানাজা’ শব্দটি মূলত মৃতদেহকে বোঝায়, এবং ‘সালাতুল জানাজা’ হল মৃত মুসলিমের জন্য আদায়কৃত বিশেষ নামাজ। এটি ফরজে কেফায়া, অর্থাৎ সমাজের কিছু লোক এই নামাজ আদায় করলেই বাকি সবাই দায়মুক্ত হয়। তবে কেউই না পড়লে, গোটা সমাজই গুনাহগার হয়।
এই নামাজ আল্লাহর কাছে মৃতের মাফ চেয়ে নেওয়ার সুযোগ। এটিতে কুরআন তেলাওয়াত হয় না, বরং চারটি তাকবির, দরুদ শরীফ ও দোয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
আমরা বিস্তারিত নিয়মগুলো নিচে তুলে ধরলাম, যা জানাজার নামাজ পড়ার নিয়ম শিখতে আগ্রহীদের জন্য চমৎকার গাইড।
জানাজার নামাজের আগে-পরে করণীয়
- গোসল ও কাফন: জানাজার পূর্বে মৃত ব্যক্তিকে গোসল ও কাফন দিতে হবে।
- পরিচয়: মৃত ব্যক্তি মুসলিম কিনা নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
- দাফনের প্রস্তুতি: জানাজার নামাজ শেষে কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে দাফন কার্য সম্পন্ন করতে হবে।
- মাগফিরাতের দোয়া: দাফনের পর মাগফিরাত কামনার দোয়া করা উত্তম।
জানাজার নামাজের নিয়ত (আরবি):
نَوَيْتُ أَنْ أُصَلِّيَ عَلَى هَذَا الْمَيِّتِ أَرْبَعَ تَكْبِيرَاتٍ للهِ تَعَالَى
জানাজার নামাজের নিয়ত (বাংলা উচ্চারণ):
নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া আলা হাযাল মাইয়্যিতি আরবাআ তাকবিরাতিল্লাহি তা‘আলা।
জানাজার নামাজের নিয়ত (বাংলা অর্থ):
আমি নিয়ত করেছি আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে এই মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজ চার তাকবিরের মাধ্যমে আদায় করব।
জানাজার নামাজ পড়ার নিয়ম: ধাপে ধাপে
জানাজার নামাজে কোনো রুকু বা সিজদা নেই, এটি শুধুমাত্র দোয়া নির্ভর নামাজ। নিচে ধাপে ধাপে এর নিয়ম ব্যাখ্যা করা হল:
- নিয়ত (Niyyah): মনে মনে এই নিয়ত করুন: “আমি এই মৃত মুসলিম ভাই/বোনের জানাজার নামাজ আদায় করছি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।”
- প্রথম তাকবির: ইমাম বলবেন “আল্লাহু আকবার”, আপনিও বলবেন এবং কানে পর্যন্ত হাত তুলে বুকের ওপর হাত বাঁধবেন। এরপর পড়বেন সানা/সুবহানাকা:
সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা, ওয়া তাআলা জাদ্দুকা, ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।
- দ্বিতীয় তাকবির: এবার হাত না তুলে “আল্লাহু আকবার” বলুন এবং দরুদ ইব্রাহিমি পড়ুন:
আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আ-লি মুহাম্মাদ…
- তৃতীয় তাকবির: আবার “আল্লাহু আকবার” বলে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করুন। পুরুষের জন্য দোয়া হবে:
আল্লাহুম্মাগফির লাহু ওয়ারহামহু… (মেয়ের জন্য হবে ‘লাহা’)
- চতুর্থ তাকবির: “আল্লাহু আকবার” বলুন এবং সংক্ষিপ্ত দোয়া করে ডান ও বাম দিকে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করুন।
জানাজার নামাজে পড়ার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দোয়া:
প্রথম তাকবিরের পর — সানা দোয়া (সুবহানাকাল্লাহুম্মা):
আরবি:
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ، وَتَعَالَى جَدُّكَ، وَلَا إِلٰهَ غَيْرُكَ
বাংলা উচ্চারণ:
সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়াবিহামদিকা, ওয়াতাবারাকাসমুকা, ওয়াতায়ালা যাদ্দুকা, ওয়ালা ইলাহা গাইরুক।
বাংলা অর্থ:
হে আল্লাহ! আপনি পবিত্র, সমস্ত প্রশংসা আপনার জন্য, আপনার নাম বরকতময়, আপনার মহত্ত্ব মহান, আর আপনার ছাড়া কোনো ইলাহ (উপাস্য) নেই।
দ্বিতীয় তাকবিরের পর — দরূদ শরীফ (দরূদ ইবরাহিম):
আরবি:
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَىٰ مُحَمَّدٍ وَعَلَىٰ آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَعَلَىٰ آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ.
اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَىٰ مُحَمَّدٍ وَعَلَىٰ آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَعَلَىٰ آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ.
বাংলা উচ্চারণ:
আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিন ওয়া ‘আলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা সাল্লাইতা ‘আলা ইবরাহিমা ওয়া ‘আলা আ-লি ইবরাহিম, ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।
আল্লাহুম্মা বারিক ‘আলা মুহাম্মাদিন ওয়া ‘আলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা বারক্তা ‘আলা ইবরাহিমা ওয়া ‘আলা আ-লি ইবরাহিম, ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।
তৃতীয় তাকবিরের পর — মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া:
যদি মৃত পুরুষ হয়:
আরবি:
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ وَارْحَمْهُ وَعَافِهِ وَاعْفُ عَنْهُ، وَأَكْرِمْ نُزُلَهُ، وَوَسِّعْ مُدْخَلَهُ، وَاغْسِلْهُ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ، وَنَقِّهِ مِنَ الْخَطَايَا كَمَا نَقَّيْتَ الثَّوْبَ الأَبْيَضَ مِنَ الدَّنَسِ، وَأَبْدِلْهُ دَارًا خَيْرًا مِنْ دَارِهِ، وَأَهْلًا خَيْرًا مِنْ أَهْلِهِ، وَزَوْجًا خَيْرًا مِنْ زَوْجِهِ، وَأَدْخِلْهُ الْجَنَّةَ، وَأَعِذْهُ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَعَذَابِ النَّارِ
বাংলা উচ্চারণ:
আল্লাহুম্মাগফির লাহু, ওয়ারহামহু, ওয়া ‘আফিহি, ওয়া’ফু ‘আনহু, ওয়া আকরিম নুযুলাহু, ওয়া ওয়াস্সি’ মুদখালাহু, ওয়াগসিলহু বিল-মায়ি ওয়া স্যালজি ওয়াল-বারাদি, ওয়া নাক্কিহি মিনাল-খাতায়া কামা নাক্কাইতাস-সাওবাল-আবইযা মিনাদ-দানাস, ওয়া আবদিলহু দারান খাইরান মিন দারিহি, ওয়া আহলান খাইরান মিন আহলিহি, ওয়া জায়ওয়াজান খাইরান মিন জায়ওয়াজিহি, ওয়া আদখিলহুল জান্নাহ, ওয়া আ’যিহি মিন ‘আযাবিল-কাবরি ওয়া ‘আযাবিন-নার।
বাংলা অর্থ:
হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন, দয়া করুন, নিরাপদ করুন, এবং মার্জনা করুন। তার অবস্থান সম্মানিত করুন, কবরকে প্রশস্ত করুন, তাকে পানি, বরফ ও শীতল জল দিয়ে পরিশুদ্ধ করুন। তাকে পাপ থেকে এমনভাবে পরিশুদ্ধ করুন, যেমন সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে পরিষ্কার করা হয়। তাকে তার বাড়ির চেয়ে উত্তম বাড়ি দিন, তার পরিবারের চেয়ে উত্তম পরিবার দিন, তার স্ত্রীর চেয়ে উত্তম স্ত্রী দিন। তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান এবং কবর ও জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।
যদি মৃত নারী হয়:
দোয়ার মধ্যে “لهُ (লাহু)” এর জায়গায় “لها (লাহা)” পড়তে হবে।
চতুর্থ তাকবিরের পর:
একটু দোয়া করে সালাম ফেরাতে হয়, যেমন:
اللهم لا تحرمنا أجره ولا تفتنا بعده واغفر لنا وله
(আল্লাহুম্মা লা তাহরিমনা আজরাহু, ওয়ালা তা’তিন্না বাদাহু, ওয়াগফির লানা ওয়ালাহু)
শিশুদের জানাজার নামাজের দোয়া
যদি মৃত শিশু হয়, তাহলে তার জন্য বিশেষ দোয়া রয়েছে। যেমন, ছেলে শিশুর জন্য:
আল্লাহুম্মাজআলহু লানা ফারাতঁও ওয়া জুখরাঁও ওয়া আজরাঁও…
মেয়েশিশুর জন্য দোয়া হবে ‘হু’ এর পরিবর্তে ‘হা’।
মহিলারা জানাজার নামাজ পড়তে পারবে?
অনেক সময় প্রশ্ন উঠে: নারীরা জানাজার নামাজ পড়তে পারবে কি না? ইসলামী ফিকহ মতে, নারীরা জানাজায় অংশ নিতে পারে, তবে তা আবশ্যিক নয়। সাধারণত পুরুষরা জানাজায় অংশগ্রহণ করে।
তবে নারীদের জানাজার নিয়ম পুরুষদের মতোই, শুধুমাত্র নিয়ত ও দোয়ায় ‘লাহু’ এর জায়গায় ‘লাহা’ ব্যবহার করতে হবে।
জানাজার নামাজে সাধারণ কিছু ভুল ও তার সংশোধন
- তাকবির গুনে ফেলা ভুল। মনোযোগ সহকারে পড়া উচিত।
- সুরা ফাতিহা পড়া আবশ্যক নয়। এটি না পড়লেও নামাজ সহি হবে।
- সালাম ফিরাতে দেরি না করা। ইমামের সাথে সাথে সালাম ফেরাতে হবে।
জানাজার নামাজ পড়ার নিয়ম জানা প্রতিটি মুসলমানের ধর্মীয় দায়িত্ব। এটি মৃত ব্যক্তির প্রতি আমাদের ভালোবাসা, সম্মান ও দোয়া প্রেরণের একটি পবিত্র মাধ্যম। আমরা যেন যথাযথভাবে এই ইবাদত আদায় করতে পারি, সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখাই আমাদের কর্তব্য।
এই বিষয়ে আরও জানতে পড়ুন ইবাদত এবং ধর্ম সম্পর্কিত তথ্য।
প্রশ্নোত্তর (FAQs)
- জানাজার নামাজে সুরা ফাতিহা পড়তে হয় কি?
না, এটি আবশ্যক নয়। সানা, দরুদ ও দোয়া যথেষ্ট। - জানাজার নামাজের রাকাত কত?
রাকাত নেই, এটি চার তাকবিরের নামাজ। - মহিলারা কি জানাজার নামাজ আদায় করতে পারে?
হ্যাঁ, পারবে। তবে এটি তাদের ওপর আবশ্যক নয়। - জানাজার নামাজ কখন পড়া যায় না?
সূর্যোদয়, সূর্য ডোবা ও মধ্যসূর্য কালের সময় নামাজ পড়া নিষেধ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।