বছর শেষ হতে বাকি মাত্র দুই সপ্তাহ। নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিতে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ চলছে বিভিন্ন ছাপাখানায়। তবে প্রাথমিকের বই ছাপা শেষ হলেও মাধ্যমিকের অধিকাংশ বই এখনও ছাপার শুরুর অপেক্ষায়, যা নিয়ে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের শঙ্কা।
নতুন বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মুদ্রণ সংশ্লিষ্টরা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ের ছাপা, বাঁধাই, কাটিং ও প্যাকেজিং—সব মিলিয়ে প্রেসগুলোতে যেন এক মুহূর্তেরও ফুরসত নেই।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য মোট প্রায় ৩০ কোটি পাঠ্যবই ছাপার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি বইয়ের ছাপার কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং সেগুলো ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে পৌঁছাতে শুরু করেছে।
তবে বিপরীত চিত্র মাধ্যমিক পর্যায়ে। মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাধ্যমিকের অধিকাংশ বইয়ের ছাপাই এখনও শুরু করতে পারেনি বেশিরভাগ প্রেস। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দেরির কারণে সময়মতো কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান গতিতে কাজ চললে জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ বই ছাপা শেষ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এনসিটিবি জানায়, মাধ্যমিক ও ইবতেদায়ি স্তরের জন্য মোট ২১ কোটি বই ছাপানোর কথা রয়েছে। এর মধ্যে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ১২ কোটি ৬০ লাখের বেশি বই ছাপানোর জন্য সম্প্রতি বিভিন্ন প্রেসের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি প্রেস মাত্রই এই বই ছাপার কাজ শুরু করেছে।
চুক্তি অনুযায়ী এসব বই ছাপাতে প্রেসগুলো ৫০ দিন সময় পাবে। তবে মুদ্রণ শিল্প সমিতির দাবি, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের প্রথম টেন্ডার বাতিল হওয়ায় পুরো প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হয়েছে। ফলে জানুয়ারির শুরুতে সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছানো কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, সময়মতো পাঠ্যবই না পেলে শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগেই এই সংকট কাটাতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে জাতীয় নির্বাচন, রোজা ও ঈদুল ফিতরের লম্বা ছুটি। তাই জানুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়ার বিকল্প দেখছেন না বিশ্লেষকরা। তবে জানুয়ারির মধ্যে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই পৌঁছে দেওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, পাঠ্যবই ছাপানো যে গতিতে চলছে তাতে জানুয়ারির মধ্যে ২৫ শতাংশ পাঠ্যবইও শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
তবে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ বলছে, জানুয়ারিতেই বই পাবে শিক্ষার্থীরা। এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী গতকাল সোমবার আমার দেশকে বলেন, জানুয়ারিতে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই তুলে দেওয়ার ব্যাপারে আমরা সবাই আশাবাদী।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সায়্যেদা আতিকুন নাহার আমার দেশকে বলেন, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যবই মেইন সোর্স হিসেবে কাজ করে। ফলে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই না পেলে সমস্যা হবেই। এছাড়া শিক্ষার্থীরা বছরের শুরুতে অনেক আগ্রহ নিয়ে নতুন বইয়ের জন্য অপেক্ষায় থাকে, সেটা সময়মতো না পেলে শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়া সমস্যা দেখা দেয়।
তিনি বলেন, সমস্যাটা দীর্ঘদিনের; গুটিকয়েকটি প্রেসের মধ্যে কাজ সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষার বিষয়ে সরকারের তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আমরা বারবার বলে এসেছি শিক্ষা কমিশন গঠনের কথা; কিন্তু তা আজও হয়নি। পৃথিবীর সব যখন এগিয়ে গেছে সেখানে আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কারিক্যুলাম সেই ১৫ বছর আগেরটাই থেকে গেছে। তিনি বলেন, কারো কারো গাফিলতির কারণে যাতে শিক্ষার্থীদের হাতে বইগুলো যেতে দেরি না হয়, সে ব্যাপারে সুষ্ঠু পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আমরা আশা করি।
তবে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান গণমাধ্যমকে বলেন, জানুয়ারি মধ্যে ৭০ শতাংশ বই দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। নরমালি ছাপার কাজের যে গতি আছে তাতে ৪০ শতাংশ বই জানুয়ারিতে যেতে পারে। তবে আমরা সবাই উদ্যোগী হলে, সংকটগুলোর ওপর নজর দিয়ে যদি সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বই যেতে পারে।
তবে সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে পাঠ্যবই ছাপানো ও বিতরণ কার্যক্রমে বড় ধরনের কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। কিছু পাঠ্যবইয়ের ক্ষেত্রে পুনঃটেন্ডারের প্রয়োজন হয়েছিল। তবে, সার্বিক অনুমোদন প্রক্রিয়া এখন সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি বলেন, যে বইগুলো পেন্ডিং ছিল, সেগুলোর জন্য আমরা পুনঃটেন্ডার চেয়েছিলাম। আগের সব অনুমোদনও নিষ্পত্তি হয়েছে। আমরা আশা করছি— সময়মতো বই পাওয়া যাবে। সামান্য কিছু দেরি হতে পারে। তবে, বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটার কথা নয়।
ঠিক কতদিন দেরি হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. সালেহউদ্দিন কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা জানাননি। তবে, তিনি জোর দিয়ে বলেন, সরকার জানুয়ারির মধ্যেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সময়মতো পাঠ্যবই বিতরণে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে কি না এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা এ উদ্বেগকে ‘ভ্রান্ত ধারণা’ আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের সঙ্গে বইয়ের কী সম্পর্ক? নির্বাচন তো বলবে না ‘বই বিতরণ করো না’। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে কিছু প্রশাসনিক কার্যক্রমে বিধিনিষেধ আসে, কিন্তু শিক্ষাসামগ্রী তার মধ্যে পড়ে না।
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, আগের বছরগুলোতেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) দেরিতে বই পৌঁছে দিলেও বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। ড. সালেহউদ্দিন বলেন, শিশুরা জানুয়ারিতেই স্কুলে যায়। এক সপ্তাহ দেরি হলেও ছাত্ররা বই পেয়ে যাবে। আমরাও স্কুলজীবনে দেরিতে বই পেতাম।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



