আবু আজাদ : কাঁচ, কাঁচা চামড়া ও প্লাস্টিক— এমন সব শিল্পপণ্য তৈরি ও সংরক্ষণে ব্যবহৃত ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণ ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার হচ্ছে ‘মেরিডিয়ান চিপস’ ও ‘নুডলস’ তৈরিতে। মেয়াদোত্তীর্ণের কারণে ইতোমধ্যে বিষে পরিণত হওয়া এমন ‘সাইট্রিক অ্যাসিড’ ও ‘নাইট্রিক অ্যাসিড’ দিয়েই তৈরি হচ্ছে ‘বিএসপি ফুড’র কোমল পানীয়।
খাদ্যপণ্যের নামে বিষ খাওয়ানোর এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে সম্প্রতি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকায় র্যাবের পরিচালিত এক অভিযানে। অভিযানের নেতৃত্ব দেন র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু এবং র্যাবের চট্টগ্রাম জোনের সহকারী পরিচালক এএসপি কাজী মো. তারেক আজিজ। খাদ্যের নামে ‘বিষ’ খাওয়ানোর এমন ভয়াল চিত্র উঠে আসে তাদের বর্ণনায়।
শিশুখাদ্যের জন্য জনপ্রিয় মেরিডিয়ান ফুডস লিমিটেড ও বিএসপি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের কারখানায় অনুমোদনহীন পণ্য উৎপাদন, মেয়াদ ছাড়া উপকরণ দিয়ে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরির প্রমাণ মিলেছে। গত শনিবার (৩ অক্টোবর) বিকেলে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকায় এ অভিযান পরিচালিত হয়।
মঙ্গলবার (৬ অক্টোবর) সঙ্গে আলাপকালে প্রতিষ্ঠান দুটির প্রতারণা ও দায়িত্বহীনতার ভয়াবহ বিবরণ তুলে ধরেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই দুই কর্তাব্যক্তি।
গোখাদ্য ও মেয়াদোত্তীর্ণ কাঁচামালে তৈরি মেরিডিয়ানের নুডলস ও চিপস
র্যাবের চট্টগ্রাম জোনের সহকারী পরিচালক এএসপি কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, ‘মেরিডিয়ান ফুডস লিমিটেডের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, তারা খাদ্যপণ্য তৈরিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট (লবণ) ব্যবহার করছিল। অর্থাৎ যেটা কাঁচ, কাঁচা চামড়া ও প্লাস্টিকপণ্য তৈরি এবং গোখাদ্যে ব্যবহার হয়। ওই লবণই মেরিডিয়ানের নুডলস ও চিপসসহ অন্য খাদ্যপণ্য তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছিল। কারখানার পরিবেশ ছিল একেবারেই অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন।’
তিনি আরও বলেন, অভিযানে মেয়াদোত্তীর্ণ প্রায় পাঁচ হাজার কেজি নুডলস জব্দ করা হয়। যা তারা পরবর্তীতে বাজারজাতের জন্য রেখেছিল। এছাড়া এসব পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামালের কোনো মেয়াদ ছিল না।
র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, মেরিডিয়ান ফুডস একটি ব্র্যান্ড। সারাদেশের মানুষ এটি গ্রহণ করে। এই যে চিপস তৈরির যে কাঁচামাল, সেগুলোতে যদি ভেজাল থাকে, তাহলে ভোক্তারা ভালো পণ্য পাবেন— এটা তারা কীভাবে নিশ্চিত করবেন?
মেরিডিয়ানের গুদাম থেকে বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ কাঁচামাল জব্দের বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন তাদের স্টোরেজ হাউজে প্রবেশ করি, তখন মেরিডিয়ানের জেনারেল ম্যানেজার, প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ার, ফুড প্রডিউসার, স্টোর কিপার সবাই ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতেই আমরা সেখানে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য ব্যবহার ও সংরক্ষণের প্রমাণ পাই। মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যের পরিমাণ এমন যে, দেখা গেছে পচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এমনকি তারা বলতেও পারে না যে, আসলে তারা কখন এগুলো সংরক্ষণ করেছিল।’
এ সময় মেরিডিয়ানের প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে নিজের কথোপকথনের বিবরণ তুলে ধরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, ‘যিনি প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ার, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই পচা জিনিসগুলো স্টোর রুমে কেন? তখন উনি বললেন, আমি এটা ঠিক বলতে পারব না, স্টোরম্যান বলতে পারবেন।’
‘আমি বললাম, স্টোরম্যান তো জানবে স্টোরে কী কী আছে। এসব পণ্য কী কী পারপাসে (কাজে) ব্যবহার হবে, সেসব তো তার জানার কথা নয়। স্টোরম্যান তো কোয়ান্টিটি নিয়ে কাজ করবে, তিনি কোয়ালিটি নিয়ে কাজ করবেন কেন? এটা তো ফুড ইঞ্জিনিয়ারের কাজ!’
নির্বাহী মেজিস্ট্রেট বলেন, ‘স্টোরেজ গোডাউনে ১৮ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় যেখানে বিভিন্ন পণ্য সংরক্ষণ করা হয়, সেখানে গিয়ে বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য পেয়েছি। যেগুলো তারা বছরের পর বছর ব্যবহার করছিল। এর মধ্যে কিছু ছিল ২০১৭ ও ১৮ সালের। কিন্তু সেগুলো তারা সংরক্ষণ করছিল খাদ্যপণ্য তৈরিতে ব্যবহারের জন্য। এমন কতগুলো পণ্য তৈরি করছিল যেগুলোর জন্য তারা কোনো ধরনের বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেয়নি।’
তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন রাখেন, ‘তারা দেশের নামিদামি একটা ব্র্যান্ড। সারাদেশের মানুষ তাদের ওপর আস্থা রাখে। সে অবস্থায় তারা এভাবে খাদ্যপণ্য উৎপাদন কাজ কীভাবে পরিচালনা করতে পারে?’
বিএসপি ফুডের পরিবেশ ছিল জঘন্য
এএসপি কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, ‘বিএসপি ফুডের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত জঘন্য। অবস্থা ছিল ভয়াবহ। কর্মীদের ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তো ছিল-ই না। তাদের খাবারগুলোতে অনেক ধরনের পোকামাকড় পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির অনেকগুলো পণ্যের বিএসটিআই লাইসেন্স ছিল না। বিএসপি ফুড টেক্সটাইল কালার অর্থাৎ যেটা জামা-কাপড়ের রঙ হিসেবে ব্যবহার হয় সেগুলো খাদ্যপণ্য তৈরিতে ব্যবহার করছিল। এছাড়া জুতার রঙ, কাঁচের জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত কেমিক্যাল তারা ব্যবহার করছিল খাদ্যপণ্য তৈরিতে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। এ সময় বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যও পাওয়া যায় ওই কারখানাটিতে।’
‘বিষ’ খাওয়াচ্ছে বিএসপি ফুড
র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, ‘বিএসপি ফুডের অবস্থা মেরিডিয়ানের চাইতে আরও খারাপ ছিল। পোড়া তেল এতটাই কালো হয়ে গেছিল যে, এসব যদি মবিলের মতো করে গাড়িতে ব্যবহার করা হয়, তাহলে গাড়িও নষ্ট হয়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করুন, এসব আমাদের লিভারে কী ক্ষতি করবে। মূলত এমন সব খাদ্য উপাদান থেকেই ক্যান্সারের মতো রোগের জন্ম।’
ভয়াবহ তথ্য দিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরও বলেন, ‘বিএসপি ফুড বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স ছাড়াই অনেক খাদ্যপণ্য তৈরি করছিল। অভিযানে বিএসপির গুদামে মিলেছে সাইট্রিক অ্যাসিড ও নাইট্রিক অ্যাসিড; যেসবের মেয়াদ ফুরিয়েছে ২০১৭ সালে।’
পলাশ কুমার বসু বলেন, ‘যেকোনো রাসায়নিকের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে তা স্বাভাবিকভাবেই বিষে পরিণত হয়। অথচ এসব বিষ বিএসপি ফুড তাদের খাদ্যপণ্য তৈরিতে ব্যবহার করছিল।’
খাবারের রঙ মেহেদির চেয়েও গাঢ়
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি শুধু মেয়াদহীন সাইট্রিক অ্যাসিড ও নাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবহার করছিল না। খাদ্যপণ্য তৈরিতে এমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কালার ব্যবহার করছিল যে, সেগুলো পরীক্ষার পর আমি আমার হাত তিনবার লাইফবয় হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ধুই। এরপরও ওগুলো যাচ্ছিল না। অনেকটা মেহেদির কালারের মতো। আমি তাদেরকে বললাম, মেহেদি ব্যবহার করলে কেমন হয়?’
তিনি বলেন, ‘গুড পোর্ট্রেট কালার হালকা পানিতে ধুলে উঠে যায় কিন্তু বিএসপি ফুড তাদের ট্যাংসহ কোমল পানীয় তৈরিতে যেসব কালার ব্যবহার করছিল সেগুলো কোনোভাবেই মানুষের খাবার উপযোগী নয়।’
‘আমি তাদের বললাম, ওষুধের যদি মেয়াদ শেষ হয়ে যায় তাহলে সেটি সরাসরি বিষে কনভার্ট হয়ে যায়, তেমনি এসব অ্যাসিড ও রঙের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সেসব তো আপনি খাদ্যে ব্যবহার করতে পারেন না। এই যে দেখেন, এসব খাওয়ার কারণে আমাদের ক্যান্সার হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের অসুখ-বিসুখ, কিডনির সমস্যা; সবকিছুর মূল কারণ এই ধরনের খাবার।’
অভিযানে নিজের দেখা দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, ‘আমরা দেখি বিএসপি ফুড কারখানার ফ্লোরেই পড়ে আছে টোস্ট বিস্কিট, কাটা নুডলস, দেয়ালে ময়লার আস্তরণ। এভাবেই ফেলে রাখা হয়েছে খাদ্যপণ্য।’
তিনি বলেন, এমন সব গুরুতর অভিযোগে মেরিডিয়ান-কে বিএসটিআই আইনে পৃথকভাবে দুই লাখ টাকা এবং বিএসপি-কে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া নিরাপদ খাদ্য আইনে উভয় প্রতিষ্ঠানকে ২০ লাখ টাকা করেও জরিমানা করা হয়েছে। এ সময় প্রায় পাঁচ মেট্রিক টন নুডলস ও দুই মেট্রিক টন ঘিসহ জব্দ আরও বিভিন্ন পণ্য ধ্বংস করা হয়।
ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, আমরা জেনেছি, এসব প্রতিষ্ঠানকে এর আগেও জরিমানা করা হয়, কিন্তু তারা বদলায়নি। তাই এবার জরিমানার পরিমাণে এমন একটা দাগ কাঁটতে চেষ্টা করেছি, যাতে তারা অবশ্যই পরিবর্তিত হতে বাধ্য হয়। প্রতিষ্ঠান দুটিকে নিজেদের চরিত্র বদলে নিতে দুই মাস সময় দেয়া হয়েছে। সূত্র : জাগো নিউজ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।