জুমবাংলা ডেস্ক : বেশ নাটকীয়ভাবেই উত্থান হয়েছিল গাজীপুর সিটি কর্পেোরেশনের তরুণ মেয়র মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের। সাধারণ এক কৃষকের ঘরে জন্ম নিলেও দ্রুতই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন তিনি। এরপর বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার পরই অগাধ রাজনৈতিক ক্ষমতাও চলে আসে তার দখলে। যার চূড়ান্ত রূপ ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় ব্যানারে মেয়র পদে বিজয়।
জাহাঙ্গীর আলম তরুণ বয়সে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর মাত্র ৩৮ বছর বয়সে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। অভিযোগ আছে, সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদে থেকে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিলেন জাহাঙ্গীর। ক্ষমতা আর বিত্তবৈভবের কারণে কাউকে তোয়াক্কা না করেই নিজের ইচ্ছামতো সিটি ভবন এবং দল চালাচ্ছিলেন তিনি।
তবে জনপ্রতিনিধি হয়েই গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী, আইনের তোয়াক্কা না করেই তিনি কোনোরকম টেন্ডার ছাড়াই মহানগরে শত শত কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণ করেছেন, যাতে দুর্নীতির গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য স্থানীয়দের হাজার হাজার বিঘা জমি নষ্ট করলেও সঠিক ক্ষতিপূরণ দেননি তিনি। অনেকের অভিযোগ, তিনি গাজীপুর সিটির ‘একচ্ছত্র অধিপতি’ হতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
গাজীপুর মহানগরের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কানাইয়া গ্রামে কৃষক মিজানুর রহমানের ঘরে ১৯৭৯ সালে জাহাঙ্গীরের জন্ম। স্কুলজীবনেই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। গাজীপুরের চান্দনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাসের পর ভর্তি হন জেলার ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে। ওই কলেজের ছাত্রদের
বিভিন্ন ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ সময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তিনি পরিচিতি পেয়ে যান। পরে এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সহসভাপতির দায়িত্ব পান।
ছাত্র রাজনীতি শেষে ২০০৯ সালে তিনি গাজীপুর সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। মূলত এখান থেকেই শুরু তার উত্থান পর্ব। শিল্পনগরী গাজীপুরের বিভিন্ন মিল কারখানায় নামে-বেনামে শুরু করেন ঝুট ব্যবসা। আধিপত্য বিস্তারের জন্য তৈরি করেন নিজস্ব বাহিনী। অল্প সময়ের ব্যবধানে জাহাঙ্গীর শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। বিঘার পর বিঘা জমি কেনেন উচ্চ মূল্যে। জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, তার টাকার পরিমাণ তিনি নিজেও জানেন না। হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বহু আগেই।
তবে এলাকায় তিনি পরোপকারী হিসেবে খ্যাত। তার কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ ফেরত যায় না। করোনা মহামারির শুরুতেই চীন থেকে এক লাখ কিট আনেন তিনি। তখনও সরকার কিট আনতে পারেনি। রাষ্ট্র যেখানে ব্যর্থ, জাহাঙ্গীর আলম সেখানে সফল।
আওয়ামী লীগের প্রধান ও দলের শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জাহাঙ্গীর জাতীয় শোক দিবসে মহানগরের ৫৭টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতেই একটি করে গরু দিয়ে কাঙালিভোজের আয়োজন করতেন। এটাকে তার কৌশলের অংশ হিসেবে দেখছেন নেতাকর্মীরা। দ্রুতই জেলার বর্ষীয়ান সব আওয়ামী লীগ নেতাকে পেছনে ফেলে তিনি চলে আসেন সামনের কাতারে। তবে অল্প সময়ে তার এ উত্থান এবং দলের সিনিয়র নেতাদের অবমূল্যায়ন মেনে নেননি দলীয় নেতাকর্মীরা। ফলে এখানকার রাজনীতি বিভক্তির দিকে গড়ায়।
অভিযোগ আছে, বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের লোকজন নিয়ে তিনি দাতব্য সংস্থা ‘জাহাঙ্গীর আলম ফাউন্ডেশন’ গড়ে তুলেছেন। আওয়ামী লীগের ব্যানারে সব কিছু করলেও দলীয় সব নেতাকর্মী সেখানে উপেক্ষিত। ওই সংগঠনে যুক্ত লোকজনের সঙ্গেই তার উঠাবসা ছিল। মহানগরের ৫৭টি ওয়ার্ডেই এ সংস্থার কমিটি রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার সমর্থকরা ‘জাহাঙ্গীর, জাহাঙ্গীর’ বলে স্লোগান দিতেন। সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামও নেওয়া হতো না। অনেকে বলছেন, এই ফাউন্ডেশনের আড়ালে জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছেন। দলকে সুসংগঠিত করার পরিবর্তে তিনি তার নিজের সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন।
মেয়র নির্বাচিত হয়ে নিজের ইচ্ছামতো চালাতে থাকেন সিটি করপোরেশনকে। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম সভাতেই প্যানেল মেয়র নির্বাচিত করার বিধিবিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেন জাহাঙ্গীর। তার মেয়াদের তিন বছর চলে গেলেও এখন পর্যন্ত প্যানেল মেয়র নির্বাচিত করেননি। কয়েকজন কাউন্সিলর অভিযোগ করেন, জাহাঙ্গীর চেয়েছিলেন সবাই তার হুকুমের দাস হবেন।
মেয়র হওয়ার পরে তিনি নিজস্ব উদ্যোগে ৩০০ জনকে ট্রাফিক সহকারী হিসেবে নিয়োগ দান করেন মহানগরে। এভাবে তিনি তথাকথিত ট্রাফিক সহকারীদের হাতে সিটির যানজট নিরসনের দায়িত্ব তুলে দেন এবং ট্রাফিক পুলিশের পেশাদারি কর্তৃত্ব খর্ব করেন। সিটি এলাকার সড়ক-মহাসড়কগুলোর নিয়ন্ত্রণ এভাবে প্রায় পুরোটাই কবজা করে ফেলেন তিনি। এরপর যানজট নিরসনের দোহাই দিয়ে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য সিটিজুড়ে চক্রাকার বাস সার্ভিস ‘তাকওয়া পরিবহন’ চালু করেন। প্রশিক্ষিত ট্রাফিক পুলিশের বদলে তার ট্রাফিক সহকারীরা গোটা মহানগরীর সড়ক-শৃঙ্খলার বারোটা বাজায়। ভয়ে এ বাহিনীর অনাচারের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার সাহসও পাননি কোনো নগরবাসী।
টেন্ডার দেওয়া ছাড়াই মেয়র জাহাঙ্গীর মহানগরে ৮০০ কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণ করেছেন। এতে প্রয়োজন হয়েছে নাগরিকদের প্রায় ৮ হাজার বিঘা জমি। প্রায় ৩১ হাজার ঘরবাড়ি, মসজিদ-মন্দির, কবরস্থান সরিয়ে তিনি এই রাস্তা করেছেন। তবে নগরবাসীর অভিযোগ, রাস্তা নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ না করে তিনি তার ইচ্ছামতো এসব করেছেন। ক্ষতিপূরণ হিসেবে মর্জিমাফিক টাকা দিয়েছেন। অনেকে সে টাকাও পায়নি। তাদের অভিযোগ, ক্ষমতার দাপটে মেয়র তাদের ওপর অত্যাচার করেছেন।
স্থানীয়রা জানান, নাটকীয় উত্থান হলে আকস্মিক পতনের আশঙ্কা থাকে। মেয়র জাহাঙ্গীরের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। তার কারণে বহু মানুষ নিজের জমি হারিয়ে কেঁদেছেন। তাদের অভিশাপ গ্রাস করেছে তাকে।
দল থেকে আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে রিভিউ চাইবেন মেয়র জাহাঙ্গীর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।