জুমবাংলা ডেস্ক: মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ বিধান, ইসলামের মৌলিক ৫ ভিত্তির অন্যতম হলো হজ। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সমর্থ নারী-পুরুষের ওপর হজ ফরজ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর তরফ থেকে সেই সব মানুষের জন্য হজ ফরজ, যারা তা আদায়ের সামর্থ্য রাখে’। (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিধান পবিত্র হজ মুমিন মুসলমানের বসন্তকাল। প্রেমময় ইবাদতের সাড়া। ‘লাব্বাইক’, ‘আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’র ধ্বনিতে মুখরিত হয় কাবা প্রাঙ্গন। চোখের অশ্রুতে ভিজে যায় মুমিনের হৃদয়। ঝরে সকল পাপ পঙ্কিলতা।
হজ ইসলামের এক ঐতিহাসিক বিধান। শতাব্দির পর শতাব্দি নবী রাসূলগণ হজ আদায় করে এসেছেন। হজের সূচনাটাও হয়েছিল এক ঐতিহাসিক নিদর্শনের মাঝ দিয়ে। যে ইতিহাসের জনক নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও বিবি হাজেরা (রা.)। তবে আদি মানব ও মানবী হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) ও হজ পালন করে এসেছেন। হজের কিছু কাজ তাদের অনুকরণে আজও মুসলিম জাতি পালন করে আসছে।
হজের অধিকাংশ নিদর্শনাবলী হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) এর সঙ্গে জড়িত। তবে নবী ইব্রাহিম (আ.) ও স্ত্রীর হাজেরা (রা.) এর কয়েকটি নিদর্শনাবলী ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। হজের বড় নিদর্শনের মাঝে রয়েছে কাবা ঘর।
কাবা ঘর প্রথম নির্মাণ করেছিলেন কে? ফেরেশতাগণ না আদম (আ.)? এ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো মক্কায়, তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী’ (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬)
অনেক মুফাসসির মনে করেন, বসবাস ও ইবাদত উভয় দিক দিয়ে কাবা ছিলো মানবসভ্যতার প্রথম ঘর। ভিন্ন মতে, এটি ছিলো ইবাদতের নিমিত্ত নির্মিত প্রথম ঘর। আদম ও হাওয়া (আ.) দুনিয়ায় অবতরণের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দিগন্তে যাত্রা করেন। অবশেষে মক্কায় তাদের মাঝে মিলন ঘটে। আরাফা, মুজদালিফা, মিনা ও হাজরে আসওয়াদের ইতিহাস তাদের সঙ্গেই সম্পর্কিত। বলা হয়, আরাফায় আদম ও হাওয়ার মাঝে দুনিয়ায় অবতরণের পর প্রথম পরিচয় ঘটে। মুজদালিফায় তাদের মাঝে আলাপ সংঘটিত হয়। মিনায় আদম (আ.) এর আকাংঙ্খা পূর্ণ হয়।
তবে হজের সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ও হৃদয়গ্রাহী গল্পটি হচ্ছে জমজম কূপের ইতিহাস। পবিত্র জমজম কূপের পানি পৃথিবীর সকল পানির চেয়ে উত্তম এবং পবিত্র। কাবাঘরের ইতিহাস ও জমজম কূপ একের সঙ্গে অন্যটি জড়িত। ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা পবিত্র হজ কিংবা পবিত্র ওমরা পালন করার সময় একই কূপ থেকে পানি নিয়ে আসেন। ইসলাম ধর্মে জমজম কূপের পবিত্র পানির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.)। তিনি শিশু ইসমাঈল (আ.)-সহ বিবি হাজেরা (আ.)-কে মক্কায় নির্বাসনে পাঠান, তখন থেকেই জমজম কূপের আবির্ভাব হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.) সিরিয়া থেকে মক্কায় পৌঁছলে বিবি হাজেরা (আ.) এবং দুধের শিশু হজরত ইসমাঈল (আ.)-কে মক্কার মরুভূমিতে রেখে সিরিয়ায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে করেন। তখন এক মশক পানি এবং একটি থলের মধ্যে কিছু খেজুর তাদের কাছে রেখে যান। হজরত হাজেরা (আ.) কয়েকদিন পর্যন্ত সে পানি ও খেজুর খেলেন এবং নিজের কলিজার টুকরা হজরত ঈসমাঈলকে দুধ পান করালেন।
কিন্তু একসময় মশকের পানি ও খেজুর ফুরিয়ে এল। তিনি তখন এক চরম অসহায়তার মধ্যে নিপতিত হলেন। তার শিশু সন্তানটিও ক্ষুধার তাড়নায় ছটফট করতে থাকে। বিবি হাজেরা (আ.) সন্তানের দুর্দশায় তার আদরের দুলালকে দুধ পানে সমর্থ হলেন না। এমতাবস্থায় তৃষ্ণাকাতর মা পানির খোঁজে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দ্রুতবেগে দৌঁড়াতে থাকেন।
পরপর সাতবার দৌঁড়ানোর পরও কোনো পানি না পেয়ে মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য চান। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মা হাজেরার দোয়া কবুল করেন। তখন পুত্রের কাছে গিয়ে দেখলেন আল্লাহর কুদরতে তার দুই পায়ের নিচে একটি পানির ফোয়ারা জেগে উঠেছে এবং তা ক্রমশ উথলে উঠছে ও প্রবাহিত হতে চাচ্ছে। হজরত বিবি হাজেরা তখন অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং চারদিকে পাড় বেঁধে পানি থামানোর চেষ্টা করলেন। তিনি পানিকে থামার নির্দেশ দিয়ে উচ্চস্বরে বলছিলেন ‘জমজম’ অর্থাৎ থেমে যাও। হজরত হাজেরার উচ্চারিত সে শব্দেই পৃথিবীর সবচাইতে পবিত্র এ কূপের নাম হয়ে যায় ‘জমজম’।
ঐতিহাসিকরা মন্তব্য করেন, হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর পর বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায় মক্কা নগরীতে মানববসতির সূচনা করে। তারা জমজম কূপের নিয়ন্ত্রণ করতো। ঠিক ওভাবেই জুবহাম গোত্রের লোকেরা জমজম কূপের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। জুবহাম গোত্রের লোকজন হজরত হাজেরা (আ.) এর সঙ্গে চুক্তিসাপেক্ষে জমজম কূপের পানি পান করতো। কালক্রমে তারা মক্কাঘরের পবিত্র মালামাল লুণ্ঠন ও চুরি করতে থাকে। তারা নানা পাপাচারে লিপ্ত হলো। ফলে মহান আল্লাহর হুকুমে এক সময় জমজম কূপের পানি শুকিয়ে যায়।
সংস্কারের অভাবে একসময় জমজম কূপের স্থান ভরাট হয়ে যায়। মানুষ এই কূপের বরকত ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। খৃস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর সূচনাতে হজরত ইসমাঈল (আ.) এর বংশধর একজন দৃঢ়চেতা, আত্মপ্রত্যয়ী পুরুষের নেতৃত্বে কাবাগৃহের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কুরাইশরা ফিরে পায়। তাদের চতুর্দশ পুরুষ খাজা আবদুল মুত্তালিব জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর দাদা। তখন আবদুল মুত্তালিব জমজম কূপ অনুসন্ধানে আগ্রহী ও উদ্যোগী হন এবং তার এক পুত্র যায়েদকে সঙ্গে নিয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত রাখেন। এক রাতে তিনি স্বপ্নে জমজম কূপের নিশানা খুঁজে পান এবং কূপটি দেখতে পান।
স্বপ্নের চিহ্ন অনুযায়ী তিনি তার ছেলে হারেসকে সঙ্গে নিয়ে কূপ খনন শুরু করেন এবং বাস্তবেই জমজম কূপ আবিষ্কারে সক্ষম হন। তখন থেকে আবারও মানুষ এ কূপের যত্ন নিতে শুরু করেন এবং এ বরকতময় পানির ধারা আজও প্রবাহিত রয়েছে।
সূত্র: বুখারি শরিফ, হজ অধ্যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।