বিজ্ঞান ও প্রযক্তি ডেস্ক : বিশ্বজুড়ে আলোচিত ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম টিকটক আবারও শিরোনামে এসেছে, তবে এবার কোনও নাচ বা ভাইরাল ভিডিওর জন্য নয়। এইবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এক বিশাল অঙ্কের জরিমানা, যা টিকটকের জন্য এক প্রকার সাবধানবার্তা স্বরূপ। আয়ারল্যান্ডের তথ্য নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা টিকটককে ৫৩ কোটি ইউরো অর্থাৎ প্রায় ৭ হাজার ২৯৬ কোটি টাকার সমপরিমাণ জরিমানা করেছে। এই সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেটা সুরক্ষা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গৃহীত হয়েছে, বিশেষ করে চীনে ইউরোপীয় ব্যবহারকারীদের তথ্য প্রেরণ ও তার নিরাপত্তা ঘিরে। টিকটককে কেন্দ্র করে এই ঘটনাটি না শুধুমাত্র তথ্য সুরক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবনার জন্ম দিয়েছে, বরং বিশ্বজুড়ে এর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
Table of Contents
টিকটককে বিশাল অঙ্কের জরিমানা: ইউরোপের নজরদারির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
টিকটক, চীনা মালিকানাধীন জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ, ইউরোপীয় ডেটা সুরক্ষা নিয়ম ভাঙার কারণে আয়ারল্যান্ডের ডেটা প্রোটেকশন কমিশন (DPC) কর্তৃক ৫৩ কোটি ইউরো জরিমানার মুখোমুখি হয়েছে। টিকটক যে ইউরোপীয় ইকোনমিক এরিয়া (EEA) এর ব্যবহারকারীদের ডেটা চীনে স্থানান্তর করেছে, তার যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে DPC জানিয়েছে। এই স্থানান্তরিত তথ্য চীনের সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে নিরাপদ থাকবে এমন কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেনি টিকটক।
টিকটক মূলত ব্যবহারকারীদের ডেটা কোথায় পাঠাচ্ছে এবং তা কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তা পরিষ্কারভাবে জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। সাধারণ ডেটা সুরক্ষা নিয়ন্ত্রণ (GDPR) আইন অনুযায়ী, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের উচিত ব্যবহারকারীদের ডেটা নিরাপদ রাখা এবং তার ব্যবহার সংক্রান্ত স্বচ্ছতা বজায় রাখা। কিন্তু টিকটক এই আইন ভঙ্গ করায়, ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে এই কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
DPC এই সিদ্ধান্তে আসার আগে ব্যাপক তদন্ত চালায়, যেখানে তারা টিকটকের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ও নীতিগত ত্রুটি শনাক্ত করে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল, টিকটকের মাধ্যমে পাঠানো ইউরোপীয় ব্যবহারকারীদের তথ্য চীনের সরকারের কাছে সহজলভ্য হওয়ার সম্ভাবনা। এই কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত আইসল্যান্ড, লিচেনস্টাইন, নরওয়েসহ ২৭টি দেশের সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কঠোর হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা এবং নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টা
টিকটক শুধু ইউরোপেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রেও কঠিন সময় পার করছে। মার্কিন রাজনীতিকদের একাংশ এই অ্যাপের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং চীনা সরকারের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। এমনকি বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে টিকটকের ব্যবহার ইতোমধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থেকে টিকটক এখন ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য নতুন বাজার খুঁজছে।
জাপান এই ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম নিক্কেই-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, টিকটক শিগগিরই জাপানের ই-কমার্স বাজারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে “টিকটক শপ” এর মাধ্যমে একটি অনলাইন বিপণন প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা, যেখানে বিক্রেতারা ভিডিওর মাধ্যমে পণ্য প্রচার ও বিক্রি করতে পারবেন। এর জন্য বিক্রেতা নিয়োগের প্রক্রিয়াও শুরু করেছে কোম্পানিটি।
টিকটকের এই নতুন উদ্যোগ শুধু ব্যবসায়িক কৌশল নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত পাল্টা আক্রমণও বলা যায়। একদিকে তারা পশ্চিমা দেশগুলোর নিয়ন্ত্রনমূলক বাধার মুখোমুখি, অন্যদিকে এশিয়ার বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে। এই প্রচেষ্টা যদি সফল হয়, তবে এটি বিশ্বব্যাপী সোশ্যাল কমার্স ট্রেন্ডে একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
আরও পড়ুন: বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিবর্তন ও বাংলাদেশের রপ্তানি
টিকটকের ডেটা সুরক্ষা নিয়ে আগের বিতর্ক
টিকটক নিয়ে ডেটা সুরক্ষা সংক্রান্ত বিতর্ক নতুন নয়। এর আগে বহুবার অভিযোগ উঠেছে যে, অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করছে এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করে ব্যবহার করছে বিজ্ঞাপন ও কনটেন্ট রিকমেন্ডেশন সিস্টেম উন্নত করতে। যদিও টিকটক দাবি করে যে তারা সর্বোচ্চ ডেটা সুরক্ষা বজায় রাখে, বাস্তবতা প্রায়ই ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছে।
বিশেষ করে কমবয়সী ব্যবহারকারীদের তথ্য নিয়ে উদ্বেগ অনেক বেশি। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় ক্ষেত্রেই শিশু ও কিশোরদের তথ্য সুরক্ষা নিয়ে আলাদা আইন রয়েছে, এবং টিকটক একাধিকবার এই আইনগুলো লঙ্ঘন করার অভিযোগে তদন্তের মুখে পড়েছে।
বিশ্বব্যাপী টিকটকের ভবিষ্যৎ কী?
টিকটক বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একদিকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কঠোর নজরদারি—এই দুইয়ের ভারসাম্য বজায় রাখা প্রতিষ্ঠানটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি টিকটক তাদের ডেটা ব্যবস্থাপনা এবং স্বচ্ছতা নীতিতে পরিবর্তন না আনে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও অনেক দেশ তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারে। ইতোমধ্যেই ভারতের মতো বড় বাজারে অ্যাপটি নিষিদ্ধ হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রেও অনিশ্চয়তা রয়েছে, এবং এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকেও স্পষ্ট বার্তা পাওয়া গেল।
টিকটকের উত্তর কী হতে পারে?
টিকটকের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত জরিমানা বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া না এলেও, ধারণা করা হচ্ছে তারা আপিল করবে এবং ভবিষ্যতের জন্য তাদের নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেবে। কোম্পানিটি দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে চাইলে স্বচ্ছতা, ডেটা সুরক্ষা এবং স্থানীয় নিয়মনীতি মানার দিকেই জোর দিতে হবে।
টিকটককে কেন্দ্র করে এই বিশাল অঙ্কের জরিমানা গোটা বিশ্বের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে মনে রাখতে হবে, জনপ্রিয়তা অর্জনের পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের আস্থা অর্জন এবং তাদের তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: টিকটককে কেন এত বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়েছে?
উত্তর: ইউরোপীয় ব্যবহারকারীদের তথ্য চীনে পাঠিয়ে তার যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত না করার কারণে টিকটককে এই জরিমানা করা হয়েছে। GDPR আইন লঙ্ঘনের জন্য আইরিশ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রশ্ন: জরিমানার পর টিকটক কী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে?
উত্তর: এখনও পর্যন্ত কোম্পানির পক্ষ থেকে বিস্তারিত কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে তারা আপিল করতে পারে এবং তাদের নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রশ্ন: টিকটক কি যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, এই আশঙ্কা অনেক দিন ধরেই রয়েছে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ইতোমধ্যেই অ্যাপটির ব্যবহার সীমিত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি এখনও আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে।
প্রশ্ন: টিকটক শপ কী?
উত্তর: এটি একটি ই-কমার্স ফিচার যা ব্যবহারকারীরা ভিডিওর মাধ্যমে পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করতে ব্যবহার করেন। কোম্পানিটি জাপানে এই ফিচারটি চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রশ্ন: GDPR কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: GDPR (General Data Protection Regulation) ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি আইন যা ব্যবহারকারীদের তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এটি ব্যবহারকারীদের তথ্য কোথায় এবং কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সে বিষয়ে কোম্পানিগুলোকে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে বাধ্য করে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।