সূর্যোদয়ের সেই সোনালি আলোয় যখন র্যাকেটের আওয়াজে মিশে যায় বলের টুং টাং শব্দ, শুধু একটা খেলা নয়, সেটি জীবনের ছন্দে যোগ করে এক অনন্য তাল। শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে বা গ্রামের মাঠে, সবুজ কোর্টে ছুটে চলা একজন খেলোয়াড়ের প্রতিটি ঘামঝরা মুহূর্ত শুধু পয়েন্ট জেতার জন্য নয়, জয় করে নেয় এক সুস্থ, সক্রিয় এবং আনন্দময় জীবনের চাবিকাঠি। ‘টেনিস খেলার উপকারিতা’ শুধু শারীরিক কসরতের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়; এটি হৃদয় ও মনের গভীরে ছুঁয়ে যায়, গড়ে তোলে দৃঢ় মনোবল, সামাজিক বন্ধন এবং এক অদম্য জীবনীশক্তি। আজকের এই প্রতিযোগিতাময়, চাপের জীবনে টেনিস কেন শুধুই একটি খেলা নয়, বরং আপনার দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী হয়ে উঠতে পারে, তারই অন্বেষণ এই লেখায়।
টেনিস খেলার উপকারিতা: শারীরিক সুস্থতার এক অনন্য রূপকথা
টেনিস শুধু হাতে র্যাকেট ধরার খেলা নয়; এটি সম্পূর্ণ শরীরের এক গতিশীল সিম্ফনি। গবেষণা বারবার প্রমাণ করেছে, নিয়মিত টেনিস খেলার অভ্যাস দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সুস্থতার চাবিকাঠি। ব্রিটিশ জার্নাল অফ স্পোর্টস মেডিসিন-এর এক গবেষণা (২০২০) নির্দেশ করে, টেনিসের মতো র্যাকেট স্পোর্টস হৃদরোগজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ৪৭% পর্যন্ত কমাতে পারে – যা দৌড়ানো বা সাইক্লিং-এর চেয়েও উল্লেখযোগ্য।
- হৃদযন্ত্রের সুস্থতা ও ফুসফুসের ক্ষমতা বৃদ্ধি: টেনিস খেলার সময় দ্রুত দৌড়ানো, থামা, দিক পরিবর্তন করা এবং বল মারার ক্রিয়াকলাপ হৃদস্পন্দন দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। এটি কার্ডিওভাসকুলার এন্ডুরেন্স বাড়ায়, রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমায়। একটি ম্যাচ খেলে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি সহজেই ৫০০-১০০০ ক্যালরি পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলতে পারেন, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকর।
- পেশী শক্তি, স্ট্যামিনা ও হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি: টেনিস একটি ফুল-বডি ওয়ার্কআউট। পা থেকে শুরু করে কোমর, পিঠ, কাঁধ, বাহু ও কব্জি – সবই সক্রিয়ভাবে কাজ করে। বল মারার সময়ের শক্তির বিস্ফোরণ (Explosive Power), দৌড়ানোর সময়ের পায়ের পেশীর সহনশীলতা, এবং দ্রুত দিক পরিবর্তনের জন্য কোর স্ট্রেংথের বিকাশ ঘটে। বিশেষত কিশোর-কিশোরী ও তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য টেনিস হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে সহায়ক, যা পরবর্তী জীবনে অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ, ইউএসএ)।
- সমন্বয়, ভারসাম্য ও নমনীয়তার উন্নয়ন: টেনিস খেলার অন্যতম সৌন্দর্য হল এর জটিলতা। চোখ দিয়ে বলের গতিপথ নির্ণয়, মস্তিষ্ক দিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং শরীর দিয়ে তা বাস্তবায়ন – এই পুরো প্রক্রিয়াটি হাত-চোখের সমন্বয় (Hand-Eye Coordination), শরীরের ভারসাম্য (Balance) এবং নমনীয়তা (Flexibility) এর ওপর নির্ভরশীল। নিয়মিত অনুশীলনে এই দক্ষতাগুলো তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায়, যা দৈনন্দিন জীবনে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমায় এবং সার্বিক চলাফেরায় স্বাচ্ছন্দ্য আনে।
প্রাকটিক্যাল উদাহরণ: ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী সালমা আক্তার। ডায়াবেটিস ও হাঁটুর ব্যথায় ভুগছিলেন। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি সপ্তাহে তিন দিন স্থানীয় ক্লাবে টেনিস খেলা শুরু করেন। মাত্র ছয় মাসের মধ্যে তার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আসে, ওজন কমে এবং হাঁটুর ব্যথা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। তার কথায়, “টেনিস শুধু ব্যায়াম নয়, আমার জন্য নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ এনে দিয়েছে।”
টেনিস খেলার উপকারিতা: মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক বন্ধনের উর্বর ক্ষেত্র
টেনিসকে প্রায়শই ‘দাবা খেলার শরীরী রূপ’ বলা হয়। এর সুবিধা কেবলমাত্র পেশী ও হাড়ের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর প্রভাব প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয় মানসিক ও সামাজিক জীবনে। বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশনের এক কর্মশালায় (২০২৩) মনোবিদগণ উল্লেখ করেন, টেনিস খেলোয়াড়দের মধ্যে চাপ, উদ্বেগ ও হতাশার মাত্রা উল্লেখযোগ্যহারে কম।
- মানসিক চাপ ও উদ্বেগ হ্রাস: কোর্টে প্রবেশের সাথে সাথে দৈনন্দিন জীবনের টেনশন, কাজের চাপ পিছনে ফেলে আসার এক অনন্য অনুভূতি কাজ করে। দৌড়ানো, বল মারা, প্রতিপক্ষের কৌশল বুঝে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া – এই পুরো প্রক্রিয়ায় মন সম্পূর্ণভাবে বর্তমান মুহূর্তে নিবদ্ধ থাকে (Mindfulness)। এটি কর্টিসল (চাপের হরমোন) এর মাত্রা কমায় এবং সেরোটোনিন ও এন্ডোরফিন (ভালো লাগার হরমোন) নিঃসরণ বাড়িয়ে মুড উন্নত করে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা (২০২২) দেখিয়েছে, টেনিস খেলার মতো ইন্টারভ্যাল ট্রেনিং মস্তিষ্কের নিউরোপ্লাস্টিসিটি বাড়ায়, যা স্মৃতিশক্তি ও শেখার ক্ষমতা উন্নত করে।
- কৌশলগত চিন্তা, ফোকাস ও শৃঙ্খলার বিকাশ: প্রতিটি শটের আগে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া, প্রতিপক্ষের দুর্বলতা চিহ্নিত করা, গেম প্ল্যান বানানো এবং তা বাস্তবায়ন – এসবই মস্তিষ্কের কগনিটিভ ফাংশনকে তীব্রভাবে চ্যালেঞ্জ করে। নিয়মিত খেলায় ফোকাস, একাগ্রতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং কৌশলগত চিন্তাভাবনার অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। এই দক্ষতাগুলো সরাসরি প্রভাব ফেলে পেশাগত ও শিক্ষাগত জীবনের সাফল্যে।
- আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি ও সামাজিকীকরণ: একটি কঠিন শট সফলভাবে মারা, একটি ম্যাচ জিততে পারা – এসব ছোট ছোট সাফল্য আত্মবিশ্বাসকে শাণিত করে। ব্যর্থতাগুলোও শেখায় সহনশীলতা ও ধৈর্য। টেনিস স্বভাবতই একটি সামাজিক খেলা। ডাবলস খেলা, ক্লাবের সদস্যদের সাথে অনুশীলন, টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ – এসবের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবেই গড়ে ওঠে নতুন বন্ধুত্ব, সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং সম্প্রদায়ের সাথে সংযোগ। এটি একাকীত্ব দূর করে সামাজিক সমর্থন জালকে শক্তিশালী করে, বিশেষত বয়স্কদের জন্য যা অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম হাতের অভিজ্ঞতা: চট্টগ্রামের একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলাম। কাজের চাপে ক্রমাগত মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। বন্ধুর পরামর্শে স্থানীয় টেনিস একাডেমিতে ভর্তি হন। “প্রথমে শুধু ব্যায়ামের জন্য শুরু করেছিলাম,” তিনি বললেন, “কিন্তু এখন টেনিস আমার স্ট্রেস বাস্টার। প্রতিটি শটে মনোযোগ দিতে গিয়ে অফিসের টেনশন ভুলে যাই। ক্লাবের নতুন বন্ধুরা এখন পরিবারের মতো। আত্মবিশ্বাসটাও আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে।
টেনিস খেলার উপকারিতা: সকল বয়সের জন্য এক সুলভ সুযোগ
টেনিসের সবচেয়ে বড় গুণ এটি সকল বয়স ও সামর্থ্যের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। ৫ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের প্রবীণ – প্রত্যেকেই নিজের গতিতে, নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী এই খেলার সুবিধা ভোগ করতে পারেন।
- শিশু-কিশোরদের জন্য: টেনিস শিশুদের শারীরিক বিকাশ, সমন্বয় ক্ষমতা, দলগত মনোভাব (ডাবলসে), শৃঙ্খলা এবং প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এটি স্কুলের পড়াশোনায় ফোকাস বাড়াতেও সহায়ক। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (BKSP) সহ বিভিন্ন একাডেমিতে শিশুদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু রয়েছে।
- প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য: কর্মব্যস্ত জীবনে টেনিস একটি পারফেক্ট স্ট্রেস রিলিভার ও ফিটনেস সলিউশন। সপ্তাহে ২-৩ দিন, ১-২ ঘন্টা খেলেই উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যায়। এটি নেটওয়ার্কিং এরও একটি ভালো প্ল্যাটফর্ম।
- বয়স্কদের জন্য: হালকা গতিতে, ছোট কোর্টে (প্রায়ই ‘প্যাডেল টেনিস’ বা ‘পপ টেনিস’ নামে পরিচিত) খেলা বয়স্কদের জন্য জয়েন্ট ফ্রেন্ডলি ব্যায়ামের ব্যবস্থা করে। এটি হাড়ের স্বাস্থ্য, ভারসাম্য রক্ষা, সামাজিক মেলামেশা এবং মানসিক সতেজতা বজায় রাখতে অত্যন্ত কার্যকর। ঢাকার ধানমন্ডি ক্লাব, বরিশাল টেনিস কমপ্লেক্সের মতো জায়গাগুলোতে বয়স্কদের জন্য নিয়মিত সেশন দেখা যায়।
টেনিস কিভাবে শুরু করবেন: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি ব্যবহারিক গাইড
টেনিস শুরু করতে ভয় পাবেন না! বাংলাদেশে এর সুযোগ ক্রমশ বাড়ছে। এখানে কিছু সহজ পদক্ষেপ:
- প্রাথমিক সরঞ্জাম: শুরুতে খুব বেশি ব্যয় করার দরকার নেই। একটি বেসিক টেনিস র্যাকেট (প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাধারণত ২৫০-৩০০ গ্রাম ওজন) এবং কয়েকটি বলই যথেষ্ট। আরামদায়ক স্পোর্টস জুতা (যা পার্শ্বীয় চলাচলকে সাপোর্ট করে) অপরিহার্য। ঢাকার নিউ মার্কেট বা অনলাইন শপ (রাজশাহীর ‘স্পোর্টস গিয়ার BD’ এর মতো) থেকে সহজেই সুলভে কেনা যায়।
- প্রশিক্ষণ খোঁজা:
- স্থানীয় ক্লাব/একাডেমি: ঢাকার রমনা টেনিস কমপ্লেক্স, মহাখালী টেনিস কমপ্লেক্স, চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম, খুলনার বয়রা টেনিস কোর্ট, রাজশাহী স্টেডিয়াম সহ দেশের প্রায় সব বিভাগীয় শহরেই সরকারি-বেসরকারি সুবিধা আছে। বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশন (BFT) এর ওয়েবসাইটে কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে (https://tennisbd.org/)।
- কোচ/প্রশিক্ষক: একজন যোগ্য কোচের তত্ত্বাবধানে শুরু করলে ভুল অভ্যাস এড়ানো যায় এবং দ্রুত উন্নতি সম্ভব। স্থানীয় ক্লাবগুলোতে প্রশিক্ষক পাওয়া যায়। খরচ স্থান এবং কোচের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ভিন্ন হয়।
- গ্রুপ ক্লাস/ক্যাম্প: অনেক ক্লাব বা একাডেমি গ্রুপ ক্লাস অফার করে, যা ব্যক্তিগত কোচিংয়ের চেয়ে সাশ্রয়ী। শীতকালে বা স্কুল ছুটিতে প্রায়ই শুরু হয় বাচ্চাদের ক্যাম্প।
- শুরুর জন্য টিপস:
- ধৈর্য ধরুন: দক্ষতা অর্জনে সময় লাগে। প্রথম দিকে ভুল হবেই, সেটাই স্বাভাবিক।
- প্রাথমিক কৌশল শিখুন: সঠিক গ্রিপ (যেমন: পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিপ), ভিত্তি দাঁড়ানো (স্ট্যান্স), ফোরহ্যান্ড ও ব্যাকহ্যান্ড স্ট্রোকের মৌলিক কৌশল শেখার ওপর ফোকাস করুন। বলের সাথে সংযোগ তৈরি করুন।
- নিয়মিত অনুশীলন: সপ্তাহে অন্তত দুবার খেলার চেষ্টা করুন। সামান্য সময় নিয়েও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি।
- ওয়ার্ম-আপ ও কুল-ডাউন: খেলার আগে ১০-১৫ মিনিট হালকা স্ট্রেচিং, জগিং এবং পরে আবার স্ট্রেচিং করলে ইনজুরির ঝুঁকি কমে।
- হাইড্রেশন ও পুষ্টি: বিশেষত গরমে, খেলার আগে, মাঝে ও পরে প্রচুর পানি পান করুন। সুষম খাবার খান।
টেনিস খেলার উপকারিতা: কিছু সচেতনতা ও নিরাপত্তা
যেকোনো শারীরিক ক্রিয়াকলাপের মতো টেনিসেও কিছু সতর্কতা জরুরি:
- ধীরে শুরু করুন: যারা একদম নতুন বা দীর্ঘদিন বিরত ছিলেন, তারা ধীরে ধীরে তীব্রতা বাড়াবেন। হঠাৎ করে বেশি চাপ দিলে ইনজুরি (টেনিস এলবো, হাঁটু বা কাঁধে ব্যথা) হতে পারে।
- সঠিক কৌশল: ভুল কৌশলে বল মারলে জয়েন্টে বা পেশীতে চাপ পড়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে একজন কোচের তত্ত্বাবধানে শেখা ভালো।
- শরীর শুনুন: ব্যথা বা অস্বস্তি হলে জোর করবেন না। বিশ্রাম নিন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- পরিবেশ ও সরঞ্জাম: ভালো অবস্থার কোর্টে খেলুন। ভাঙাচোরা বা অসম কোর্টে পড়ে গিয়ে ইনজুরির ঝুঁকি থাকে। র্যাকেটের গ্রিপ ঠিক আছে কিনা, জুতো সঠিক কিনা খেয়াল রাখুন।
- হাইড্রেশন ও আবহাওয়া: গরম ও আর্দ্র দিনে অতিরিক্ত সতর্ক থাকুন। প্রচুর পানি পান করুন এবং প্রখর রোদে খেলতে হলে ক্যাপ, সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
বিশেষজ্ঞের মতামত: ডাঃ ফারহানা ইসলাম, স্পোর্টস ফিজিওথেরাপিস্ট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বলেন, “টেনিস বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মানুষের জন্য একটি দুর্দান্ত ফিটনেস অপশন। তবে নতুনদের উচিত ধীরে শুরু করা, সঠিক টেকনিক শেখা এবং শরীরের সংকেতকে গুরুত্ব দেওয়া। সামান্য ব্যথাকেও অবহেলা করলে তা দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায় রূপ নিতে পারে। প্রপার ওয়ার্ম-আপ আর কুল-ডাউন অপরিহার্য।
জেনে রাখুন (FAQs)
টেনিস খেলা শুরু করার আদর্শ বয়স কত?
টেনিস শুরু করার কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই! শিশুরা ৪-৫ বছর বয়স থেকেই বিশেষায়িত ছোট র্যাকেট ও নরম বল দিয়ে শুরু করতে পারে (মিনি টেনিস/রেড বল)। প্রাপ্তবয়স্করা যেকোনো বয়সেই শুরু করতে পারেন। বয়স্করাও হালকা গতিতে বা প্যাডেল টেনিসের মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেন। মূল কথা হলো নিজের শারীরিক সামর্থ্য অনুযায়ী উপযুক্ত গতিতে খেলা।বাংলাদেশে টেনিস শেখার ভালো জায়গা কোথায়?
ঢাকায় রমনা টেনিস কমপ্লেক্স, মহাখালী টেনিস কমপ্লেক্স, ধানমন্ডি ক্লাব, গুলশান ক্লাব, ইউটিসি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) উল্লেখযোগ্য। চট্টগ্রামে এম এ আজিজ স্টেডিয়াম, খুলনায় বয়রা টেনিস কোর্ট, রাজশাহী স্টেডিয়াম, সিলেট স্টেডিয়াম, বরিশাল টেনিস কমপ্লেক্সে সুবিধা রয়েছে। প্রাইভেট একাডেমিও অনেক জায়গায় গড়ে উঠেছে। স্থানীয় ক্রীড়া সংস্থা বা বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশন (BFT) এর সাথে যোগাযোগ করে খোঁজ নিতে পারেন।টেনিস খেলার জন্য মৌলিক সরঞ্জামাদি কী কী লাগে?
- টেনিস র্যাকেট: ওজন, গ্রিপ সাইজ এবং হেড সাইজ আপনার বয়স ও শারীরিক সামর্থ্য অনুযায়ী নিতে হবে। নতুনদের জন্য মাঝারি ওজনের (২৮০-৩০০ গ্রাম), মাঝারি গ্রিপের (Grip Size 4 ¼ বা 4 3/8) র্যাকেট ভালো।
- টেনিস বল: প্রশিক্ষণের জন্য সাধারণত ‘প্রেসারলেস’ বল ব্যবহার করা হয় যা স্থায়িত্বশীল।
- স্পোর্টস জুতা: টেনিসের জন্য বিশেষায়িত জুতা (Tennis Shoes) যা পার্শ্বীয় চলাচল ও দ্রুত দিক পরিবর্তনে সাপোর্ট দেয় এবং কোর্টের পৃষ্ঠের সাথে গ্রিপ তৈরি করে। রানিং শুজ পরিহার করুন।
- আরামদায়ক পোশাক: সুতি বা ময়েশ্চার-উইকিং কাপড়ের টি-শার্ট, শর্টস বা স্কার্ট।
- (ঐচ্ছিক): ক্যাপ/ভিসার, সানস্ক্রিন, অতিরিক্ত গ্রিপ টেপ, জুতা ব্যাগ।
সপ্তাহে কতবার টেনিস খেলা স্বাস্থ্যের জন্য আদর্শ?
স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য সপ্তাহে ২-৩ বার, প্রতিবার ৪৫-৬০ মিনিট করে খেলা আদর্শ। তবে এটি আপনার বর্তমান ফিটনেস লেভেল, বয়স এবং লক্ষ্যের উপর নির্ভর করে। নতুনরা ২ দিন দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে বাড়াতে পারেন। প্রতিদিন খেলার দরকার নেই, বিশ্রামও সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিযোগিতামূলক খেলোয়াড়রা অবশ্যই বেশি সময় দেন।- টেনিস খেলোয়াড়দের জন্য বিশেষ পুষ্টি পরামর্শ কী?
- কার্বোহাইড্রেট: শক্তির প্রধান উৎস (ভাত, রুটি, পাস্তা, ওটস, ফল)। খেলার আগে ও পরে জরুরি।
- প্রোটিন: পেশী মেরামত ও গঠনের জন্য (মাছ, মুরগি, ডিম, ডাল, দুধ/দই, বাদাম)। খেলার পরপরই প্রোটিন গ্রহণ উপকারী।
- স্বাস্থ্যকর ফ্যাট: দীর্ঘমেয়াদি শক্তি ও হরমোনের জন্য (অ্যাভোকাডো, বাদাম, বীজ, অলিভ অয়েল)।
- হাইড্রেশন: সারাদিন ধরে এবং বিশেষ করে খেলার আগে, মাঝে ও পরে প্রচুর পানি পান করুন। দীর্ঘ বা তীব্র ম্যাচে ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিঙ্কও প্রয়োজন হতে পারে।
- ভিটামিন ও মিনারেল: তাজা শাকসবজি ও ফলমূল খান। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি হাড়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- খেলার ২-৩ ঘন্টা আগে ভারী খাবার খাবেন না। হালকা স্ন্যাকস (বানানা, টোস্ট) নিতে পারেন ৩০-৬০ মিনিট আগে।
সবুজ কোর্টে প্রতিটি ছোঁয়া, প্রতিটি দৌড় শুধু একটি খেলার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আপনার শরীরের প্রতিটি সেলকে জাগ্রত করে, মনের জড়তাকে দূর করে এবং আত্মাকে সংযুক্ত করে এক অদৃশ্য সামাজিক বন্ধনে। ‘টেনিস খেলার উপকারিতা’ তাই কেবল ক্যালরি পোড়ানো বা পেশী গঠনের চেয়ে অনেক গভীর ও সুদূরপ্রসারী। এটি গড়ে তোলে এক স্থিতিস্থাপক মন, একটি কর্মক্ষম শরীর এবং এক উষ্ণ, সংযুক্ত হৃদয়। আজই হাতে তুলে নিন একটি র্যাকেট, বলের সাথে তৈরি করুন আপনার প্রথম সংযোগ, এবং অনুভব করুন কিভাবে এই মন্ত্রমুগ্ধকর খেলাটি আপনার জীবনের গতিপথকে করে তুলতে পারে আরও প্রাণবন্ত, আরও স্বাস্থ্যবান এবং পরিপূর্ণ। আপনার সুস্থ, সক্রিয় ও আনন্দময় জীবনের যাত্রা শুরু হোক আজ এই মুহূর্ত থেকেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।