জুমবাংলা ডেস্ক : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা শাখার প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের নির্মম নির্যাতনের কথা ফেসবুকে তুলে ধরেছেন তিনি।
‘হারুনের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ানোর পর’ শিরোনামে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদারের দেয়া ফেসবুকে স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
হারুনের যেই ভাতের হোটেল চিনেন, সেই হোটেলে হারুন খাচ্ছিল। ডিবি হেফাজতের দ্বিতীয় দিন আমাকে, নাহিদ ভাইকে, আসিফ ভাইকে তার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। হারুনের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত বাজে এবং হল ছাত্রলীগের উপসম্পাদক ক্যাটাগরির। আমাদের বলছিলেন, আমি নেতা ছোট করি, নেতা বানাই না! দেখোস নাই, নূরুরে কি করে ছেড়ে দিছি! নূরু এখন রিমান্ডে কান্নাকাটি করে। সে যেভাবেই কথা বলুক না কেন, আমরা তিনজন খুব দৃঢ়ভাবে কথা বলে যাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে সে আমাকে বলে, ‘তুই শিবির’! আমি বলি, ‘না আমি শিবির না!’ সে আবারও (একটু উচ্চ শব্দে) বলে, ‘না, তুই শিবির’। আমি আবারও বলি ‘না (ওর থেকে উচ্চ শব্দে)’। সে আসিফ ভাই, নাহিদ ভাইকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, ‘দেখ, সে কীভাবে কথা বলে!’
ওর কথা বলার মাঝেই ওর থেকে উচ্চ শব্দে বলতে থাকি, ‘আমার পুরো বাড়ির মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, আমার বাড়িতে যোদ্ধারা ক্যাম্প করেছিল, আমি সেই বৃহত্তর পরিবারের সন্তান।’
আবু বাকের মজুমদার পোস্টে আরও লিখেছেন, আমি তার (হারুন) থেকে উচ্চবাচ্য করায় সে প্লেট ছুড়ে ফেলে দিয়ে এক অফিসারকে ইশারা দিয়ে বলে আমাদের নিয়ে যেতে। আমাদের তিনজনকে তিনটি আলাদা রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। রুমে যাওয়ার ৩ থেকে ৪ মিনিট পর দুইজন লোক এসে আমাকে দরজায় আসতে বলে। তাদের হাতে ছিল জম টুপি (কালো বড় টুপি, গলা পর্যন্ত ঢেকে যায়) এবং হাতকড়া। বুঝে গেছিলাম, হারুনের সঙ্গে পার্সোনালিটি দেখানোর জন্য খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। দরজায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই টুপিটি পরায়, তারপর হাতকড়া পরায়। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, দুনিয়ার আলো কিছুই দেখা যায় না, ভয়ংকর একটা পরিবেশ। ডানে, বামে ঘুরিয়ে হাঁটানো শুরু করলো, বারবার মনে হচ্ছিল ছাদের পাশে নিয়ে এই অবস্থায় ফেলে দেয় কিনা! আর জিজ্ঞেস করছিলাম, ‘নাহিদ ভাই, আসিফ ভাইকেও নিচ্ছে কিনা?’,
তারা জানালেন, তারা এ বিষয়ে জানেন না, উনাদের দায়িত্ব শুধু আমাকে নিয়ে যাওয়া। নাহিদ ভাই, আসিফ ভাই অনেক অসুস্থ ছিলেন, উনাদের জন্য ভয় হচ্ছিল। যাই হোক, তারপর লিফটে, আবার হেঁটে, আবার সিঁড়িতে, এভাবে কোনো একটা রুমে নিয়ে গেল। একটা জিনিস বারবার মাথায় আসছিল যে আমাকে মেরে ফেলে কিনা, ফ্যাসিস্ট সরকারের কাছে তো বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সাধারণ ঘটনা ছিল। তারপর রুমে নিয়ে দেয়ালের দিকে ঘুরিয়ে জম টুপি খুলে গামছা দিয়ে খুব শক্ত করে চোখ বাঁধলো, আর হাতগুলোও বড় গামছা দিয়ে বাঁধলো। হাত বাধার সময় এমনভাবে বাঁধলো যেন হাতের বেশি জায়গাজুড়ে গামছা থাকে। তারপর উলটা ঘুরতে বলে, একপায়ে দাঁড়াতে বলে। টানা ৭২ ঘণ্টা না ঘুমানোর জন্য শরীরে ব্যালেন্স ছিল না। দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হই।
শেষে সোজা হয়েই দাঁড়াতে বলে এবং জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। ওদের কথায় বুঝতে পারছিলাম যে, ওরা মোটামুটি আমাদের সবকিছু জানে। আমাকে শুরুতেই বলে, ‘তুই তো জুনের ৯ তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশকে সংগঠিত করতে লিড দিছস, তোর তো আন্দোলনকে বড় করার অনেক খায়েশ! তোরে এগুলো কে শিখাইছে? তোর তো বয়স বেশি না! ট্রেনিং পাইছোস কই?’
উত্তরে আমি বলি, ‘আমি ছাত্রসংগঠন করি, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য সচিব, সংগঠন শুরুতে দাঁড় করানোর জন্য এবং পরবর্তীতে বিস্তারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আমি মানুষকে সংগঠিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি’ তারপর কিছুক্ষণ প্যাচায়!
তারপর আবার, ‘তুই ফ্রন্টলাইনে আসিস না কেন? তুই কি মনে করিস তোরে আমরা চিনি না? তুই কোথায় কি করিস সব তথ্য আছে’। আমি চুপ থাকি, পরে আবার ‘কথা বলিস না কেন?’ আমি বলি, ‘আমি ব্যাকস্টেজে কাজ করতে পছন্দ করি।’ আবার বলে, ‘১৫ তারিখ একাত্তর হলে যখন মারামারি হয় তখন তুই কই ছিলি?’ আমি বলি, একাত্তর হলের সামনেই। সে বলে, তুই তো প্রথম মারামারি লাগাইছস, মারামারিতে নেতৃত্ব দিছস! আমি বলি, ‘ছাত্রলীগ আমাদের মারে, পরে আমরা প্রতিরোধ করি’ এভাবে অনেক প্রশ্ন উত্তর হয় ১৫ জুলাই নিয়ে।
তারপর জিজ্ঞেস করে, ‘তোর গুরু কে?’ উত্তর দেই আমার কোনো গুরু নাই, শুধুমাত্র জাতীয় স্বার্থে সংগঠন করি, আর আন্দোলনও ঠিক একই কারণে করে যাচ্ছি। এই বিষয়েও আরও অনেক সাবস্টিটিউট প্রশ্ন-উত্তর হয়। তারপর আবার, ‘তুই কি সরকারি চাকরি করবি?’ আমি বলি করতেও পারি, তবে আমার রাজনীতি ও একাডেমি নিয়ে আগ্রহ আছে। এটা নিয়ে অনেক প্যাচানোর চেষ্টা করে।
এরকম আরও অসংখ্য প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে (বেঁচে থাকলে সব লিখবো), সর্বশেষ বলে, সরকার তো কোটা নিয়ে সব দাবি-দাওয়া মেনে নিয়েছে তারপরও এখন কীসের আন্দোলন? আমি চুপ থাকি, ওরা চিল্লাপাল্লা করে, ঝাড়াঝাড়ি করে, তখনো চুপ থাকি। একজন বলে উঠে, ওরে ঝুলা। আমি তখনো চুপ থাকি। তারপর পাশের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়, নিয়ে হাত উপরে ঝুলিয়ে বাঁধা হয়। আমি বলি পিঠে মারলে মরে যাব, বাম পায়ে একটু সমস্যা আছে, বাম পা টা ভেঙে যাবে। ওরা কিছু বলে না। একপর্যায়ে নিতম্বে মোটা শক্ত কোনো লাঠি দিয়ে একের পর এক আঘাত করে, আর আমি চিৎকার দিয়ে উঠি, আর ওরা বলে, প্রাইমিনিস্টারকে ধন্যবাদ দিয়ে বিবৃতি দিবি? আমি বলি,‘না’। এরকমভাবেই চলতে থাকে। স্কুল লাইফে টিচারদের অনেক মাইর খেয়েছিলাম, স্যাররা বেত ব্যবহার করতেন, মারার সময় নার্ভ সিস্টেম অটোমেটিক একটা প্রটেক্টিভ ভূমিকায় চলে যেত, অন্তত ম্যান্টাল প্রিপারেশন থাকতো। কিন্তু এখানে তা নাই, চোখ বন্ধ, হাত বাঁধা, যেন হুট করে লাঠির আঘাত লাগছে। খুব ভয়ংকর লাগছিল এবং ব্যথা তুলনামূলক বেশি পাচ্ছিলাম।
পোস্টে আবু বাকের মজুমদার আরও লিখেছেন, আমি পানি চাই, বোতলের ছিপি করে এক ছিপি (মুখ) পরিমাণ পানি দিয়েছিল। জিহ্বা-গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গিয়েছিল। বেধড়ক মারার পর একপর্যায়ে সামনে থেকে কেউ একজন বলে, ওরে রেস্ট দে। বড় নিঃশ্বাস নিলাম। আর ভাবতেছিলাম, যত ভয় পাইছি যে সহ্য করতে পারবো কিনা, ততো না! আসলে বেঁধে পেটালে কার না সহ্য হয়! যাইহোক তারপর দ্বিতীয় দফায় মার খাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
উপরে হাত ঝুলানো হলেও পায়ের আঙুল ফ্লোরে লাগিয়ে একটুখানি ভর দেয়া যাচ্ছিল। প্রথম দফা মারার পর আমাকে প্রায় এক ঘণ্টা বা তারও বেশি এভাবে ঝুলিয়ে রেখেছিল। আর আমি পানি চাইলে বোতলের মুখে (ছিপিতে) এক মুখ পানি দিতো। এভাবেই যাচ্ছিল, আর মনে মনে সেকেন্ড রাউন্ডের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আর ভাবছিলাম, নাহিদ ভাই আর আসিফ ভাইয়ের যেন কী অবস্থা! ওই সময়ে আমি তুলনামূলক উনাদের থেকে স্ট্রং ছিলাম। যাইহোক, একপর্যায়ে আমার অনেক প্রস্রাবের বেগ হলে তাদের জানালে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর আমাকে আর ঝুলায়নি, এবার একটা চেয়ারে বসতে দেয়। হাত চোখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকি, আর সেকেন্ড রাউন্ডের অপেক্ষা করি।
সেকেন্ড রাউন্ড কখন শুরু হবে, জিজ্ঞেস করলে সামনে থাকা ব্যাক্তি বলেন, তিনি জানেন না, তার স্যার উপস্থিত নাই। নরমালি ঝুলানো অবস্থা থেকে বসালে ব্যথা আরও বেড়ে যায়, ঝুলানো থেকে খোলার পর হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। এভাবে চলতে চলতে একপর্যায়ে আবার দু’জন এসে হাত খুলে দেয় কিন্তু চোখ বাঁধা অবস্থায় থাকে। হাঁটতে গিয়ে দেখি হাঁটা যাচ্ছে না, একপর্যায়ে ওদের দুই কাঁধের ওপর আমার দুই হাতের ভর দিয়ে অনেক কষ্টে আমাকে যে রুমে রাখা হতো সেই রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার রুমে, যারা ছিলেন, তাদের একজন বলতেছিল, ‘সুস্থ একটা মানুষকে নিয়ে দেখ কি করে দিছে, এদেরকে আল্লাহ মাফ করবে না!’
প্রসঙ্গত, কোটা আন্দোলন দমনে ছয় সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। শুধু তাই নয়, জোর করে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিও আদায় করেছিলেন। পরে আন্দোলনের তোপের মুখে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।