জুমবাংলা ডেস্ক: রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাত নাম্বার পুরুষ ওয়ার্ডের সামনে মাঝবয়সী এক বৃদ্ধ উদভ্রান্তের মতো পায়চারি করছিলেন এবং ফোনে অনবরত কথা বলছিলেন। কথা শুনে বোঝা গেলো, তার সন্তান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন সাত নাম্বার ওয়ার্ডের ২৮০ নাম্বার বেডে। বিগত নয় দিন থেকে তার সন্তানের রক্তে প্ল্যাটিলেটের সংখ্যা কমে ৫০ হাজারে এসে ঠেকেছে।
ডাক্তার গতকাল বলেছেন, আজকে রাতের মধ্যে রোগীর জন্যে প্ল্যাটিলেট সংগ্রহ করতে না পারলে রোগী ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে পড়ে যাবে। ময়মনসিংহ থেকে আসা আলী আক্কাস নামের এই ভদ্র লোক আজকে দুপুর দুইটা বেজে গেলেও রোগীর প্ল্যাটিলেট সংগ্রহ করার জন্য একজন রক্তদাতাও পাননি।
নতুন করে খোলা বারডেম হাসপাতালের বিশেষায়িত ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন আলতা বেগম, বয়স হবে পঞ্চাশের উপরে। ওই ওয়ার্ডে কর্তব্যরত সিনিয়র স্টাফ নার্স হাবিবুর রহমান জানান, আলতা বেগমের রক্তে প্ল্যাটিলেটের সংখ্যা কমে ১২ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের বলে রেখেছি, যে কোন সময় প্ল্যাটিলেট লাগতে পারে। তারা যেন ডোনার ম্যানেজ করে রাখেন। ডোনার ম্যানেজ হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি রোগীর আত্মীয়ের কাছে শুনে জানান, গত রাত থেকে আজ বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত নানাভাবে খুঁজেও রক্তদাতা বা ডোনার পাননি তারা।
শুধু সোহরাওয়ার্দী কিংবা বারডেম নয় রাজধানীর প্রত্যেকটি হাসপাতালে এটি এখন একটি পরিচিত চিত্র। গত পহেলা আগস্ট থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমলেও আক্রান্ত ও চিকিৎসাধীন রোগীদের সুস্থতার জন্যে প্ল্যাটিলেটের চাহিদা বেড়েই চলেছে। রক্ত নিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে ছয় থেকে সাতটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এই সংগঠনগুলো তো বটেই রক্তের চাহিদা মেটাতে এই সংকটকালীন সময়ে সংঘবদ্ধ হয়ে এবং ব্যক্তিগতভাবেও অনেকেই কাজ করে যাচ্ছেন তবুও যেন মিটছে না প্ল্যাটিলেটের চাহিদা। ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ার ফলে কি পরিমাণ রক্তের চাহিদা তৈরী হয়েছে সেই ব্যাপারে ধারনা দিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ সন্ধানীর শাখা সভাপতি সিয়াম শাহরিয়ার, যখন স্বাবাভিক ছিলো পরিস্থিতি তখন আমরা দিনে ১০ থেকে ১৫ জন রোগীর জন্যে রক্ত সরবরাহ করতাম। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ার পর থেকে প্রতিদিন আমরা ২৫ থেকে ৩০ জন রোগীর জন্যে রক্ত সরবরাহ করে থাকি। এটা শুধু আমাদের ডিএমসি সন্ধানী ইউনিট করে। আর ঢাকায় আমাদের যত শাখা আছে তাদেরও হিসেবটা প্রায় একই রকম।
তিনি উদ্বেগ জানিয়ে আরো বলেন, এটা তো বলেছি আমরা যত জনের জন্যে রক্ত সংগ্রহ করে থাকি তাদের হিসেব কিন্তু যাদের আমরা রক্ত সরবরাহ করতে পারি না তাদের হিসেবটা তো আমরা রাখি না। হিসেবে রাখলে সেটার সংখ্যাও খুব কম হবে না।
একই বিষয় নিয়ে কথা হয় স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংগ্রহকারী সংগঠন বাঁধনের সাথে। বাঁধনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনের দোতলায় কাজে ব্যস্ত থাকা দায়ীত্বরত একজনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ার পরে তারা প্রতিদিন কি পরিমাণ রক্তদাতা সংগ্রহ করে দিচ্ছেন রক্ত প্রার্থীদের।
জবাবে তিনি বলেন, এখন আমরা প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশ জন করে পার্টি(রক্তদাতা) ম্যানেজ করে দেই রক্ত প্রার্থীদের জন্যে। এটা শুধু আমাদের ঢাবি শাখার কার্যক্রম উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, সারা দেশের পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে ঢাকার শাখাগুলোর হিসেবে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় গত দেড় মাসে আমরা শতকরা ষোল জন অতিরিক্ত লোকের জন্যে পার্টি ম্যানেজ করে দিয়েছি। আবার অনেক সময় আমরা পার্টি ম্যানেজ করতে পারি না। তিনি আরো বলেন,হুট করে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সেটা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। আবার আমাদের যোগাযোগের মধ্যে যারা আছেন তারা প্রায় সবাই একবার করে রক্ত দিয়েও ফেলেছেন ইতমধ্যে।
এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে নিয়মিত রক্তদান ও রক্তদাতা সংগ্রহ করে দিয়ে থাকেন আইটি কর্মী মানস রায় ও সাবেক সংবাদ কর্মী মুনওয়ার আলম নির্ঝর। মানস রায় বলেন, আমার রক্তের গ্রুপ এবি পজেটিভ। আমি গত দুই মাসে একজন ডেঙ্গু রোগীর জন্যে একবার রক্ত দিয়েছি এবং পাঁচ থেকে ছয় জন রোগীর জন্যে রক্তদাতা সংগ্রহ করে দিয়েছি। প্রায় প্রতিদিন পরিচিত ও অপরিচিত অনেকেই রক্ত চেয়ে আমার কাছে ফোন করেন। আমি, আমার সাধ্য মতো তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করি। কিন্তু সপ্তাহ খানেক থেকে আমাকে রক্ত চেয়ে অনেকেই ফোন করলেও আমি তাদের রক্তদাতা ম্যানেজ করে দিতে পারিনাই।
মুনওয়ার আলম নির্ঝরও বলেন, আজকে সকালে আমাকে একজন ফোন করে বললেন ডেঙ্গু রোগীর জন্যে প্ল্যাটিলেট দিতে পারবে এমন একজন রক্তদাতা চায়, রক্তের গ্রুপ এবি পজেটিভ। উত্তরার একটি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর অবস্থা সিরিয়াস শুনে আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ করি, আমার পরিচিত চার-পাঁচজনকে দিয়ে খোঁজ করাই। রোগীর স্বজনরাসহ মোট ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ জন মানুষ সারা দিন খুঁজে দুই ব্যাগ রক্ত ম্যানেজ করেছে আরো দুই ব্যাগ রক্ত না পেলে এক ইউনিট প্ল্যাটিলেট ম্যানেজ করা যাবে না। এরপর আশঙ্কা প্রকাশ করে নির্ঝর বলেন, আমি গত দুই মাস থেকে ডেঙ্গু রোগীদের জন্যে রক্ত সংগ্রহের কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি ডেঙ্গু রোগী কমলেও আক্রান্ত ও চিকিৎসাধীন রোগীদের জন্যে প্ল্যাটিলেটের চাহিদা বেড়েই চলেছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা না যায় কিংবা ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্যে যদি প্ল্যাটিলেট ডোনারের ব্যবস্থা না রাখা হয়, তাহলে প্ল্যাটিলেট সংকটেই ডেঙ্গু আক্রান্তরা মারা যাবেন।
প্ল্যাটিলেট সংকটের পেছনে আরো কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। মূল রক্ত থেকে প্লাটিলেট আলাদা করার জন্যে এফারেসিস মেশিন এখনো প্রত্যেকটি হাসপাতালে নেই। শধু পিজি,পুলিশ ব্যাংক হাসপাতাল আর কোয়ান্টাম ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির আছে এই মেশিন। এই কারনেও মাঝে মাঝে এটা সংগ্রহ করা গেলেও প্রক্রিয়া করনের কাজে রয়েছে জটিলতা আর ভোগান্তিও। আবার পিজির প্ল্যাটিলেট সেন্ট্রিফিউজ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকা এক কর্মী বলেন, এখানে যারা প্ল্যাটিলেট দিতে আসেন তাদের অর্ধেকের বেশি ক্রস ম্যাচিং এর পরে রক্ত ডোনেটের জন্যে অনুপযুক্ত বলে গন্য হন। তিনি আরো জানান, নারী ডোনারদের থেকেই তো প্ল্যাটিলেট নেওয়াই হয় না। তার উপর যদি বাকি ডোনারদের থেকে অধিকাংশের বেশি রক্ত দেবার জন্যে অনুপযুক্ত নির্বাচিত হয় তাহলে তো সংকট তৈরী হবেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।