লাইফস্টাইল ডেস্ক : রোজা সম্পর্কে আমাদের ধারণা হলো যে কোনো রকমের খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা। কিন্তু আরও এক ধরনের রোজা রয়েছে যাতে যেসব বিষয় বা বস্তু আপনাকে আনন্দ দেয় তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে হয়।
রাশ না টানলে এসব আনন্দের অনুভূতি আপনার জন্য শেষ পর্যন্ত বিষে পরিণত হতে পারে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আসক্তিতেও পরিণত হয়।
বছর কয়েক আগে, প্রযুক্তি শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন ‘ডোপামিন ফাস্ট’ বা ডোপামিন উপবাস করতে শুরু করেন যা এখন একটি নতুন সামাজিক ধারায় পরিণত হয়েছে। ডোপামিন হচ্ছে এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার যেটি আমাদের মস্তিষ্কের রাসায়নিক বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করে। এটি সাধারণত আমাদের আনন্দদায়ক অনুভূতিগুলির পেছনে প্রধান কারণ হিসাবে কাজ করে। আমাদের নড়াচড়ার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি ও শেখার ক্ষমতার মতো অনেক কাজে ডোপামিন উপস্থিত থাকে।
তাই, ডোপামিন উপবাসের লক্ষ্য হলো আধুনিক জীবনযাত্রার ক্ষতিকর উদ্দীপনা – যেমন মাত্রাতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার – থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। এই উপবাসের মধ্য দিয়ে আমাদের মস্তিষ্ককে অল্প সময়ের জন্য রিচার্জ এবং রিবুট করার সুযোগ করে দেয়া হয়।
সিলিকন ভ্যালির নতুন ধারা
আমেরিকান ব্যবসায়ী জেমস সিনকা বিবিসিকে বলছেন, “আমার জন্য ডোপামিন উপবাস মানে হলো কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার না করা, কোনো ধরনের খাবার না খাওয়া, এবং মানুষের সাথে কোন যোগাযোগ না রাখা।”
“আধুনিক জীবনযাত্রার যে সমস্ত জিনিস মস্তিষ্কে ডোপামিন ছড়িয়ে দিতে পারে তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা।”
অ্যানি লেম্বকে হচ্ছেন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ‘ডোপামিন নেশন’ নামের একটি বইয়ের লেখক। তিনি বলছেন, গত পাঁচ বছর ধরে সিলিকন ভ্যালির নির্বাহীদের মধ্যে ডোপামিন উপবাস করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। ডোপামিন তৈরি হয় মস্তিষ্কের মধ্যে।
আপনি যখন এটা করছেন, তখন কিন্তু আপনি সত্যি সত্যি ডোপামিন উপবাস করছেন না। আপনি যা করছেন তা হলো যেসব পদার্থ বা আচরণের জন্য পুরষ্কার হিসেবে আপনার মস্তিষ্ক ডোপামিন নিঃসরণ করে, তা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা।
লেম্বকে ব্যাখ্যা করেছেন, অত্যধিক প্রাচুর্য এখন বিশ্ব মানবতার ওপর এমন সব চাপ তৈরি করছে যা আগে কখনও দেখা যায়নি।
তিনি বলেন, “এটা শোনায় অনেকটা স্ববিরোধিতার মতো। আমরা মনে করি যে আমরা সবসময় যা চাই তা পেলে আমাদের জীবন সুখের হওয়া উচিত।”
কিন্তু বাস্তবে তা হয় উল্টো। সবকিছু পেলেই জীবন সুখের হয় না।
“এখন আমরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে যার যত বেশি আছে, তারা তত কম সুখী,” বলেছেন তিনি।
‘মগজের ভূত’
আমরা জানি যে, ডোপামিন হচ্ছে এক ধরনের রাসায়নিক যা আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরে তৈরি হয়। আমাদের আনন্দ, ভাল লাগা এবং প্রেরণার মতো সুখের অনুভূতিগুলো তৈরির পেছনে ডোপামিন কাজ করে।
আমাদের মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট জায়গা, যাকে ‘রিওয়ার্ড পাথওয়ে’ বলে, সেখানে যত বেশি ডোপামিন নিঃসরণ ঘটে, বিভিন্ন বস্তু বা অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের অনুভূতি ততই আনন্দদায়ক হয়।
গত ৭৫ বছরে নিউরোসায়েন্সের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ আবিষ্কারগুলির মধ্যে একটি হলো, মস্তিষ্কের একই অংশ যা আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে, একইসাথে সেগুলি ব্যথার অনুভূতিও তৈরি করে। এটা আমাদের অনুভূতিতে ভারসাম্যের কাজ করে।
কেউ যদি চকোলেট খায়, তখন তার মস্তিষ্কে স্বল্প পরিমাণে ডোপামিনের নিঃসরণ ঘটে। কিন্তু খুব শিগগিরই মস্তিষ্ক চকোলেট খাওয়ার আনন্দের সাথে খাপ খাইয়ে নেয় এবং ডোপামিন নিঃসরণকে কমিয়ে দেয়। এটা অনেকটা রোলার কোস্টারের মতো, যেটি একবার ওপরে উঠে যায় এবং আরেকবার নীচে নেমে আসে।
‘আমি শুধু একদিন রোজা রাখি’
“আমরা জানি যে সোশ্যাল মিডিয়ার কন্টেন্ট নির্মাতারা বেশি বেশি ডোপামিন তৈরি করতে যত বেশি সম্ভব স্টিম্যুলেশন ব্যবহার করেন,” জেমস সিনকা বলছেন। এবং এখন বাজারে এত বেশি প্রক্রিয়াজাত খাবার পাওয়া যায় মানব ইতিহাসে তা আগে কখনও ছিল না।
অন্যদিকে, তিনি বলছেন, পর্নোগ্রাফিও ‘অত্যন্ত উদ্দীপক’ হিসেবে কাজ করে এবং ইন্টারনেটের গতির সাথে তাল মিলিয়ে এই ধরনের বিষয়বস্তুর অ্যাক্সেস পাওয়াও এখন সহজ হয়ে পড়ছে।
গাঁজা বা মারিউয়ানার মতো মাদকের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। “৫০ বা ১০০ বছর আগের তুলনায় এগুলো এখন ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী ও মারাত্মক,” বলছেন তিনি।
এসবের বিরুদ্ধে সিনকার রক্ষাকবজ হচ্ছে রোজা বা উপবাস।
“যখন আমি ডোপামিন উপবাস করি, তখন আমি সেটা করি একদিনের জন্য। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর সারাদিন আমি যা করি তা হলো ধ্যান করা, লেখালেখি করা, কিছু জল পান করা, নিয়মিত হাঁটা এবং চিন্তা করা।”
কিন্তু রোজা রাখা বা উপবাসের বিধান নতুন কিছু না। বিশ্বের সব ধর্মেই উপবাসের প্রচলন রয়েছে, এবং শত শত বছর ধরে এটা চলছে।
জেমস সিনকা মনে করছেন, আধুনিক বিশ্বে এই উপবাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ “আমাদের উত্তেজিত করে এমন কারণগুলো আমরা এমনভাবে তৈরি করেছি যা মানব ইতিহাসে কখনও ছিল না।”
উপবাসের সুযোগকে তিনি আত্ম-অন্বেষণ অর্থাৎ নিজেকে খুঁজে পাওয়ার উপায় হিসাবে ব্যবহার করেন।
“নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে কিছুটা একা থাকার কিংবা একেবারেই বোর হওয়ার মধ্যে একটি জৈব-রাসায়নিক, মনস্তাত্ত্বিক, বিবর্তনীয় মূল্য রয়েছে।”
বৃহত্তর আনন্দের খোঁজ
আদিম মস্তিষ্কের গঠন কাঠামো, যা বেশি বেশি আনন্দ পেতে চায় এবং যতটা সম্ভব ব্যথা এড়িয়ে চলতে চায়, সেটিতে পরিবর্তন ঘটেছে মানব ইতিহাসের অভাব এবং বিপদের পরিবেশের মধ্যে বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে।
“মানব বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর মানেটা বোঝা যায়,” বলছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অ্যানি লেম্বকে।
“আপনি যদি এমন একটি পরিবেশে থাকেন যেখানে খাদ্য নেই, পানীয় জল নেই, তাহলে আপনি মারা যেতে পারেন। ফলে বেঁচে থাকার এই কৌশলের মধ্যে বুদ্ধিমত্তার ছাপ রয়েছে।”
তিনি সতর্ক করছেন: “কিন্তু যে বিশ্বে এখন কোকেনের মতো মাদক, সেক্স, ভিডিও গেমস – এ সবকিছু আপনি আপনার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সহজেই পেয়ে যেতে পারেন, সেখানে এই কৌশল এক ভয়ঙ্কর স্নায়বিক প্রক্রিয়া তৈরি করবে।”
এর মানে হলো, সমাজ হিসাবে আমরা দীর্ঘস্থায়ীভাবে শুধুমাত্র আনন্দের দিকে ঝুঁকে পড়ছি, তিনি বলছেন, “কিছু একটা অনুভব করার জন্য আমরা আরও শক্তিশালী আনন্দের খোঁজ করে চলেছি।”
“কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের গঠন, আমাদের মগজের রিওয়ার্ড সার্কিট্রিতে পরিবর্তন, এটা প্রায় অসম্ভব,” লেম্বকে বলছেন।
মানুষের বিবর্তনের লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মস্তিষ্ক তার এই রিওয়ার্ড সার্কিট্রিকে সংরক্ষণ করে চলেছে। আসলে, মানুষের মস্তিষ্কের আনন্দ-বেদনা অনুভবের ব্যবস্থাটি টিকটিকি কিংবা প্রকৃতির অন্যান্য জীবের মতোই।
ফলে মস্তিষ্কের গঠনে যেহেতু কোন পরিবর্তন ঘটছে না, তাই আমাদের জন্য যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো আমাদের আমাদের দেহ-মনের ইকোসিস্টেমকে পরিবর্তন করা।
‘মগজের জন্য আগাম পুরষ্কার’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অ্যানি লেম্বকের মতে, ডোপামিন উপবাস নিশ্চিতভাবে মস্তিষ্কের পুরষ্কার দেয়ার পথগুলিকে নতুন করে তৈরি করে।
প্রশ্ন হলো, উপবাস শেষে আপনি যখন আপনার দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যাবেন তখন আপনি কী করবেন?
“আমি গত ২০ বছর ধরে বিভিন্ন আচরণ বা বিভিন্ন নেশার বস্তুতে আসক্ত লোকদের সাথে কাজ করতে গিয়ে যা করেছি তা হলো ভিন্ন ধরনের ডোপামিন উপবাস।
“আমি বলছি না যে আপনাকে যা আনন্দ দেয় তার প্রতিটি অভিজ্ঞতা থেকে আপনাকে বিরত থাকতে হবে, তবে আমি শুধু সেই নির্দিষ্ট আচরণ বা পদার্থটিকে সনাক্ত করতে বলছি যার কারণে আপনার সমস্যা হচ্ছে,” ব্যাখ্যা করছেন তিনি।
সেই সমস্যায় ভোগা লোকদের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অ্যানি লেম্বকের পরামর্শ হচ্ছে, ৩০ দিনের জন্য সেই সমস্ত আনন্দদায়ক আচরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখুন।
তিরিশ দিন প্রয়োজন কারণ এই সময়ের মধ্যে স্নায়ুব্যবস্থা তার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য উপযুক্ত ভারসাম্য খুঁজে পায়।
“আমি আমার রোগীদের যে পরামর্শ দেই তা হলো, তারা যেন পরোক্ষভাবে ডোপামিন পেতে পারেন,” বলছেন তিনি।
তিনি বলছেন, প্রথমে ব্যথার দিক – যেমন ব্যায়াম করার মতো শারিরীক পরিশ্রম বা কোনকিছুতে ত্যাগ স্বীকার করার মতো মানসিক প্রস্তুতি – নিজের মধ্যে এরকম কিছু কাজের উদ্দীপনা তৈরি করা যাতে আপনার ব্যথার প্রভাবের ক্ষতিপূরণ হিসেবে মস্তিষ্ক আপনাকে ডোপামিন দিয়ে পুরস্কৃত করে।
“এটি অনেকটা আগাম অর্থ প্রদানের মত,” বলছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অ্যানি লেম্বকে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।