মোঃ রাকিবুল ইসলাম: অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত রাজধানী। নানান প্রকল্পের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে গাছপালা, জলাশয়, খাল, ডোবা-নদী-নালা। এতে পরিবেশ বিপর্যয়ে পড়েছে ঢাকা। প্রতিদিন বাড়ছে দূষণ। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা। এসব নিয়ন্ত্রণে নেই কোন পদক্ষেপ। গ্রামের তুলনায় ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে সাড়ে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। সবুজায়ন কমেছে প্রয়োজনের তুলনায় ১২ শতাংশ। পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু। এতে করে দেশে ঘূর্ণিঝড়, বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির সাথে মানুষের প্রাণহানি বাড়ছে। কমছে গড় আয়ু। হুমকিতে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।
এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, এখনি বৃক্ষশুমারি, নগর সবুজায়ন নীতিমালা ও কৌশলপত্র প্রণয়ন, ফুটপাথ পুনঃবিন্যাস, বৃক্ষ সংরক্ষণ ও রোপণে গুরুত্বারোপে মনোযোগী না হলে একসময় ঢাকায় বসবাস অসম্ভব হয়ে পড়বে।
অপরদিকে উন্নয়নের নামে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সারাবছরই লেগে থাকে খোঁড়াখুঁড়ির উৎসব। এমনিতেই অপরিকল্পিত যানবাহন ব্যবস্থাপনার কারনে যানজটে নাকাল নগরবাসী। তার ওপর এসব খোঁড়াখুঁড়ি জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। শুধুমাত্র যানজটের কারনে ঢাকায় বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকার জ্বালানি অপচয় হয়। এই অতিরিক্ত জ্বালানি পোড়ানোর কারনে ঢাকার বায়ুমণ্ডল ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে পরছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে বলে আশংকা করছে বিশেষজ্ঞরা। উন্নয়নের নামে নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে ঢাকার আশে পাশের বনভূমি ও কৃষিজমি। এতে জীব্-বৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। প্রাণী ও কীটপতঙ্গরা তাদের আবাস্থল হারিয়ে লোকালয়ে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রকিবুল আমিন বলেন, প্রাণীরা তার নিজস্ব পরিবেশে বাঁচতে চায়। এরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষের নানা উপকার করে থাকে। কিন্তু উন্নয়নের নামে অত্যাধিক হারে বন নিধনের কারণে বন্যরা মানুষের কাছাকাছি চলে আসছে যার মাধ্যমে মানবদেহে ছড়াচ্ছে প্রাণঘাতী ভাইরাস। করোনা মহামারী চোখে আঙুল দিয়ে এ বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়েছে।
নগরবিদ ও বাপার যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিবের অভিযোগ, ঢাকাসহ সারা দেশে উন্নয়নের নামে পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষনিধন চলছে। রাস্তার সংস্কার, বৃদ্ধি, নতুন রাস্তা তৈরি কিংবা রামপাল তাপবিদুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য মেগা প্রকল্পের নামে দেশব্যপী বৃক্ষনিধনের মহোৎসব লক্ষ করা যাচ্ছে। তিনি জানান, বৃক্ষনিধনের ফলে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে বজ্রপাতের মতো দুর্যোগ। সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতে মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। এ ছাড়াও আমেরিকান গবেষকদের মতে পৃথিবীতে বজ্রপাতে যে পরিমাণ মানুষ প্রাণ হারায় তার এক-চতুর্থাংশ ঘটে বাংলাদেশে।
বৃক্ষনিধনের পরিবেশগত প্রভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও হিট আইল্যান্ড এফেক্ট বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস), অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিভাগের এক যৌথ গবেষণার তথ্য মতে, ঢাকা শহরে গ্রামের থেকে সাড়ে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি থাকে। গবেষণার তথ্যমতে, ঢাকার উষ্ণতম স্থানের সাথে শহরের বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এলাকার সাথে দিন-রাতের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার পার্থক্য যথাক্রমে ৭ ও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণা অনুসারে, ঢাকা মহানগরে ২০ শতাংশ সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন অথচ আছে সাড়ে ৮ শতাংশের কম।
গত বছরের গ্লোবাল এয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম স্থানে। বায়ুদূষণে বাংলাদেশে গড় আয়ু কমেছে ২.৯ বছর। আর মৃত্যুর শীর্ষ পাঁচ ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম বায়ুদূষণ। এর মধ্যে দূষণজনিত মৃত্যুর হার ১৮ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু এবং ২২ শতাংশ ৭০ বছরের বেশি বয়স্কদের। বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে বৃক্ষনিধন রোধে ২০১৬ সালের বৃক্ষ সংরক্ষণ আইন এখনো কার্যকর হয়নি। সরকার যখন উন্নয়নের পরিকল্পনা করে তখন তা জনগণকে জানতে দেয় না। তিনি বলেন, সাতমসজিদ সড়কের ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী গাছ কেটে তদস্থলে বাগানবিলাস গাছ লাগিয়ে ধানমন্ডিবাসীর সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। গাছ কাটার পেছনে আর্থিক বাণিজ্য কাজ করছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে এমন গাছ রোপণ, সংরক্ষণ এবং বড় গাছ রক্ষার আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান।
একটি গাড়ি ২৫ হাজার কিলোমিটার চললে যে দূষণ হয় তা একটি বড় গাছ শোষণ করতে সক্ষম উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, পরিবেশবিদ, অধ্যাপক ড. তাওহীদা রশীদ জানান, গাছের অভাবে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়, বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পায় বহু গুণে। ত্রিশ বছরের একটি গাছ প্রতিদিন ৫০০ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করে।
বৃক্ষনিধন বন্ধে তিন প্রস্তাবনা এবং ১২ দাবি তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা। এরমধ্যে রয়েছে বৃক্ষশুমারি, নগর সবুজায়ন নীতিমালা ও কৌশলপত্র প্রণয়ন এবং ফুটপাথ পুনঃবিন্যাস, বৃক্ষ সংরক্ষণ ও রোপণ। পরিকল্পনাহীনভাবে সড়কদ্বীপে গাছ কাটা বন্ধ। কেটে ফেলা গাছ প্রতিস্থাপন। রোপণকৃত গাছের সঠিক সংরক্ষণ। নগরে বনায়ন, গাছ রক্ষা ও কাটার প্রয়োজনে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা ও কৌশলপত্র প্রণয়ন। যেকোনো প্রকল্প গ্রহণে আইনগতভাবে অবশ্য করণীয় পরিকল্পনা ও সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন নিশ্চিত করা। বৃক্ষনিধন হয় এ রকম যেকোনো প্রকল্পে অংশীজন-সভার মতো অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। বিদ্যমান গাছ ও সবুজকে যথাসম্ভব অক্ষুণ্ণ রেখে উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। নগর এলাকায় গাছ কাটার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন। অবকাঠামোগত ও নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রকৃতিভিত্তিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়া। বিদ্যমান আইনে বৃক্ষনিধন বন্ধে আরো কঠোর শাস্তির বিধান আরোপ। উপযুক্ত বৃক্ষশুমারির মাধ্যমে বিদ্যমান বৃক্ষের সংরক্ষণ ও নতুন বৃক্ষ রোপণের কৌশল নির্ধারণ নিশ্চিত করা এবং জীববৈচিত্র্যে ও প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রক্ষায় সাম্প্রতিক সময়ে গৃহীত সরকারি পদক্ষেপের যথাযথ বাস্তবায়ন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।