জুমবাংলা ডেস্ক : তারাবির নামাজ ওয়াজিব বা ফরজ নয়। বেশি থেকে বেশি এটাকে সুন্নত বলা যায়। সুন্নত নফল যাই হোক এর সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। রাসুল সা. তার জীবনের শেষ রমজানে দুই দিন অন্য বর্ণনামতে তিন দিন সাহাবিদের নিয়ে তারাবি আদায় করেছিলেন। তৃতীয় বা চতুর্থ দিন সব সাহাবি মসজিদে নববিতে রাসুল সা.-এর জন্য অপেক্ষা করেন।
যারা বিদগ্ধ জ্ঞানী তারা এই দুই মতের মাঝে বহু আগেই সমন্বয় করে গেছেন। মূলত দুটি বিপরীতমুখী হাদিস থেকে এই মতানৈক্যের সূত্রপাত।
কিন্তু রাসুল সা. ভোর পর্যন্ত হুজরার ভেতরেই থাকেন। ফজরের সময় সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা আমার জন্য সারা রাত অপেক্ষা করেছ, আমি দেখেছি, কিন্তু আমার আশঙ্কা হলো, আমি যদি তোমাদের আগ্রহে সাড়া দেই, তাহলে এই নামাজ তোমাদের ওপর ফরজ হয়ে যাবে। [বুখারি ১১২৯] তিরমিযি ও আবু দাউদের বর্ণনায় আরও উল্লেখ হয়েছে যে, রাসুল সা. যে দু-তিন দিন তারাবি আদায় করেছিলেন তা এতটা দীর্ঘ ছিল যে, সাহাবিদের সেহেরির সময় শেষ হয়ে যাচ্ছিল প্রায়।
রাসুল সা. কত রাকাত তারাবি পড়েছিলেন? এ প্রশ্ন বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুব গুরুত্বপূণ মনে হয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে সেসময় এটি মোটেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এই দুই-তিন দিন রাসুল সা. প্রায় সারা রাত তারাবি আদায় করেছিলেন। রাকাত সংখ্যা সেখানে মুখ্য ছিল না। এজন্যই কোনো বর্ণনায় বিষয়টির উল্লেখ নেই।
সাহাবিদের কাছে তারাবির নামাজের রাকাত সংখ্যা গুরুত্ব পায়নি। রাসুল সা. যদি বিশ বা আট কোনো একটি সংখ্যার গুরুত্ব দিতেন তাহলে অবশ্যই সব সাহাবি সেটি অনুসরণ করতেন। প্রিয় নবী থেকে স্পষ্টভাবে কিছু বর্ণিত হলে এ নিয়ে আজ এতকাল পরে এসে মতভেদের কোনো সুযোগ থাকত না। কাজেই প্রথম কথা হচ্ছে, তারাবির নামাজের মর্মটা বুঝতে হবে।
রমজানে রাসুল সা. রাতের নামাজের জন্য উৎসাহিত করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন, যে ব্যক্তি রমজানের রাতে নামাজ আদায় করবে আল্লাহ তায়ালা তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন। [বুখারি ও মুসলিম] এতটাই ফজিলতপূর্ণ তারাবির সালাত; যেই নামাজে সব পাপ মাফ হয়ে যায়। নফল নামাজ কবুল হওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ যুক্তিতেই বুঝে আসে- পরিমাণের চেয়ে কোয়ালিটি অধিক গুরুত্বপূণ। সাহাবিরাও তাই বুঝেছিলেন। এজন্য সেসময় এ নিয়ে কোনো বিবাদের কথা শোনা যায়নি। তবু আমাদের সময়ে আরব অনারব সর্বত্র তারাবির নামাজের রাকাত সংখ্যা নিয়ে যে মতভেদ দেখা যাচ্ছে তার মূল বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে।
এই সব মতানৈক্যের সার কথা হচ্ছে এ বিষয়ে স্কলাররা দুটি দলে বিভক্ত হয়েছেন। একদল মনে করেন, তারাবির নামাজ আট রাকাত। এর চেয়ে বেশি আদায় করা যাবে না। এর চেয়ে বেশি পড়লে সেটি বিদআত হবে। হজরত উমর নিজেই এটিকে বিদআত বলেছেন।
আরেক দল মনে করেন, তারাবি বিশ রাকাত। এর চেয়ে কম পড়ার সুযোগ নেই। কারণ হজরত উমর রা. যখন বিশ রাকাত তারাবি চালু করেন তখন সব সাহাবি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা কেউ এর প্রতিবাদ করেননি। কাজেই বিশ রাকাত ইসলামি শরিয়তে নির্ধারিত হয়ে গেছে।
দুইপক্ষেই এ নিয়ে চরম বাড়াবাড়িও করে থাকেন। তবে যারা বিদগ্ধ জ্ঞানী তারা এই দুই মতের মাঝে বহু আগেই সমন্বয় করে গেছেন। মূলত দুটি বিপরীতমুখী হাদিস থেকে এই মতানৈক্যের সূত্রপাত। দুটির একটি হজরত উমরের ঘটনা। হজরত উমর তার আমলে মসজিদে নববিতে সবাইকে জমায়েত করে দুজন ইমাম নির্ধারণ করে দেন। তারা বিশ রাকাত তারাবি পড়াতেন।
অপর হাদিস হজরত আয়শা রা. থেকে বর্ণিত। বিখ্যাত তাবেয়ি আবু সালামা ইবন আব্দুর রহমান একবার হজরত আয়শা রা. কে জিজ্ঞেস করলেন, রাসুল সা.-এর রমজানের নামাজ কেমন ছিল? হজরত আয়শা বললেন, রাসুল সা. রমজান বা রমজানের বাইরে কখনও এগার রাকাতের বেশি আদায় করতেন না। প্রথমে চার রাকাত আদায় করতেন, সেই চার রাকাত নামাজ কত যে দীর্ঘ হতো এবং কত যে সুন্দর হতো তা তুমি জিজ্ঞেস কর না। তারপর আবার চার রাকাত আদায় করতেন। এই চার রাকাতও কত সুন্দর এবং কত দীর্ঘ হতো সে বিষয় তুমি ভাবতেও পার না। এরপর তিন রাকাত বিতর পড়তেন। [বুখারি, হাদিস নং ১৯০৯] এই ছিল রাসুল সা.-এর নামাজ। তবে অন্য অনেক বর্ণনায় এগারো ছাড়াও আরও অনেক সংখ্যার কথা আছে। তাই হাদিসের ভাষ্যকারগণ দাবি করেন, হজরত আয়শার হাদিসে রাসুল সা.-এর রাতের নামাজের যে বিবরণ এসেছে তা অধিকাংশ সময়ের হিসাবে। তা না হলে কখনও এর চেয়ে বেশি বা কিছু কমও আদায় করেছেন বলে প্রমাণিত।
বিশ রাকাতের পক্ষের লোকেরা হজরত আয়শার হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, এটি তারাবির নামাজের বিবরণ নয়। বরং এটি তাহাজ্জুদ নামাজের বিষয়ে বর্ণিত।
আট রাকাতের পক্ষের লোকেরা বলেন, এর বাইরে রাসুল সা. পৃথক কোনো নামাজ পড়েছেন বলে কোনো প্রমাণ নেই। যেই দুই দিন বা তিন দিন প্রিয় নবী তারাবি পড়েছেন বলে উপরে উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে তিরমিযির বর্ণনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে- তারাবি পড়তে পড়তে তাহাজ্জুদের সময় পার হয়ে গিয়েছিল। যদি দুটি আলাদা হতো তাহলে এক রাতে দুটি ভিন্ন ভিন্ন সুন্নাতের উল্লেখ থাকতো।
দুই পক্ষেই অনেক যুক্তি তর্ক রয়েছে। কিন্তু দু’পক্ষের অতিরঞ্জনের মাঝে দাঁড়িয়ে বিদগ্ধ আলেমগণ যে কথাটি বলেন, তা অধিক যুক্তিযুক্ত। শুরুতে যে কথাটি বলে এসেছি, রাকাত সংখ্যা নয়, বরং গুরুত্ব দেয়া উচিত নামাজের অবস্থা। অন্য ভাষায় বললে পরিমাণের চেয়ে মাণের গুরুত্ব হওয়া কাম্য।
হজরত আয়শা ও হজরত উমরের হাদিসের মাঝে সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। আর তা এ কারণে যে, হজরত উমর কোনো শরিয়ত বিরুদ্ধ কাজ করতে পারেন না। তিনি রাসুল সা.-এর প্রিয় সাহাবি ছিলেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা তিনি। রাসুল সা. বলেছেন, তোমরা আমার ও আমার খলিফাদের সুন্নাহকে আকড়ে ধর। সেই হিসেবে বিশ ও আট উভয়টির মাঝে সমন্বয়ের পথ খোঁজা উচিত। ইবনু আব্দুল বার ইবনু তাইমিয়া ও ইমাম সুয়ুতি প্রমুখ বিখ্যাত মনীষীগণ সেই চেষ্টা করেছেন। তাদের কথা যৌক্তিক মনে হয়।
তারা বলেন, রাসুল সা. আট রাকাত পড়তেন, কিন্তু সেই রাকাত হতো অনেক দীর্ঘ। সাধারণ মুসল্লিদের জন্য যা কষ্টকর। এজন্যই হজরত উমর মানুষের জন্য সহজ করতে দীর্ঘ কেরাতের বদলে রাকাত সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন কেউ যদি দীর্ঘ কেরাত পড়তে চায় তাহলে তার জন্য আট রাকাত যথেষ্ট। আর যদি কেউ সহজ করতে চায় তাহলে কেরাত ছোট করে বিশ রাকাত আদায় করবে। এভাবে বিচার করলে আশা করা যায় সমাজের এ বিষয়ক মতভেদের অবসান হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।