ভোর রাতের স্তব্ধতা ভেদ করে কেবলই শোনা যায় কান্নার আওয়াজ। চোখের জলে ভেজে যায় সিজদার স্থান। এ এক নিবিড় সাক্ষাতের মুহূর্ত – সৃষ্টিকর্তা ও বান্দার মাঝে। যখন গোটা দুনিয়া গভীর নিদ্রায়, তখনই জেগে ওঠে একদল প্রেমিক। তারা বেছে নেয় রাতের শেষ তৃতীয়াংশ, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের শ্রেষ্ঠ সময়। কিন্তু এই মহামূল্যবান ইবাদতের ভিত্তি কী? তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত – হৃদয়ের সেই আন্তরিক সংকল্প, যার সঠিক বোধগম্যতা ছাড়া ইবাদত পৌঁছায় না পূর্ণতার শিখরে। এটি শুধু মুখে উচ্চারিত শব্দ নয়; এটি হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত এক বানী, এক অনন্য আত্মসমর্পণ।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত: শব্দ নয়, হৃদয়ের ভাষা
“নিয়ত” শব্দটি শুনলেই মনে ভেসে ওঠে নামাজ শুরুর আগে মুখে উচ্চারিত কিছু আরবি শব্দের ছবি। কিন্তু ইসলামিক স্কলারদের মতে, তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত আসলে হৃদয়ের একটি অবস্থা, এক প্রকার আন্তরিক সংকল্প। প্রখ্যাত মুফাসসির ইবনে কাসীর (রহ.) তার তাফসীরে উল্লেখ করেছেন, “নামাজের মূল হল নিয়ত, কেননা আমল নিয়তের উপরই নির্ভরশীল” (তাফসীর ইবনে কাসীর, সূরা বাইয়্যিনাহ)।
বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত “নামাজ শিক্ষা” গাইডবুকেও (২০২৩ সংস্করণ) স্পষ্ট করা হয়েছে:
“নামাজের নিয়ত মুখে বলার বিষয় নয়, এটি অন্তরের কাজ। হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে এ সংকল্প থাকা জরুরি যে আমি আল্লাহর জন্য, এত রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করছি।”
তাহাজ্জুদে নিয়তের সূক্ষ্মতা:
- অন্তরের দিকনির্দেশনা: নিয়ত হল ইবাদতের গন্তব্য ঠিক করা। আপনি কী করছেন, কেন করছেন – এর স্পষ্টতা হৃদয়ে থাকতে হবে।
- একনিষ্ঠতা (ইখলাস): শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই নামাজ আদায় করার দৃঢ় সংকল্প। মানুষের দেখানো, রিয়া বা অহংকারমুক্ত।
- নির্দিষ্টতার অনুভূতি: অন্তরে এ ধারণা স্পষ্ট থাকা যে আপনি “তাহাজ্জুদের” নামাজ আদায় করছেন, যদিও এর রাকাত সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়।
সচরাচর ভুল ধারণা: অনেকে মনে করেন, তাহাজ্জুদের জন্য আলাদা করে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করতে হয়, যেমন: “নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া… সালাতান মিনাল কিয়ামি…” ফিকহের বিশিষ্ট গ্রন্থ “ফাতাওয়া আলমগীরী” (হানাফী মাযহাব অনুযায়ী) এবং “আল-মাজমু” (ইমাম নববী, শাফেয়ী মাযহাব) উভয়েই নির্দেশ করে যে নিয়তের স্থান হৃদয়। মুখে উচ্চারণ সুন্নত বা মুস্তাহাব পর্যায়ের, ফরজ নয়। বাংলাদেশের স্বনামধন্য আলেম, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা) তার এক বক্তব্যে বলেন, “নিয়তের নামাজ মুখে নয়, প্রাণে। তাহাজ্জুদ তো প্রেমের নামাজ, প্রেমিক কি প্রেমের ঘোষণা মুখে উচ্চারণ করে নেয়, নাকি হৃদয়ে বহন করে?”
তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের সঠিক পদ্ধতি: নিয়ত থেকে সমাপন পর্যন্ত
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত হৃদয়ে ধারণ করার পর আসে আদায়ের সঠিক পদ্ধতি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ মোতাবেক তাহাজ্জুদ আদায় করতে হলে কিছু ধাপ অনুসরণ করা জরুরি:
১. সময় নির্ধারণ: রাতের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত
- সুবহে সাদিকের আগের শেষ তৃতীয়াংশ: এ সময়কে আল্লাহর বিশেষ রহমত নাজিলের সময় বলা হয়েছে (সহীহ বুখারী ১১৪৫, সহীহ মুসলিম ৭৫৮)।
- ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: অনেকেই অনুভব করেন, রাত ৩টা থেকে ফজরের আজান পর্যন্ত সময়টায় মনোযোগ ও প্রশান্তি সবচেয়ে বেশি থাকে।
২. প্রস্তুতি: শারীরিক ও আত্মিক
- ঘুম থেকে জাগা: আস্তে উঠে অজু করুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু বকর সিদ্দিকের মতে, “হালকা পানির ঝাপটা মস্তিষ্ককে সতেজ করে এবং অজুর মাধ্যমে রুহানিভাবে প্রস্তুত হওয়া যায়।”
- দোয়া পড়া: ঘুম থেকে জেগে এই দোয়াটি পড়া সুন্নত:
“لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ. سُبْحَانَ اللَّهِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ”
অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো শরিক নেই। রাজত্ব তাঁরই, প্রশংসা তাঁরই, তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহ পবিত্র, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আল্লাহ মহান, আল্লাহর সাহায্য ও শক্তি ছাড়া কোনো উপায় ও শক্তি নেই। (সহীহ বুখারী ১১৫৪)
৩. নামাজ আদায়: রাকাত সংখ্যা ও পদ্ধতি
- রাকাত সংখ্যা: সর্বনিম্ন ২ রাকাত। রাসূল (ﷺ) সাধারণত ৮ বা ১১ রাকাত (বিতরসহ) আদায় করতেন (সহীহ বুখারী ৯৯৪, সহীহ মুসলিম ৭৩৬)। ২ রাকাত করে আদায় করা উত্তম।
- কিরাআত: ধীরে ধীরে, তিলাওয়াতের মাধুর্য নিয়ে সূরা ফাতিহার পর অন্য সূরা পড়ুন। দীর্ঘ কেরাতে পড়লে উত্তম, তবে সামর্থ্য অনুযায়ী।
- রুকু-সিজদা: প্রতিটি রুকু ও সিজদায় দীর্ঘ সময় নিয়ে তাসবীহ (সুবহানাল্লাহি রব্বিয়াল আযীম, সুবহানা রব্বিয়াল আ’লা) পড়ুন। এটিই তাহাজ্জুদের প্রাণ – আল্লাহর সামনে বিনয় ও ধৈর্যের প্রকাশ।
- দোয়া ও কান্না: বিশেষ করে সিজদার সময় অন্তর খুলে আল্লাহর কাছে নিজের দুর্বলতা, ক্ষমা প্রার্থনা ও প্রয়োজন মেটানোর দোয়া করুন। হাদীসে এসেছে, “বান্দা তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় সিজদার অবস্থায়।” (সহীহ মুসলিম ৪৮২)।
৪. বিতর নামাজ: তাহাজ্জুদের সমাপনী
তাহাজ্জুদের পর বিতর নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। এটি রাতের শেষ নামাজ।
তাহাজ্জুদ নামাজে নিয়ত ও পদ্ধতি সংক্রান্ত প্রচলিত ভুল ও সতর্কতা
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত ও আদায় পদ্ধতি নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা সমাজে প্রচলিত। সচেতন হওয়া জরুরি:
- ভুল: “তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত” মুখে উচ্চারণ না করলে নামাজ হয় না।
সঠিক: মুখে উচ্চারণ ঐচ্ছিক (মুস্তাহাব), ফরজ নয়। হৃদয়ের নিয়তই যথেষ্ট। - ভুল: তাহাজ্জুদের জন্য নির্দিষ্ট দোয়া বা সূরা পড়তে হয়।
সঠিক: ফজর নামাজের আগের নফল হিসেবে যেকোনো সূরা দিয়ে আদায় করা যায়। তবে দীর্ঘ কেরাত উত্তম। - ভুল: তাহাজ্জুদ শুধু রমজান মাসে পড়তে হয়।
সঠিক: তাহাজ্জুদ সারা বছর পড়ার জোরালো সুন্নত। রাসূল (ﷺ) রমজান ছাড়াও নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। - ভুল: তাহাজ্জুদ পড়তে হলে পুরো রাত জাগতে হবে।
সঠিক: রাতের শেষ তৃতীয়াংশে উঠলেই চলে। পর্যাপ্ত ঘুম জরুরি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষ পরামর্শ:
- শীতের রাত: গরম কাপড় পরে নামাজ পড়ুন, স্বাস্থ্য রক্ষা করা জরুরি।
- শব্দ: অন্যদের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে নামাজ আদায় করুন।
- অবস্থান: নিরিবিলি, পরিচ্ছন্ন স্থান বেছে নিন।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত ও আত্মিক প্রস্তুতি: অন্তর পরিশুদ্ধির উপায়
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত শুধু নামাজ শুরুর মুহূর্তের বিষয় নয়, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। হৃদয়কে তাহাজ্জুদের জন্য প্রস্তুত করতে:
- দিনের আমল: দিনে হারাম বা সন্দেহজনক কাজ থেকে বেঁচে থাকুন। হাদীসে আছে, “যে ব্যক্তি রাতে দাঁড়িয়ে (নামাজ) পড়ে, কিন্তু দিনে মন্দ কাজ করে, সে তার রবের সাথে ঠাট্টা করে।”
- অল্প খাবার: রাতে হালকা আহার করুন। পেট ভরে খেলে তাহাজ্জুদের জন্য ওঠা কঠিন হয়।
- ঘুমের নিয়ম: তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন। রাসূল (ﷺ) এশার পর দেরি না করে ঘুমাতে উৎসাহিত করেছেন।
- দোয়া: আল্লাহর কাছে নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায়ের তাওফিক চান।
আধুনিক গবেষণা ও তাহাজ্জুদ:
যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২ সালের একটি গবেষণা (Journal of Religion and Health) তুলে ধরে যে ভোররাতের ধ্যান বা প্রার্থনামূলক কার্যক্রম (যেমন তাহাজ্জুদ):
- মানসিক চাপ (Cortisol লেভেল) উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়।
- আবেগিক স্থিতিশীলতা ও মনোযোগ বৃদ্ধি করে।
- আত্ম-সচেতনতা ও জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করে।
(সূত্র: Cambridge University Press, DOI: 10.1017/S003329172200009X)
জেনে রাখুন (FAQs)
প্রশ্ন: তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত কি বাংলায় পড়া যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, নিয়তের মূল স্থান হৃদয়। তাই আপনি যদি আরবি না জানেন, তাহলে বাংলায় হৃদয়ে এ সংকল্প করতে পারেন: “আমি আল্লাহর জন্য দুই রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছি।” মুখে বলার প্রয়োজন নেই। তবে আরবিতে বললে তা মুস্তাহাব।
প্রশ্ন: তাহাজ্জুদ পড়ার সময় মনে অনেক চিন্তা আসে, নিয়ত ঠিক থাকে না, কী করব?
উত্তর: এটা খুব স্বাভাবিক। শয়তান বাধা দেয়। নামাজের শুরুতে “আউযুবিল্লাহ…” পড়ুন। মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে ধীরে ধীরে কিরাআত পড়ুন, অর্থ চিন্তা করুন। চিন্তা এলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান। ধীরে ধীরে মনোযোগ বাড়বে।
প্রশ্ন: তাহাজ্জুদের সময় কতটুকু কোরআন তিলাওয়াত করব?
উত্তর: কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সামর্থ্য অনুযায়ী পড়ুন। রাসূল (ﷺ) কখনও দীর্ঘ সূরা (যেমন: সূরা বাকারা), কখনও ছোট সূরা পড়তেন। নিয়মিত পড়ার অভ্যাস করুন। দীর্ঘ তিলাওয়াত বেশি সওয়াবের।
প্রশ্ন: তাহাজ্জুদের জন্য ঘুম থেকে জাগতে পারি না, কী করব?
উত্তর: হতাশ হবেন না। প্রথমে নিয়্যত শক্ত করুন। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমান। অ্যালার্ম ব্যবহার করুন। আল্লাহর কাছে সাহায্য চান। একদিন উঠতে পারলে আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে। সামান্য সময় (২ রাকাত) নিয়েও শুরু করুন।
প্রশ্ন: মহিলাদের জন্য তাহাজ্জুদের বিশেষ কোন নিয়ম আছে কি?
উত্তর: মূল নিয়ম পুরুষ ও মহিলাদের জন্য একই। তবে মহিলারা ঘরে একাকী পড়বেন, যা বেশি নিরাপদ ও শ্রেয়। হায়েজ-নেফাসের সময় তাহাজ্জুদ পড়া যায় না।
প্রশ্ন: তাহাজ্জুদ পড়লে কি সব দুঃখ-কষ্ট দূর হয়?
উত্তর: তাহাজ্জুদ আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। এটি দুঃখ-কষ্ট দূর করার গ্যারান্টি নয়, বরং তা সহ্য করার শক্তি ও আল্লাহর সাহায্য লাভের পথ। আল্লাহর কাছে প্রার্থনার মাধ্যমেই অন্তরের প্রশান্তি আসে।
(শেষ অনুচ্ছেদ – কোন হেডিং ছাড়া)
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত কেবল একটি আনুষ্ঠানিক সূচনা নয়; এটি হৃদয়ের গভীরে নিহিত সেই অদৃশ্য সেতু, যা বান্দাকে তার রবের সাথে সংযুক্ত করে। এটি একান্তে কাঁদার, ক্ষমা চাওয়ার, নিজের সবটুকু নিংড়ে দেওয়ার অনন্য সুযোগ। রাতের আঁধারে উঠে দাঁড়ানো এই ইবাদত আপনার জীবনকে দিতে পারে এক নতুন মাত্রা – আত্মশুদ্ধি, অন্তর্দৃষ্টি এবং আল্লাহর অপার রহমতের নিশ্চয়তা। নিয়তকে হৃদয়ে পুষে, সুন্নাহ মোতাবেক সঠিক পদ্ধতিতে তাহাজ্জুদ আদায়ের মাধ্যমে খুঁজে নিন সেই প্রশান্তি, যা দুনিয়ার কোন ধন-দৌলত দিতে পারে না। আজ রাতেই শুরু করুন না কেন? একটু চেষ্টা, একটু ইচ্ছাশক্তি – আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই আসবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।