জুমবাংলা ডেস্ক : সময়টা ছিল তখন ১৯৭১ এর আগষ্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ, অবরুদ্ধ পুরো ঢাকা। টহল চলছে পাকিস্তানি বাহিনীর। মোড়ে মোড়ে তল্লাশি চৌকি। বিকট শব্দ তুলে এগিয়ে যায় মিলিটারি ট্রাক। কড়া পাহারা। এর মধ্যেই ঢাকায় ঢুকে পড়েছিল দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধারা। সেই যোদ্ধাদের একজন ছিলেন জুয়েল, ক্রিকেটার হিসেবেই ছিল যার নামডাক তখন। আসল নাম আবদুল হালিম চৌধুরী।
একদিন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের পাকিস্তানি ঘাটিতে হামলা করতে গিয়ে আহত হন হালিম। যেখানে হাতের আঙুল গুলিবিদ্ধ হয় তার। সেই আঙুলের চিকিৎসা চলাকালে চিকিৎসকের কাছে এভাবেই কাকুতি মিনতি করতে থাকেন টগবগে এই তরুণ।
হালিম বলতে থাকেন, ‘প্লিজ স্যার, আমার আঙ্গুল তিনটা রাইখেন। দেশ স্বাধীন হলে আমি ওপেনিংয়ে নামব, ক্যাপ্টেন হব’।
তার এমন কাকুতি-মিনতি প্রমাণ করে তিনি দেশের জন্য, দেশের ক্রিকেটের জন্য কতটা আত্মনিবেদিত ছিলেন। একজন ক্রিকেটার হয়েও যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন শোষণমুক্ত এক বাংলাদেশের। স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলার হয়ে বাইশ গজে নামার। অথচ সেই আঘাতপ্রাপ্ত হাতে ছিল তীব্র যন্ত্রণা! কিন্তু জুয়েলের ভাবনা জুড়ে শুধুই দেশের স্বাধীনতা।
শিয়রে থাকা বোনের কাছে জুয়েল একটাই প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন, বার বার বলছিলেন, আঙুলগুলো ঠিক না হলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ক্রিকেট খেলব কী করে? বলো তো!
জুয়েল ছিলেন স্বাধীনতা পূর্বের বাংলাদেশের উইকেট কিপার ব্যাটারম্যান। দীর্ঘ দিন খেলেছেন পাকিস্তানের কায়েদে আজম ট্রফিতে, প্রথম শ্রেণির ম্যাচে। কিন্তু যথেষ্ট প্রতিভা থাকার পরেও জুয়েল ছিলেন অবহেলিত। কারণ তিনি যে ছিলেন বাংলার ছেলে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান টিমে খেলা সম্ভব ছিল না বাঙালি প্লেয়ারদের। ২৫ মার্চ কালো রাতে যখন বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত বাঙালির উপর ঝাপিয়ে পড়ে, তখন জুয়েল ছিলেন ক্যারিয়ারের মধ্যমালগ্নে।
তৎকালীন আজাদ বয়েজ ক্লবের হয়ে খেলতেন জুয়েল। যুদ্ধের আগে অবশ্য খেলেছিলেন মোহামেডানের হয়ে। ১৯৬৯ সালে যখন পাকিস্তানে তিনটি টেস্ট খেলতে এসেছিল নিউজিল্যান্ড, তখন পাকিস্তান দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু মূল দল পর্যন্ত আর পৌঁছাতে পারেননি তিনি। ১৯৬৬ সালের ২১ মে প্রথম শ্রেণিতে অভিষেক হয় জুয়েলের। খেলেছেন মোট ৭ ম্যাচ। এই ফরম্যাটে ঢাকা দল, পূর্ব পাকিস্তান ও পাকিস্তান হোয়াইটের হয়ে ২১.৫৮ গড়ে মোট ২৫৯ রান করেছিলেন জুয়েল।
আজাদ বয়েজের প্রতিষ্ঠাতা মোশতাকের সাথে জুয়েলের ছিল দারুণ সখ্যতা। জুয়েলসহ আরো অনেককেই খেলায় এনেছিলেন ‘মোশতাক ভাই’। আজাদ বয়েজ ক্লাব গড়ে তুলেছিলেন নিজের সবটুকু দিয়ে। বড় কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই গড়ে ওঠা এই ক্লাবটি ওই সময় ঢাকা লিগ জিতেও চমকে দিয়েছিল অনেককে।
ক্রিকেট আর খেলাপাগল মানুষটা বিয়েও করার সুযোগ পাননি। খেলাই ছিল তার সংসার। শুধু খেলার জন্যই নয়, মানুষ হিসেবেও মোশতাক ছিলেন সবার প্রিয়। অচেনা কাউকে মুহূর্তেই আপন করে নিতেন তিনি। সেই সময় এলাকার সবাই জানতেন, বায়তুল মোকাররম মসজিদে এমন জানাজা খুব কম আছে, যাতে তিনি উপস্থিত থাকতেন না। মৃত মানুষটাকে হয়তো তিনি চেনেনই না কিন্তু তার জন্যও তো দোয়া করতে হবে।
অথচ ২৫ মার্চ থেকে নিখোঁজ সেই মোশতাকের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেল ২৭ মার্চ। জেলা ক্রীড়া পরিষদ ভবনের সামনে জুয়েল খুঁজে পেলেন তার নিস্পন্দ-নিথর দেহটা। বুলেটে ক্ষতবিক্ষত। মাটি ভেসে গেছে রক্তে। অচেনা কারো জানাজাতেও ঠিক হাজির হয়ে যাওয়া মানুষটার কপালেই জানাজা জুটল না!
এমন ঘটনায় একমুহূর্তের জন্যও নিজেকে আর আটকে রাখতে পারেনি জুয়েল নিজেকে। একদিকে নিজে ছিলেন অবহেলিত, অন্যদিকে প্রিয় মানুষকে হারানোর শোক। যে দৃশ্য মন থেকে মুছে ফেলতে পারেন না কিছুতেই। এই দৃশ্য তাকে ঘুমোতে দেয় না। জুয়েল ঠিক করে ফেলেন, নিতে হবে প্রতিশোধ। শোককে পুঁজি করে মনস্থির করলেন অনেক হয়েছে, আর নয়, ক্রিকেটের ব্যাট প্যাড খুলে রাখলেন। প্রতিজ্ঞ হলেন দেশটাকে জয় করেই ক্রিকেট খেলতে নামবেন ।
কিন্তু এই যাবার পথটা সহজ ছিল না। মমতার আঁচলে আটকে রাখতে চেয়েছিলেন মা ফিরোজা বেগম। স্বামীহারা এক নারী একমাত্র ছেলেকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন বুকের মাঝে। জুয়েল নাকি মাকে বলতেন, অসুবিধা কী, আম্মা। আমি যখন থাকব না, আপনি দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা আমার ছবিটা দেখবেন। কিন্তু তবুও মা রাজি না হওয়ায় একদিন যুদ্ধে যাবেন বলে জুয়েল পালিয়ে যান বাড়ি থেকে।
১৯৭১ সালের মে মাস। ট্রেনিং নিতে ত্রিপুরার মেঘালয়ে চলে যান তিনি। সফল ট্রেনিং শেষে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরে। ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গড়া হয় দুর্ধর্ষ ‘ক্র্যাক প্লাটুন’। সেই দলের গেরিলা ইউনিটের সদস্য ছিলেন তিনি।
সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের সেই পাকিস্তানি ঘাটিতে হামলা করতে গিয়ে হাতের আঙুলে গুলিবিদ্ধ জুয়েল চিকিৎসার জন্য অবস্থান নিয়েছিলেন সহযোদ্ধা আজাদের বাড়িতে।
কিন্তু কিভাবে যেন জুয়েলের অবস্থান জেনে যায় পাক হানাদাররা। শুধু জুয়েল নয়, সেই রাতে তার সাথে আরো ছিলেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র কালজয়ী গানের সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ, আজাদ, বদি, রুমিসহ আরো বেশ কয়েকজন।
ক্র্যাক প্লাটুনের একজন অন্যতম সদস্য হওয়ার ফলে গোপন তথ্য পেতে পাকিস্তান বাহিনী জুয়েলকে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। যে হাত দিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন বাংলার হয়ে ব্যাট ধরবেন, সেই হাতের দু’টি আঙুল কেটে নেয়া হয় জুয়েলের। অসহ্য যন্ত্রনা সহ্য করা স্বত্বেও মুখ খুলেননি জুয়েল। নির্মম অত্যাচার শেষ পর্যন্ত আর তার শরীর বইতে পারেনি। ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর কোলে, চিরঘুমে।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭২ সালে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয় শহীদ জুয়েলকে। মিপুরের হোম অফ ক্রিকেটে যেই শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ড সবাই দেখতে পায় সবাই, তা এই মহান বীরের নামেই করা হয় নামকরণ।
ক্রিকেটার থেকে মুক্তিযোদ্ধা; বাঙালী কখনোই ভুলবে না জুয়েলের আত্মত্যাগের কথা। দেশপ্রেমের উজ্জল দৃষ্টান্ত হয়ে জুয়েল বেঁচে থাকবেন কোটি বাঙালির প্রাণে। জুয়েল বেঁচে থাকবেন পূর্বের আকাশে উদিত স্বাধীন সূর্যের মাঝে, জুয়েল বেঁচে থাকবেন সাকিব, মুশফিকদের বুনো উল্লাসে। সূত্র : নয়া দিগন্ত
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।