আন্তর্জাতিক ডেস্ক : পরপর তিনটি দেশ সফর করেছেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। ‘এশিয়া ট্যুরের’ অংশ হিসেবে ফিলিপিন্স এবং বাংলাদেশের পর তিনি যান নেপালে। নেপাল সফর শেষে বুধবারই তিনি দেশে ফিরে গেছেন। এর আগে, প্রত্যেক দেশেই দুই দিন করে অবস্থান করেন থানি।
জনশক্তি রপ্তানির গন্তব্য এবং জ্বালানি আমদানির অন্যতম উৎস হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশটির আমিরের সফরে বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা নিশ্চিত করার চেষ্টা ছিল ফিলিপিন্স, বাংলাদেশ ও নেপালের। বিভিন্ন প্রত্যাশার কথা আগে থেকেই বলে আসছিলেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। সেসবের মধ্যে বিনিয়োগ অন্যতম। কাতারের আমিরের সফরকে বাংলাদেশসহ অন্য দুটি দেশের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। কিন্তু, এই সফরের পেছনে কাতারের কী লাভ এবং উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
কাতারে অনুষ্ঠিত হয় ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ। দেশটিতে এত বড় কর্মযজ্ঞের জন্য প্রয়োজনীয় স্টেডিয়ামসহ অন্যান্য অবকাঠামো ছিল না। তাই, আয়োজক হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে শুরু হয় এসব অবকাঠামো নির্মাণের তোড়জোড়। বিশ্বকাপের সাথে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণে হাজার হাজার বিদেশি শ্রমিক যুক্ত হন। শ্রমিকদের বেশিরভাগই নেওয়া হয় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং ফিলিপিন্স থেকে।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাড়ে ছয় হাজারের বেশি শ্রমিক এসময় নিহত হন। সবচেয়ে বেশি মারা যান যথাক্রমে ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের নাগরিকরা। সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস এবং কাতারের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে সংবাদমাধ্যমটি। শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি এবারের সফরে কাতারের জনশক্তি আমদানির অন্যতম উৎসগুলোকেই রেখেছেন তালিকায়।
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, সফরসূচি থেকেই স্পষ্ট তারা জনশক্তির বিষয়টাকে সামনে রেখেই বিষয়টি সাজিয়েছেন। দুই দেশের পাঁচ সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) অন্যতম হলো জনশক্তি কর্মসংস্থান বিষয়ক। ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, মানব পাচার রোধ, যুব ও ক্রীড়া খাতে সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে ফিলিপিন্স ও কাতারের। নেপালেও দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বিনিয়োগের পাশাপাশি জনশক্তি রপ্তানি অগ্রাধিকার পেয়েছে বলে জানায়, বিবিসি নেপালি।
বাংলাদেশকে ঘিরে কাতারের স্বার্থ কী?
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার কাতারের আমির ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে যেসব বিষয়ে চুক্তি হয় সেগুলো হচ্ছে: বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে দ্বৈত কর পরিহার এবং রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধ, বাংলাদেশ সরকার এবং কাতার রাষ্ট্রের মধ্যে আইনি ক্ষেত্রে সহযোগিতা, কাতার এবং বাংলাদেশের মধ্যে সমুদ্র পরিবহন, বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে পারস্পরিক বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষা, এবং বাংলাদেশ-কাতার যৌথ ব্যবসায়িক পরিষদ প্রতিষ্ঠা।
আর দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের খাতগুলো হলো: জনশক্তি কর্মসংস্থান, বন্দর, বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা, যুব ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ। তবে, বাংলাদেশের একজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক মনে করেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কাতারের কাছে এখানে শুধু বাণিজ্য নয়, কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোও গুরুত্বপূর্ণ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহাব এনাম খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, কাতার ‘সুচিন্তিত ফ্রেমওয়ার্ক’ নিয়ে এগিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিযোগিতা তার মধ্যে কাতারের নিজস্ব একটা অবস্থান তৈরির আগ্রহ দেখতে পান অধ্যাপক সাহাব এনাম খান। অন্তত দুটি চুক্তিতে কূটনৈতিক প্রভাব বাড়াতে ভূমিকা রাখে এমন উপাদান আছে বলে মনে করেন মি. খান। এর একটি যৌথ ব্যবসায়িক পরিষদ প্রতিষ্ঠা। অন্যটি বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষা।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য মতে তৃতীয় সর্বোচ্চ মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাস দেশটিতে। “মধ্যপ্রাচ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে এই মুসলিম আইডেনটিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাতার যেহেতু, মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ, এখানে পলিটক্যাল এবং ডিপ্লোম্যাটিক ফুটপ্রিন্ট (উপস্থিতি) বাড়াতে চায় কাতার,” বলছিলেন মি. খান।
তবে, দু’জন সাবেক কূটনীতিক বলছেন, কাতারের মূল আগ্রহের জায়গা অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক। কূটনৈতিক বা আধিপত্য বিস্তারের নয়। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দুই দেশের মধ্যে যত চুক্তি হয়েছে, সবই ব্যবসা বাণিজ্যকে সহজ করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।” “সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সফরে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা থাকেন। তাদের আস্থা তৈরি হয়, তারা বিনিয়োগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেন,” যোগ করেন তিনি।
বন্দর ব্যবস্থাপনায় পরিচিতি আছে কাতারের প্রতিষ্ঠানগুলোর। বন্দর সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের ফলে এই খাতে নতুন সম্ভাবনা যুক্ত হয়েছে। তাছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির জ্বালানি রপ্তানির অন্যতম গন্তব্য বাংলাদেশ। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে আরো এক দশক কাতারের সাথে এলএনজি আমদানির চুক্তি আছে বাংলাদেশের।
বাংলাদেশকে ঘিরে চীন এবং ভারতের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব একটি বহুল আলোচিত বিষয়। তাছাড়া, ওই অঞ্চলকে ঘিরে ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। অধ্যাপক সাহাব এনাম খান মনে করেন, এসব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভূকৌশলগত গুরুত্বও বেড়েছে অনেক। “মিয়ানমার থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃৃত স্থিতিশীল দেশ” বলে দাবি এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকের।
তার মতে, “কাতার যেহেতু ইফেক্টিভ নেগোশিয়েটর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, তাই আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশেও তাদের কাছে এই অঞ্চলে উপস্থিতি বাড়ানো জরুরি।” এতে এখানকার বিবদমান কোনো বিষয়েও তারা নিজেদেরকে আরও ভালোভাবে সম্পৃক্ত করতে পারবে, বলেন. খান।
সউদী আরব, কুয়েতের মতো মধ্যপ্রাচ্য আরও কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য করে, বিনিয়োগ ও অনুদান দিয়ে থাকে। তাদের সঙ্গে কাতারের ভূমিকার পার্থক্য দেখেন অধ্যাপক সাহাব এনাম খান। “অন্য দেশগুলো কেবল বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তাদের উদ্যোগ কাতারের মতো কম্প্রিহেনসিভ (বিস্তৃত) না,” বলেন তিনি।
তবে, সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কাতার এখানে ভালো বিজনেস অপরচুনিটি পাচ্ছে। অন্য কোনোভাবে তারা প্রভাব বাড়াতে চায় বলে মনে হয় না।” “কাতারের কূটনৈতিক তৎপরতা মূলত মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক,” বলেন কবির। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার “প্রচলিত শক্তির বিন্যাস” নিয়ে দেশটির খুব একটা আগ্রহ দেখছেন না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। কাতারের সরকারি দফতর আমিরি দিওয়ানের ওয়েবসাইটে সহযোগিতা বৃদ্ধি ও পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়কেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়।
ফিলিপিন্স ও নেপালে সম্ভাবনা
আমির হিসেব অধিষ্ঠিত হওয়ার এক বছর পর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে এক বক্তৃতায় নিজের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, কাতার গ্যাস ও তেল বিক্রির নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসতে চায়। “একটা সময় আসবে যখন আমরা তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল থাকতে পারবো না। এজন্য আমরা নানা খাতে বিনিয়োগ করছি।”
এশিয়ার তিন দেশে তার সর্বশেষ সফরে বাণিজ্যে মনোযোগই প্রকাশ পায় বলে মনে করেন, সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির। জনশক্তির, পাশাপাশি জ্বালানি, বিমান পরিবহনের মতো বিষয়ে প্রাধান্যকে তিনি সেই মনোযোগের অংশ হিসেবেই দেখেন। “ফিলিপাইন বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে ভালো,” বলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন। তাছাড়া, দেশটির পাঠানো জনশক্তি অপেক্ষাকৃত দক্ষ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। হোসেন বলেন, নেপালে অভিবাসন ব্যয় কম হওয়ায় দেশটি থেকে কাতারে শ্রমিক যাওয়ার হার অনেক বেশি।
কাতারের কূটনৈতিক প্রভাব
কাতারে তালেবানের অফিস আছে ২০১৩ সাল থেকে। সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়াসহ আরও অনেকে বসবাস করেন দেশটিতে। আবার, সেখানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিও অবস্থিত। ইসরাইল-হামাসের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে কাতার। দুই পক্ষের সাম্প্রতিক বৈঠকগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেখানে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান বৈঠকও কাতারেই অনুষ্ঠিত হয়।
সব মিলিয়ে কাতার “অসাধারণ কূটনৈতিক” উৎকর্ষের প্রমাণ দিয়ে চলেছে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির। টার্কিশ জার্নাল অব মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজে তুরস্কের বিশ্লেষক এসরা কেভুসোগ্লু লিখেছেন – কূটনীতিক ক্ষেত্রে কাতারের বড় সাফল্য আসে ২০০৮ সালে, যখন কাতারের মধ্যস্থতায় লেবাননে হেজবুল্লাহ এবং অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতা হয়।
মার্কিন সেনাবাহিনী আফগানিস্তান থেকে সরে আসার পর যেসব আমেরিকান এবং আফগান নাগরিক সরিয়ে নেয়া হয় তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক আশ্রয় পেয়েছিল কাতারে। তখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দেশটির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। বর্তমানে তালেবানের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করছে কাতার। সূত্র: বিবিসি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।