ধর্ম ডেস্ক: দাসপ্রথা ইসলাম প্রবর্তিত কোন ব্যবস্থা নয়। আজ হতে প্রায় পৌনে ৪০০০ বছর আগের ব্যবলনিয় Code of Hammurabi-তেও দাসপ্রথার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু কেন যেন ইসলামের সমালোচনায় দাসপ্রথা একটি বেশ মুখরোচক বিষয়বস্তুতে পরিণয় হয়, আর আলোচনার ভঙ্গিটাও এমন থাকে যাতে পাঠকের কাছে মনে হতে থাকবে দাসপ্রথার মত ঘৃণ্য একটি ব্যবস্থাকে ইসলাম জন্ম দিয়েছে বা উন্নীত করেছে। অথচ আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ইসলাম দাসপ্রথার মতো একটি বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, ক্রীতদাসকে ভাতৃত্বের যে মর্যাদা দিয়েছিল, নেতৃত্বের যে সুযোগ দিয়েছিল, যে কোন নিরপেক্ষ বিশ্লেষক তার প্রশংসা না করে পারবে না। আজ আপনাদের জন্য রয়েছে পর্ব ০১ যেখানে কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কাল পর্ব ০২ এ আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
আসুন কুরআনের কিছু আয়াত এবং কিছু হাদিস থেকে দাস-দাসি ও দাসপ্রথার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝবার চেষ্টা করি।
আয়াত-১: দাসমুক্তকরণ ধর্মের ঘাঁটি
অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি জানেন, সে ঘাঁটি কি? তা হচ্ছে দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্নদান- এতীম আত্মীয়কে অথবা ধুলি-ধুসরিত মিসকীনকে, অতঃপর তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবরের ও উপদেশ দেয় দয়ার। [৯০:১১-১৭]
আয়াত-২: মুক্তিকামি ক্রীতদাসের জন্য সম্পদ ব্যয় করা বড় সৎকাজ
সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। [২:১৭৭, প্রাসঙ্গিক অংশ]
আয়াত-৩: নিজেদের সমান হয়ে যাবার ভয়ে দাস-দাসীদের দান না করা আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করার নামান্তর
আল্লাহ জীবনোপকরণে তোমাদের একজনকে অন্যজনের চাইতে শ্রেষ্টত্ব দিয়েছেন। অতএব যাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে, তারা তাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদেরকে স্বীয় জীবিকা থেকে এমন কিছু দেয় না, যাতে তারা এ বিষয়ে তাদের সমান হয়ে যাবে। তবে কি তারা আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করে। [১৬:৭১]
আয়াত-৪: নিঃস্ব হলেও সৎকর্মপরায়ণ দাস-দাসীদের বিবাহ দিয়ে দিতে হবে
তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। [২৪:৩২]
দাসদাসি ও দাসপ্রথা সম্পর্কিত কিছু হাদিস:
হাদিস-১: স্বাধীন ব্যক্তিকে কেনাবেচা নিষিদ্ধকরণ
আবু হুরাইরা(রা.) হতে বর্ণিত:
নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ[তায়ালা] বলেন:
আমি কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরূদ্ধে হবো,
[১] যে আমার নামে শপথ করে অত:পর বিশ্বাসঘাতকতা করে,[২] যে কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে (ক্রীতদাস হিসেবে) বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করে,[৩] যে কোন মজুরকে নিযুক্ত করে তার থেকে পরিপূর্ণ কাজ গ্রহণ করে অথচ তার পারশ্রমিক প্রদান করে না।[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২২২৭; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৩৪, নম্বর ৪৩০]
হাদিস-২: দাস-দাসির অধিকার
আল-মা’রুর বিন সুওয়াইদ(রা.) হতে বর্ণিত:
[রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] বললেন:তোমাদের দাসেরা তোমারদের ভাই যাদের ওপর আল্লাহ তোমাদের ক্ষমতা দিয়েছেন। কাজেই কারো নিয়ন্ত্রণে যদি তার ভাই থাকে, তবে সে যা খাবে তাকেও তাই খাওয়াবে, সে যা পরবে তাকেও তাই পরাবে। তাদের ওপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপাবে না যা তারা বহন করতে অক্ষম। যদি তা করো, তবে তাদেরকে সাহায্য কর।
[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৫৪৫ (প্রাসঙ্গিক অংশ); ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২১;]
হাদিস-৩: দাস-দাসিকে সম্মানজনকভাবে সম্বোধন করা
আবু হুরাইরা(রা.) হতে বর্ণিত:
নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “তোমাদের কেউ যেন [এভাবে সম্বোধন করে] না বলে, ‘তোমার প্রভুকে খাওয়াও’, ‘তোমার প্র্রভুকে অযু করাও’, ‘তোমার প্রভুকে পান করাও’; বরং বলবে, ‘আমার মুনিব (সাইয়্যিদ)’ বা ‘আমার অভিভাবক (মাওলা)’। আর তোমাদের কেউ যেন না বলে ‘আমার দাস/বান্দা (আবদ)’ বা ‘আমার দাসী/বান্দী (আমাত)’; বরং বলবে ‘আমার বালিকা (ফাতাত)’ এবং ‘আমর বালক (গুলাম)’।
[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৫৫২; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২৮]
হাদিস-৪: দাস-দাসির ন্যায়বিচার লাভের অধিকার
সামুরাহ(রা.) হতে বর্ণিত:
রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যদি কেউ তার ক্রীতদাসকে হত্যা করে আমরা তাঁকে হত্যা করবো, আর কেউ যদি তার ক্রীতদাসের নাক কেটে দেয়, আমরাও তার নাক কেটে দেবো।
[সুনান আবু দাউদ, হাদিস নম্বর ৪৫১৫; ইংরেজি অনুবাদ: বুক ৩৯, নম্বর ৪৫০১;]
হাদিস-৫: দাস-দাসির ওপর অপবাদ আরোপের পরিণাম
আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত:
আমি আবুল ক্বসিম(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বলতে শুনেছি, কেউ যদি তার ক্রীতদাসকে অপবাদ দেয় আর সেই ক্রীতদাস যদি সে যা বলছে তা হতে মুক্ত হয়, তবে তাকে (অপবাদ আরোপকারিকে) কিয়ামতের দিনে বেত্রাঘাত করা হতে থাকবে যতক্ষণ না সেই ক্রীতদাস তাই হয় যা সে বর্ণনা করেছে।
[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৬৯৪৩, ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৮, বুক ৮২, নম্বর ৮৪১;]
হাদিস-৬: দাস/দাসিকে চপেটাঘাত করার শাস্তি
মুআবিয়া বিন সুওয়াইদ হতে বর্ণিত:
আমি আমাদের এক ক্রীতদাসকে চপেটাঘাত করি, অত:পর পলায়ন করি। আমি ঠিক মধ্যাহ্নের আগে ফিরে এলাম এবং আমার পিতার পেছনে সালাত আদায় করলাম। তিনি তাকে (ঐ ক্রীতদাসকে) এবং আমাকে ডাকলেন এবং বললেন: সে তোমার প্রতি যা করেছে, তুমিও তেমন করো. সে [ক্রীতদাস] আমাকে মাফ করে দিল। তখন তিনি (আমার পিতা) বললেন, রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবদ্দশায় আমরা মুকাররিনের পরিবারভুক্ত ছিলাম এবং আমাদের একজন মাত্র ক্রীতদাসি ছিল। আমাদের একজন তাকে চড় মারলো। এই খবর রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে পৌঁছল এবং তিনি বললেন: তাকে মুক্ত করে দাও। তারা (পরিবারের লোকজন) বললেন: সে ছাড়া আমাদের আর কোন সাহায্যকারি নেই। কাজেই তিনি বললেন: তাহলে তাকে কাজে নিযুক্ত করো, আর যখনই তোমরা তাকে কাজ হতে অব্যাহতি দিতে সমর্থ হও, তাকে মুক্ত করে দাও।
[সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ৪৩৯১; ইংরেজি অনুবাদ: বুক ১৫, নম্বর ৪০৮১;]
হাদিস-৭: দাসিকে বিবাহে উৎসাহ প্রদান
আবু মুসা(রা.) হতে বর্ণিত:
রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
যার একটি ক্রীসদাসি আছে আর সে তাকে শিক্ষাদীক্ষা দান করে, তার সাথে সদয় ব্যবহার করে, অত:পর তাকে মুক্ত করে বিবাহ করে সে দ্বিগুণ সওয়াব পাবে। [সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৫৮৪; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি. ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২০;]
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।