ধর্ম ডেস্ক: দাসপ্রথা ইসলাম প্রবর্তিত কোন ব্যবস্থা নয়। আজ হতে প্রায় পৌনে ৪০০০ বছর আগের ব্যবলনিয় Code of Hammurabi-তেও দাসপ্রথার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু কেন যেন ইসলামের সমালোচনায় দাসপ্রথা একটি বেশ মুখরোচক বিষয়বস্তুতে পরিণয় হয়, আর আলোচনার ভঙ্গিটাও এমন থাকে যাতে পাঠকের কাছে মনে হতে থাকবে দাসপ্রথার মত ঘৃণ্য একটি ব্যবস্থাকে ইসলাম জন্ম দিয়েছে বা উন্নীত করেছে। অথচ আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ইসলাম দাসপ্রথার মতো একটি বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, ক্রীতদাসকে ভাতৃত্বের যে মর্যাদা দিয়েছিল, নেতৃত্বের যে সুযোগ দিয়েছিল, যে কোন নিরপেক্ষ বিশ্লেষক তার প্রশংসা না করে পারবে না। গতকাল পর্ব ০১ এ কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আজ পর্ব ০২ ও শেষ পর্বে এ নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে।
সর্বশেষ আসমানী কিতাব কুরআন যখন নাযিল হচ্ছিল তখন শুধু আরবে নয় বরং সারা দুনিয়ায় ক্রীতদাসপ্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। স্বাধীন মানুষ দাসত্ব বরণ করত প্রধানত দুটি উপায়ে:
১. স্বাধীন ব্যক্তিকে বেচাকেনার মাধ্যমে ক্রীতদাস বানানো: এই পথটি ইসলামে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইসলামে কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে কেনাবেচা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-১]
২. যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাস বানানো:
যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাস বানানো সেই সময় একটি স্বাভাবিক রীতি ছিল। কোন মুসলিম যদি যুদ্ধে অমুসলিমদের হাতে বন্দী হতো তাকেও এই পরিণতি বরণ করতে হতো। ইসলামে যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাস বানানো কোন জরুরী বিষয় নয়। ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ নিয়ে মুক্ত করতে পারে, বিনা মুক্তিপণেও মুক্ত করতে পারে, যুদ্ধবন্দি বিনিময় করতে পারে বা প্রয়োজনবোধে অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহের রীতি অনুসারে দাস-দাসীও বানাতে পারে। তবে কোন রাষ্ট্রের সাথে মুসলিমদের যদি এমন কোন চুক্তি থাকে যে তারা তাদের যুদ্ধবন্দীদের দাস বানাতে পারবে না, তবে সেই চুক্তি রক্ষা করা মুসলিমদের জন্য জরুরি।
২.১ কেন ইসলামে এই সুযোগ রহিত করা হলো না?
ইসলাম একটি বাস্তব ধর্ম। ইসলাম এমন কোন ধর্ম না যে কেউ এক গালে চড় মারলে আরেকটা গাল পেতে দিতে বলবে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিজ অনুসারিদের বিপদ বা অস্তিত্ব সংকটের মুখে ফেলে দেবার ধর্ম ইসলাম নয়। যেখানে মুসলিমরা অমুসলিমদের হাতে যুদ্ধবন্দী হলে তাদেরকেও দাসত্ব বরণ করতে হতো, সেখানে ইসলাম যদি একই সুযোগ না রাখতো তবে তা হতো শত্রুর হাতে এক বিরাট মারণাস্ত্র তুলে দেওয়ার নামান্তর। কাজেই যতদিন মুসলিমদের জন্য এই নিশ্চয়তা না আসে যে তাদের যুদ্ধবন্দীদের দাসদাসী বানানো হবে না, ততদিন পর্যন্ত মুসলিমদের জন্যও এই সুযোগ রহিত করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না।
২.২ দাসত্বের এই পথ বন্ধ করার উপায়
ইসলামে দাসত্ব বরণের এই পথটি যদিও খোলা রয়েছে তবে একটি বন্ধযোগ্য পথ, যা বন্ধ করার চাবি অমুসলিম রাষ্টসমূহের হাতেই দেওয়া আছে। যে কোন অমুসলিম রাষ্ট্র মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে এই ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যে ‘আমরা একে অপরের যুদ্ধবন্দীদের দাস-দাসী বানাবো না’, দাসত্বে প্রবেশের এই উন্মুক্ত পথটি বন্ধ করে দিতে পারে।
চার
ইসলামে দাসমুক্তির পথসমূহ
১. যাকাত: ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ যাকাত। আর এই যাকাতের একটা খাত নির্ধারণ করা হয়েছে দাসমুক্তির জন্য। [দ্রষ্টব্য ৯:৬০]
২. কাফফারা: বিভিন্ন গুনাহ বা ভুলের কাফফারা নির্ধারণ করা হয়েছে দাস মুক্তকরণকে। [দ্রষ্টব্য ৫:৮৯, ৫৮:৩, ৪:৯২]
৩. লিখিত চুক্তি: ইসলাম দাস-দাসিদের তার মালিকের সাথে মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তির অনুমতি প্রদান করেছে।
তোমাদের অধিকারভুক্তদের মধ্যে যারা মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি করতে চায়, তাদের সাথে তোমরা লিখিত চুক্তি কর যদি জান যে, তাদের মধ্যে কল্যাণ আছে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে অর্থ-কড়ি দিয়েছেন, তা থেকে তাদেরকে দান কর। [২৪:৩৩, প্রাসঙ্গিক অংশ]
৪. ক্ষতিপূরণ: কোন দাস/দাসিকে চপেটাঘাত করা হলে তার শাস্তি হিসেবে উক্ত দাস/দাসিকে মুক্ত করে দিতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৬]
৫. দাসমুক্তকরণে উৎসাহ প্রদান:
৫.১ দাসমুক্তিকে একটি বিরাট সওয়াবের কাজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। [দ্রষ্টব্য: আয়াত-২]
৫.২ বিভিন্ন প্রাকৃতিক নির্দশনের সময় দাসমুক্তির নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, যেমন; চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ কালে। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ: ভলি.২, বুক ১৮, নম্বর ১৬৩; ভলি.৩, বুক ৪৬, নম্বর ৬৯৫; ভলি.৩, বুক ৪৬, নম্বর ৬৯৬]
৫.৩ মুক্তিকামি দাসদাসীদের অর্থকড়ি প্রদান করে সাহায্য করতে বলা হয়েছে। [দ্রষ্টব্য ২৪:৩৩]
৫.৪ মালিকের অধিক পছন্দনীয় এবং অধিক দামী দাস-দাসীর মুক্তিপ্রাপ্তির সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবে কম থাকে। তাই ঘোষণা করা হয়েছে যে, সর্বোত্তম দাসমুক্তি হচ্ছে সবচেয়ে দামী এবং মালিকের অধিক পছন্দনীয় দাসকে মুক্ত করা। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৬৯৪]
৫.৫ দাস-দাসি নিজের সমান হয়ে যাবে এমন আশঙ্কায় যারা তাদের দান করা থেকে বিরত থাকে তাদের তিরস্কার করা হয়েছে। [দ্রষ্টব্য ১৬:৭১]
৫.৬ কোন ক্রীতদাস যদি একাধিক মালিকের আয়ত্বাধীনে থাকে এবং কোন একজন মালিক তার অংশ হতে ঐ দাসকে মুক্ত করে দেয় তবে উক্ত মালিকের জন্য ঐ ক্রীতদাসকে অপর অংশীদারদের হতেও মুক্ত করে দেওয়াকে জরুরী করে দেওয়া হয়েছে। মালিক তাতে অসমর্থ হলে, উক্ত ক্রীতদাসকে মুক্তি লাভের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করার নিমিত্তে কাজ করার অনুমতি দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ ভলি. ৩, বুক ৪৪, নম্বর ৬৭২]
৫.৭ দাসিকে শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে মুক্ত করে বিবাহকারীকে দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী বলা হয়েছে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৭]
পাঁচ
ইসলামে দাস/দাসী’র অধিকার ও মর্যাদা
১. ভ্রাতৃত্বের মর্যাদা:
ইসলাম দাসদের ভাইয়ের মর্যাদায় উন্নীত করেছে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
২. নেতৃত্বের অধিকার:
ইসলামে দাসও আমীর হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তাকে মান্য করা সকলের জন্য জরুরি। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৭২২৯; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৯, বুক ৮৯, নম্বর ২৫৬;]
৩. অন্ন-বস্ত্রের সমানাধিকার:
৩.১ মুনিব যা খাবে দাসকেও তাই খাওয়াতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
৩.২ মুনিব যা পরবে দাসকেও তা-ই পরাতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
৪. কাজ-কর্মে সহানুভূতি লাভের অধিকার:
৪.১ দাসের ওপর তার সামর্থ্যের অতিরিক্ত কোন কাজের বোঝা চাপানো যাবে না। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
৪.২. দাসের ওপর অতিরিক্ত কোন কাজের বোঝা দিতে হলে নিজেকেও তাতে সাহায্য করতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
৫. সম্মান লাভের অধিকার:
৫.১ দাস-দাসীদের ‘আমার বান্দা/দাস’ ‘আমার বান্দি/দাসী’ বলা যাবে না, বলতে হবে ‘আমার বালক’, ‘আমার বালিকা’। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৩]
৫.২ দাস-দাসীদের চপেটাঘাত পর্যন্ত করা যাবে না। তাদেরকে চপেটাঘাত করা হলে এর শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে মুক্ত করে দিতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৬]
৫.৩ দাস-দাসীদের ওপর কোন অপবাদ আরোপ করা যাবে না। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৫]
৬. ধর্মীয় মর্যাদা:
ইসলামে একজন দাসের ধর্মীয় মর্যাদা একজন স্বাধীন মুসলিমের চেয়ে কোন অংশে কম নয় বরং বেশি। কেননা, যদি কোন দাস তার মালিকের প্রতি সৎ এবং বিশ্বস্ত থাকে এবং তার প্রভুর (আল্লাহর) ইবাদতও যথাযথভাবে করে তবে সে দ্বিগুণ সওয়াব পাবে। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২২]
৭. ন্যায়বিচার লাভের অধিকার:
ইসলাম ক্রীতদাসের ন্যায়বিচার লাভের অধিকারকে নিশ্চিত করে। বিশ্বে যেখানে দাসদের ওপর চলছিল ইচ্ছামত অত্যাচার, নিপীড়ণ; দাসদের হত্যা করাও যখন ছিল আইনসিদ্ধ, সেই সময় ইসলাম ঘোষণা করে কঠোরতম সতর্কবাণী, কেউ কোন ক্রীতদাসকে হত্যা করলে তাকেও হত্যা করা হবে, কেউ কোন ক্রীতদাসের অঙ্গহানি ঘটালে তারও অঙ্গহানি ঘটানো হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৪]
৮. জৈবিক চাহিদা পূরণের অধিকার:
ইসলাম দাস-দাসীদের জৈবিক চাহিদা পূরণের অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং নিজের দাস-দাসীদের বিবাহ দিয়ে দেওয়াকে মুনিবের জন্য দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করেছে। [দ্রষ্টব্য ২৪:৩২]
৯. পবিত্র জীবন যাপনের অধিকার:
ইসলামে দাসীদের পতিতাবৃত্তিতে নিযুক্ত করা কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
তোমাদের দাসীরা নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদের লালসায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য কারো না। [২৪:৩৩, প্রাসঙ্গিক অংশ]
১০. বিবাহের ক্ষেত্রে মতামত প্রদানের অধিকার:
কোন মুনিব তার ক্রীতদাসির সাথে আলোচনা না করে তাকে কারো সাথে বিবাহ দিতে পারবে না। [দ্রষ্টব্য: বুখারি, হাদিস নম্বর ৭০৫৬; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৯, বুক ৮৬, নম্বর ১০০;]
১১. ক্রীতদাসি এবং তার শিশুর একত্রিত থাকার অধিকার:
কোন ক্রীতদাসীকে ভিন্ন কোথাও বিক্রি করে তার থেকে তার শিশুকে বিচ্ছিন্ন করার কোন অনুমতি ইসলামে নেই, এবং এই ধরণের বেচাকেনা নিষিদ্ধ। [দ্রষ্টব্য: সুনান আবু দাউদ, ইংরেজি অনুবাদ: বুক ১৪, নম্বর ২৬৯০]
অর্থাৎ দাসদের পড়া-লেখা শেখার, মজুরি খাটার, কিছু উৎপাদন করার, গবাদি পশু রাখার, নৌকা রাখা/চালানোর, কেনা-বেচা করার, ভালো কাপড় পরিধান করার অধিকারই শুধু হরণ করা হয় নাই, মালিককে এতটুকু অধিকারও দেওয়া হয়েছিল যে যদি ক্রীতদাসকে সংশোধন করতে গিয়ে সে তাকে মেরেও ফেলে, তবু তার কোন শাস্তি হবে না, যেন এমন কোন ঘটনাই ঘটে নাই!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।