মানুষ যখন প্রথম আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকিয়েছে, তখন থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা শুরু। হাজারো নক্ষত্র আর গ্যালাক্সির ভীড় দেখে মুগ্ধ হয়েছে মানুষ, হয়েছে কৌতুহলী। আকাশের প্রতি মানুষের এই কৌতুহল থেকেই গবেষণা ও সভ্যতার সূচনা। কালে কালে বিকশিত হয়েছে জ্যোতির্বিদ্যা। মানুষ তারাদের নিয়ে ভেবেছে, গবেষণা করেছে। আবিষ্কার করেছে আকাশের নক্ষত্র, ছায়াপথ, গ্রহ ও মহাবিশ্বের বিস্তৃতি নিয়ে নানা তথ্য। আর এসবই চমৎকারভাবে উঠে এসেছে দীপেন ভট্টাচার্যের আকাশ পর্যবেক্ষকের নোটবই: কালপুরুষ থেকে ত্রিশঙ্কু বইতে।
বই শুরু হয়েছে অতীতের রাতের আকাশের বিবরণ দিয়ে। প্রাচীনকালে মানুষের জীবনে নক্ষত্র ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লেখক ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে প্রাচীনকালে কৃষক, নাবিক ও জ্যোতিষীরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন। আজকের আলোক দূষণের যুগে সেই রাতের আকাশ হারিয়ে গেছে। আধুনিক শহরে আকাশের ম্রিয়মাণ তারা আর আমাদের মুগ্ধ করে না। বইটির প্রথম অধ্যায়ে আমাদের নতুন করে পরিচয় হয় হারিয়ে যাওয়া সেই মহাজাগতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে।
এরপর লেখক আমাদের নিয়ে যান মহাকাশের বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণে। গ্যালাক্সি, নক্ষত্রমণ্ডলী এবং মহাবিশ্বের গঠন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তিনি। ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে মহাবিশ্বের বহু দূর অংশের আলো আমাদের কাছে পৌঁছায়, আন্তঃনাক্ষত্রিক ও আন্তঃগ্যালাক্টিক স্থান কতটা ফাঁকা, সেসব। পাশাপাশি বিশাল শূন্যতার মধ্যেও কণা ও বিকিরণের প্রভাব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সাধারণ পাঠক এসব জেনে বিস্মিত হবেন, তা বলা যায়।
লেখকের ব্যাখ্যা শুধু বিজ্ঞানেই থেমে থাকেনি। তিনি মহাবিশ্বের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে গভীর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করেছেন। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে লেখক যেমন নিজেকে প্রশ্ন করেন, ‘আমার মতো আর কেউ কি আছে এই মহাবিশ্বে?’—তেমনি পাঠককেও এ প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেন।
মহাবিশ্বের যেখানে পৃথিবীর অবস্থান, তা তুলনামূলকভাবে শান্ত ও ‘বোরিং’। কিন্তু এই ‘বোরিং’ বা নিশ্চল অঞ্চলেই সূর্যের মতো মাঝারি আকারের এক নক্ষত্রের তৃতীয় গ্রহে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। বিপরীতে আমরা যদি গ্যালাক্সির মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করতাম, তাহলে রাতের আকাশ হয়তো আরও ‘ইন্টারেস্টিং’ হতো। সে ক্ষেত্রে হয়তো সেই আকর্ষণীয় দৃশ্য দেখার জন্য আপনি-আমি কেউই থাকতাম না। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তরও উঠে এসেছে লেখকের কলমে।
‘হারত্সপ্রুং-রাসেল চিত্র’ ও ‘তারার শ্রেণিবিন্যাস’ নিয়ে বিস্তর আলোচনা আছে আকাশ পর্যবেক্ষকের নোটবই-তে। লেখক ব্যাখ্যা করেছেন, তারার বর্ণালি-শ্রেণি ও এর সঙ্গে উজ্জ্বলতার সম্পর্ক বোঝার জন্য হারত্সপ্রুং-রাসেল চিত্র কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে তারার ভর, তাপমাত্রা ও জীবনকাল নির্ধারণ করা যায়—সেসব উত্তরও বাদ যায়নি।
বইটির মূল বিশেষত্ব হলো, এখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণের সহজ পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। নবীন বা সৌখিন জ্যোতির্বিদরা কীভাবে খালি চোখেই আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে পারে, সে পরামর্শ দিয়েছেন লেখক। পাশাপাশি বাইনোকুলার ও দুরবিন ব্যবহার করে কীভাবে নক্ষত্র, গ্রহ ও গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করা যায়, তাও ব্যাখ্যা করেছেন। কৌণিক দূরত্ব মাপার পদ্ধতি, তারার উজ্জ্বলতা নির্ধারণ এবং স্থানাঙ্ক নির্ধারণের মতো বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত সরল ভাষায়।
পড়ার সময় কেবল বইয়ের বিষয়বস্তু নয়, এর ভাষাও আকর্ষণ করবে পাঠককে। বিজ্ঞানের তথ্যগুলো কাব্যময় সাহিত্যের ভাষার মিশেলে লেখক যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা প্রশংসার দাবিদার। এতে রাতের আকাশের সৌন্দর্য উঠে এসেছে কাব্যের সৌন্দর্য নিয়ে, যা পাঠকের ভালো লাগতে বাধ্য। তিনি লিখেছেন, কীভাবে ছায়াপথ বা আকাশগঙ্গা একসময় আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ ছিল এবং এখন তা হারিয়ে গেছে।
আকাশ পর্যবেক্ষকের নোটবই: কালপুরুষ থেকে ত্রিশঙ্কু শুধু জটিল বৈজ্ঞানিক তথ্য জানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; পাঠকের মনে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মহাবিশ্ব নিয়ে গভীর আগ্রহ জাগিয়ে তোলে বইটি। যাঁরা আকাশ দেখা শিখতে চান কিংবা সত্যি সত্যি বুঝতে চান জ্যোতির্বিদ্যার খুঁটিনাটি, তাঁদের শুরু করার জন্য বইটি বেশ কাজে আসবে। একজন শৌখিন বা নবীন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করা সহজ হবে এর মাধ্যমে। এ বই আমাদের এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার জগতে নিয়ে যায়। শুধু মহাবিশ্বকে জানাই নয়, বরং তার সঙ্গে নিজেদের গভীর সংযোগও অনুভব করা যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।