ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার : এককালে সবুজের আচ্ছাদনে মোড়ানো ঢাকা ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে তার শ্যামলিমা। সবুজ কমতে থাকায় মহানগর ঢাকায় একদিকে যেমন বাড়ছে বায়ুদূষণ, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি ছিল তখন পর্যন্ত দীর্ঘ ৫৮ বছরের মধ্যে রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
এর আগে ১৯৬৫ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রসঙ্গত, এখন পর্যন্ত ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৯৬০ সালের ৩০ এপ্রিল, ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশব্যাপী চলমান দাবদাহ নাভিশ্বাস তুলেছে জনজীবনে। ব্যারোমিটারের পারদে চলতি গরমে ঢাকা এখনো শীর্ষস্থানে না গেলেও তাপের অনুভূতি মোটেই কম নয়।
দেশের অনেক অঞ্চলের মতো রাজধানীবাসীর প্রাণও গরমে ওষ্ঠাগত। তবে এই অবস্থা রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি। ঢাকার বর্তমান দাবদাহ পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের পরিবেশ ধ্বংসেরই ফল। বিগত কয়েক বছরে সবচেয়ে বায়ুদূষণের নগর হিসেবে রেকর্ড করেছে রাজধানী ঢাকা।
এখন রেকর্ড তাপমাত্রার আশঙ্কা ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। গত ২০ বছরে ঢাকার গড় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪ ডিগ্রি। তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন যতটা দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগর পরিচালনা ও সেবাদানে যুক্ত বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ত্রুটি বা ঘাটতি।
বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয়—এই তিনটি কারণে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক কারণের মধ্যে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির দহন থেকে কার্বন নিঃসরণ এবং আমাজানসহ বনভূমি ধ্বংস হওয়া।
এর জন্য আমরা খুব বেশি দায়ী না হলেও এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়ছে। আঞ্চলিক কারণের মধ্যে রয়েছে আমাদের দক্ষিণ এশিয়া ও চীন অঞ্চলের উন্মুক্তভাবে প্রবহমান নদীগুলো বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে মেরে ফেলা এবং হিমালয়ের বরফ গলে যাওয়া। যেসব জায়গায় নদী কমেছে তার কিছু অংশ বালু দিয়ে ভরাট হয়েছে। কোথাও বা স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। এসব জায়গা থেকে প্রচুর তাপ ছড়াচ্ছে।
আগে হিমালয়ের সাদা বরফ অনেক তাপ প্রতিফলিত করত। কিন্তু এখন বরফ গলে পাহাড়ের কঠিন পাথর বেরিয়ে আসছে। ওই পাথরের ধরে রাখা তাপ বাতাসের মাধ্যমে আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে যাচ্ছে। নগরগুলোর বিপুল জনসংখ্যার জন্য আবাসন, পরিবহনসহ নাগরিক সুবিধা দিতে গিয়েও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো স্থানীয় কারণ, যা স্থানীয়ভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। এই স্থানীয় কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হলো সবুজ এলাকা কমে যাওয়া। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বা নানারকম নির্মাণ প্রকল্পের জন্য রাস্তার বিভাজকসহ বিভিন্ন স্থানের বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এ কারণে বৃষ্টিপাতও কমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার যেসব এলাকায় সবুজের উপস্থিতি রয়েছে সেসব এলাকায় তাপমাত্রা তুলনামূলক কম।
ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির দ্বিতীয় কারণ হলো জলাধার কমে যাওয়া। ঢাকা শহরে জলাধার বা পুকুরের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। জলাধার মাটির পরিবর্তে বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। এটিও তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তৃতীয় কারণ, ঢাকার অত্যধিক জনসংখ্যা। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পরিবেশ দপ্তরের মতে, সাধারণত প্রতি ১০ লাখ লোকের জন্য যেকোনো এলাকার তাপমাত্রা ১.৮ থেকে ৫.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়তে পারে। আবার মানুষের শরীরের একটি নিজস্ব তাপমাত্রা রয়েছে, যাকে বলা হয় মেটাবোলিক হিটিং। প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই তাপমাত্রার পরিমাণ ১০০ ওয়াট। অর্থাৎ একটি স্থানে বিপুলসংখ্যক মানুষ থাকলে সেখানে শুধু মানুষের কারণেই তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি হবে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির চতুর্থ কারণ হিসেবে বলা যায় রান্না করা ও বর্জ্য পোড়ানোর কাজে আগুন জ্বালানোর কথা। প্রায় ২০ লাখ পরিবারের ২০ লাখ চুলায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে তিন ঘণ্টা করে রান্নার কাজ চলে। শহরের প্রচুর মানুষ এখনো রান্নার কাজে কাঠ পোড়ায়। যত্রতত্র বর্জ্য পোড়ানো একটি বড় সমস্যা। প্লাস্টিকজাতীয় বর্জ্য পোড়ানোর ফলে বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস ও ক্ষতিকর মাইক্রো প্লাস্টিক বাতাসকে দূষিত করছে। তা ছাড়া বাতাসে ভাসমান এই প্লাস্টিক কণাগুলোও তাপ ধরে রাখে।
পঞ্চমত, রাজধানীর প্রচুর যানবাহন ও যানজট সমস্যা তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। যানজটের কারণে গাড়িগুলোকে সব মিলিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইঞ্জিন চালু করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ষষ্ঠ কারণ হচ্ছে, শহরের পিচ ঢালা রাস্তা। এই রাস্তা দিনের বেলা উত্তপ্ত হয় এবং রাতে তাপ ছেড়ে দিয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত করে। সপ্তম কারণটি ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণবিষয়ক। বহুতল ভবনগুলোতে অতিরিক্ত কাচ ও এসির ব্যবহার হচ্ছে। ফুটপাতের কাছে ঘাসের অংশ রাখার বদলে পুরো পাকাকরণ হচ্ছে, যে কারণে বৃষ্টির পানি মাটির নিচে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে পাকার নিচের মাটিও উত্তপ্ত হচ্ছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রিজিলিয়ান্স সেন্টারের ‘হট সিটিজ, চিলড ইকোনমিজ : ইমপ্যাক্টস অব এক্সট্রিম হিট অন প্লোবাল সিটিজ’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় উচ্চ তাপমাত্রার কারণে প্রতিবছর ৬০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। অঙ্কটি ২০৫০ সাল নাগাদ আট হাজার ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রার ফলে ঢাকার মানুষের শ্রম উৎপাদনশীলতা অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাপপ্রবাহের কারণে ঢাকায় বিভিন্ন রোগজীবাণু বিস্তারের প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঢাকা শহরের এই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সবার আগে প্রতিটি ফাঁকা স্থানে গাছ লাগাতে হবে। জলাভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। দখলকৃত জলাভূমি উদ্ধার করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ভবন নির্মাণ করতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও শহরাঞ্চলমুখী জনস্রোত কমানো প্রয়োজন। নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। এ ছাড়া স্থানীয়, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।
লেখক : ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।
Own the headlines. Follow now- Zoom Bangla Google News, Twitter(X), Facebook, Telegram and Subscribe to Our Youtube Channel