মাহদী হাসান: পৃথিবীর সব পেশার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেশা হচ্ছে চিকিৎসা পেশা৷ স্বভাবতই এই পেশার প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি৷ কারণ হিসেবে বলা যায়,সরাসরি মানবসেবা করার সুযোগ৷ যে কোনো পেশাতে থেকেই মানবসেবা করা যায় তবে একদম সরাসরি মানুষের সেবা করা যায় শুধু চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমেই৷এখন প্রশ্ন হল দুই বছর ইন্টার্নশিপ করা হলে মেধাবীরা কেন নিরুৎসাহিত হবে ?
আমার এক অতি পরিচিত বন্ধু অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে একই সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং বুয়েটে চান্স পায় ৷ মাল্টিট্যালেন্টেড বলা যায় ৷ তাকে আমি মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেই ৷ কিন্তু সে সরাসরি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ৷ কারণ হিসেবে তার উত্তর ছিল, মেডিকেলের পড়াশোনা শেষ করতে অনেক বেশি সময়ের প্রয়োজন এবং পড়াশোনাটা বেশ কঠিনও ৷ সে আরও বলেছিল যে,তার পরিবার মধ্যবিত্ত এবং তার বাবা কিছু শারীরিক সমস্যার কারণে পরিবারের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না৷ তিনি তার একমাত্র ছেলে সন্তানের দিকে তাকিয়ে আছেন পরিবারের হাল ধরার জন্য ৷ অতএব,সে চিন্তা করল বুয়েটে চার বছর পড়ার পরই সে কোনো একটা চাকরির মাধ্যমে পরিবারের হাল ধরতে পারবে যেটা মেডিকেলে ভর্তি হলে তার জন্য সম্ভব হবে না ৷ কারণ,ছয় বছর পাঁচ মাস পড়াশোনা শেষে সে সিম্পল একজন এমবিবিএস চিকিৎসক হিসেবে বের হবে যার মূল্য বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে খুবই কম ৷ তাকে দক্ষ চিকিৎসক হতে হলে আরও চার কিংবা পাঁচ বছর এক্সট্রা পড়াশোনা করতে হবে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন (এমডি,এমএস,এফসিপিএস ইত্যাদি) ডিগ্রির জন্য ৷
এত দেরি করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না কারণ তার বাবা তার সন্তানের মুখপানে চেয়ে আছে ৷ সে জন্য সে বিনাদ্বিধায় বুয়েটে ভর্তি হয়ে যায় ৷
আর এখন যে সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা চলছে সেখানে ইন্টার্নশিপ দুই বছর করা হলে,এমবিবিএস শেষ করতেই প্রয়োজন হবে ৭·৫ বছর সময়ের ৷ তার পাশাপাশি একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে দেখতে চাইলে আরও অপেক্ষা করতে হবে সর্বনিম্ম ৫ বছর ৷ তাহলে মোট ১২·৫ বছর পর পড়াশোনা শেষ হবে ৷ কে চাইবে ১২·৫ বছর ধরে পড়াশোনা করে তার পিতা-মাতার সুখ শান্তিকে বিসর্জন দিতে ?
লাইফের একটা ধাপ শেষ করে,আর একধাপে প্রবেশের সময়টা যদি এত বেশি দীর্ঘ হয় তাহলে তো দ্বিতীয়,তৃতীয় সন্তানের বিবাহ না দিয়েই পরলোকগমন করতে হবে ৷ যেখানে আমাদের মুরুব্বীরা নাতি-পুতিদের বাচ্চা-কাচ্চা দেখে যাচ্ছেন ৷ আপনারা সব বোঝেন,অত ভেঙে বলার কিছু নই৷
অসংখ্য মেধাবীকে শুধু মেডিকেল পড়াশোনার এই দীর্ঘসূত্রতার জন্য প্রতিবছর বুয়েট,কুয়েট,রুয়েট,চুয়েট এবং ডিইউতে চলে যেতে দেখছি ৷ সর্বোচ্চ মেধাবীদের দ্বারা এই পেশা পরিচালনা করা প্রয়োজন এটা সবাই বোঝে ৷ কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যখন জানবে তাকে শুধু এমবিবিএস ডাক্তার হতে হলে ৭ বছরের ওপরে পড়াশোনা করতে হবে তখন বাস্তবতার নিরিখেই তারা এই পেশার প্রতি আকর্ষণ ফিল করবে না ৷ শুধু সরাসরি মানবসেবার সঙ্গে যুক্ত থাকার যুক্তিতে অন্যান্য পেশার থেকে অনেক বেশি সময় লাগলেও সবাই এই এক্সট্রা দুই বছর ইগ্নোর করে চলত৷ এটা একটা আবেগের বিষয় ছিল,সে জন্য সবাই ছাড় দিত ৷ কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করলে আবেগ বাস্তবতায় পিষ্ট হতে বাধ্য হবে ৷
আর একটা বিষয় জনগণের জানা প্রয়োজন সেটা হল-
দেখুন,ছোটবেলার “এইম ইন লাইফ”-এ লিখে আসা “আমি মানবসেবা করার জন্য ডাক্তার হতে চাই” কথাটা শুধু লেখার জন্যই লেখা ৷ আসল বাস্তবতা হল সবাই মানবসেবা করে অর্থই ইনকাম করতে চায় ৷ এটাই মুখ্য ৷ অর্থ ইনকামের পথটা সরাসরি মানুষকে সেবা করে হয় ৷ এ জন্যই চয়েস লিস্টে এই পেশাটা টপে থাকে৷
কোনো একটা সেক্টরকে উন্নত করতে হলে,এফিসিয়েন্ট করতে হলে আপনাকে মেজরিটি পিপলের মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে ৷ মুখে অনেকেই বলেন যে, নিতান্তই মানবসেবার নিমিত্তে এই পেশাকে তিনি বেছে নিয়েছেন,পরবর্তীকালে লাইফস্টাইল ঘাটলে উল্টো চিত্র পাওয়া যাবে ৷ আমি হলফ করে বলতে পারি,আমাদের সমাজের মানুষের মনস্তত্ত্ব এমন নয় যে, তারা আপন স্বার্থ বলি দিয়ে মানবসেবা করতে এসেছেন ৷ বরং মনস্তত্ত্বটা এমন যে,তারা অর্থের বিনিময়ে সরাসরি মানবসেবা পেশাটা তুলনামূলক অন্য পেশা থেকে পছন্দ করেছেন ৷ দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সেক্টরকে খোঁড়া বানানোর পায়তারা চলছে ৷ এটা খুবই দুখঃজনক ৷
চিকিৎসকদের দক্ষতা কমবে
★ দেশের মানুষের কাছে মনে হতে পারে যে,দুই বছর ইন্টার্নশিপ করা হলে দেশের চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধি হবে ৷ এটা সম্পূর্ণরূপে ভুল ধারণা ৷ কেন ভুল ধারণা ?
★ মেডিকেল কলেজগুলোতে যখন আমরা ইন্টার্নশিপ করি তখন প্রফেসর,এসোসিয়েট প্রফেসর অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর,সিএ,রেজিস্ট্রার এবং পোস্ট গ্র্যায়জেন কোর্সে অধ্যায়নরত আরও অনেক দক্ষ চিকিৎসকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আমরা শিক্ষাগ্রহণ করে থাকি ৷ তার পাশাপাশি এখানে সিটি স্ক্যান,এমআরআইসহ আরও অনেক বড় বড় পরীক্ষা করানোর সুযোগ রয়েছে ৷ এটার মাধ্যমেও আমরা শিখে থাকি ৷
★ কিন্তু পেরিফেরিতে যেখানে আমাদের পাঠানোর চিন্তা করা হচ্ছে সেখানে উপরোক্ত দক্ষ চিকিৎসকগণের কেউই থাকেন না এবং উন্নত মেশিনপত্রও অনুপস্থিত ৷ অতএব নতুন কিছু শেখার বিন্দুমাত্র সুযোগ গ্রামাঞ্চলে নেই ৷ একজন চিকিৎসক সেখানে প্যারাসিটামল,রেনিটিডিন ছাড়া আর কিছু প্র্যাকটিস করতে পারবেন না ৷
★ আর একটা কথা দেশের মানুষের জন্য উল্লেখ করা প্রয়োজন ৷ সেটা হল পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্হা দেশের মানুষের কাছে আস্হার জায়গা ৷ সেই খোদ ভারতেই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি হতে হলে সময় লাগে ৮·৫ বছর ৷ সেখানে প্রস্তাবিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আমাদের লাগবে ১২·৫ বছর ৷ তাহলে এটা সহজেই অনুমেয় যে,দক্ষ চিকিৎসক হওয়াটা সময়ের ওপর যতটা না নির্ভর করে তার থেকে অনেক বেশি নির্ভর করে একটা শক্তিশালী সিস্টেমের ওপর ৷
ইন্টার্ন দুই বছর নয়, বেকার চিকিৎসকদের নিয়োগ দিন
প্রতিবছর অসংখ্য চিকিৎসক সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সর্বশেষ ৩৯তম স্পেশাল বিসিএসে প্রায় ৫ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবুও অসংখ্য চিকিৎসক চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর অন্যান্য সাধারণ বিসিএসের কথা বাদই দিলাম।
যে বিসিএসএ মাত্র ২০০-২৫০ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়। এই বেকার চিকিৎসকগুলো ভবঘুরে হয়ে ঘুড়ে বেড়ায়। তাদেরকে নিয়োগ দিতে কি অসুবিধা?
স্টুডেন্টদের ওপরে স্বাস্থ্যখাতের দায়িত্ব চাপিয়ে নিজেরা বেঁচে যাওয়া টাকা দিয়ে খেয়ে ভূড়ি টান করার চিন্তা করছেন। এটা নিতান্তই অমূলক। স্বল্পমূল্যে শ্রম ক্রয় করার চিন্তা বাদ দিতে হবে।
উল্লেখ করে রাখা ভালো যে, একজন বিসিএস ক্যাডার চিকিৎসককে ৩৫ হাজার অন্যদিকে একজন ইন্টার্নকে মাত্র ১৫ হাজার বেতন দিতে হয়। আমলাতান্ত্রিক একটা বড় ষড়যন্ত্র এইটা। জানি না তারা বুঝে নাকি না বুঝে এই সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন?
উপজেলা পর্যায়ে সদ্য পাস করা একজন ইন্টার্নের নিরাপত্তা কে দেবে?
বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিকিৎসা ব্যবস্থায় নারী চিকিৎসক কম করে বললেও ৬০ ভাগ। এই বিশাল সংখ্যক নারী চিকিৎসককে উপজেলা পর্যায়ে নিরাপত্তা কে দেবে?
যেখানে প্রতিনিয়ত ডিএমসি, সলিমুল্লাহ, সোহরাওয়ার্দীতে জনগণের গুগল নলেজের কারণে পুরুষ চিকিৎসককে হেনস্তা হতে হচ্ছে। বলবেন যে,নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন,তারপর প্রতি বছর যে বিপুল সংখ্যক ডাক্তার বেকার থাকছেন তাদেরকে নিয়োগ করুন।
★ একটা বনের হিংস্র জীবজন্তু পরিষ্কার করে সেখানে জনবসতি গড়ার পরিকল্পনা করতে হবে। বাঘ-ভাল্লুককে সঙ্গে নিয়ে ঘুমাতে থাকলে আস্তে আস্তে ওগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এটা ভাবা হাস্যকর।
এই নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে কিভাবে একজন নতুন চিকিৎসককে উপজেলায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়,এটা বোধগম্য হয় না।
স্বাস্থ্য-মন্ত্রণালয়, বিএমডিসি ও বিএমএর প্রতি আহ্বান
একটি কমিউনিটির ওপর কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার আগে সেই কমিউনিটির সব ধরণের মানুষের কথা চিন্তা করতে হবে। এই কমিউনিটির কিছু মানুষের হাত-পা হয়তো লম্বা। কিন্তু বেশিরভাগেরই ছোট।
বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা মানুষদের ওপরই আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা টিকে আছে। অনেক আগে পেশাটা পুঁজিপতিতের অধীনে ছিল। সময়ের পরিসরে তা তিরোহিত হচ্ছে।কর্তাব্যক্তিরা যারা আছেন তারা শুধু জুনিয়রদেরকে সন্তানের চোখে দেখবেন। মোটাদাগে আমরা আপনাদের প্রতিযোগী নই বরং সহযোগী। আপনাদের লিগ্যাসি আমরা কন্টিনিউ করবো। সেজন্য ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সহজ কিন্তু ইফেক্টিভ সিস্টেম দাঁড় করানোর আহ্বান জানাই আপনাদের প্রতি।
★ আর সবচেয়ে বড় কথা,দেশকে ভালো কিছু দিতে হলে ভালো এবং সুস্থ মানসিকতা প্রয়োজন। অসুস্থ শরীর নিয়ে যেমন কর্তব্য পালন করা যায় না,তেমনি ভগ্নহৃদয় নিয়েও কর্তব্য পালন করা যায় না।
কোনো সেক্টরের কর্মচারীদের থেকে ভালো আউটপুট পেতে হলে তাদের সুযোগ-সুবিধার প্রতি সর্বাগ্রে নজর দেয়া প্রয়োজন। যেখানে আমরা বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নিরাপত্তাসহ অন্যান্য মেজর ইস্যু নিয়ে চিন্তিত সেখানে নতুন করে এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটা বিশাল ছিদ্রের তৈরি করবে। তরুণ চিকিৎকদের এই অন্তরের ক্ষত কোন কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হবে না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চিকিৎসা পেশার প্রতি অনীহা তৈরি হবে।
এজন্য আপনাদের প্রতি সময় থাকতেই অনুরোধ,তরুণ চিকিৎসকদেরকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করুন। সর্বোপরি দেশের স্বাস্থ্যখাতকে বাঁচান।
লেখক: মাহদী হাসান, পঞ্চম বর্ষ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।