আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ডাবল প্রোমোশন পেয়ে তিনি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছিলেন মাত্র ১৩ বছর বয়সে। ১৭ বছর বয়সে বম্বে (মুম্বাই) ইউনিভার্সিটি থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। তখন নিয়ম ছিল, ২১ বছর বয়সের আগে আইনজীবী হওয়া যাবে না। শুধু এই মেধাবীর জন্য নিয়মের ব্যতিক্রম করা হয়েছিল।
তিনি রাম জেঠমলানী। জন্ম ১৯২৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। সাবেক বম্বে প্রেসিডেন্সির সিন্ধু প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা বুলচন্দ গুরমুখদাস জেঠমলানী এবং মায়ের নাম পার্বতী বুলচন্দ। জেঠমলানী পড়তেন করাচির এস সি সহানি আইন কলেজে। তখন সিন্ধু প্রদেশে বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় এই কলেজ ছিল বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। বাবার মতের বিপরীতে গিয়েই আইন পড়া তার।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে আত্মপ্রকাশ পেশাদার আইনজীবী হিসেবে। ওই বয়সে প্রথম বিয়ে করেন। সনাতন ভারতীয় রীতিতে বিয়ে করেছিলেন পরিবারের পছন্দের পাত্রী দুর্গাকে। প্রথম বিয়ের ছয় বছর পর ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ঠিক আগে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এবার পাত্রী নিজের পছন্দের। ঘর বাঁধলেন আইনজীবী পার্বতী সহানির সঙ্গে।
শেষ দিন পর্যন্ত দুই স্ত্রীকে নিয়েই অটুট ছিল তার সংসার। দুই পক্ষের স্ত্রীর থেকে মোট চার সন্তান তার। প্রথম স্ত্রী দুর্গার তিনজন সন্তান। রানি, শোভা এবং মহেশ। দ্বিতীয় স্ত্রী রত্নার একমাত্র ছেলে, জনক।
আইনচর্চা করলেও জেঠমলানীর জীবন ছিল বর্ণময়। ২০১৫ সালে শোরগোল ফেলেছিল কিশোর কুমারের স্ত্রী লীনা চন্দ্রভরকরকে চুম্বনরত অবস্থায় তার ছবি। তারও আগে অভিনেতা ধর্মেন্দ্রকে চুম্বনরত অবস্থায় জেঠমলানীর ছবি ছিল বিতর্কের কেন্দ্রে।
দেশভাগের আগেই সিন্ধু প্রদেশে মামলা লড়েছিলেন তিনি। করাচিতে শুরু করেছিলেন ‘ল’ ফার্ম। কিন্তু উত্তপ্ত পরিস্থিতির জন্য করাচি ছাড়তে বাধ্য হন। পকেটে মাত্র এক পয়সা নিয়ে চলে যান ওয়াঘার এপারে। তৎকালীন বম্বে শহরে শুরু করেন একেবারে শূন্য থেকে। পরবর্তী জীবনে হয়েছিলেন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত আইনজীবী।
উদ্বাস্তু জেঠমলানীর বম্বেতে প্রথম মামলা ছিল শরণার্থীদের জন্য। সে সময় সদ্য চালু হওয়া বম্বে রিফিউজিস অ্যাক্ট ছিল শরণার্থীদের প্রতি অমানবিক। ওই আইনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন এবং জয়ী হয়েছিলেন রাম জেঠমলানী।
প্রায় ১০ বছর পর তিনি খবরের শিরোনামে আসেন নানাবতী মামলায়। ষাটের দশকের শেষে চোরাচালান সংক্রান্ত মামলায় অভিযুক্তদের হয়ে মামলা লড়ায় তার নাম হয়েছিল ‘স্মাগলার্স ল’ইয়ার’।
হাই প্রোফাইল ডিফেন্স মামলায় ছিলেন বলিষ্ঠ নাম। অসংখ্যবার অভিযুক্তদের হয়ে আদালতে গেছেন। হর্ষদ মেটা, কেতন পারেখ, ডেইডি অ্যাঙ্গাস, হাওয়ালা কাণ্ডে অভিযুক্ত এল কে আডবাণী, জেসিকা লাল হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত মনু শর্মা, আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন হাজি মস্তান; সবার হয়ে সওয়াল করেছেন তিনি।
ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডেও অভিযুক্তদের আইনজীবী হিসেবে দেখা গেছে তাকে। তালিকা আরো দীর্ঘ। টু জি স্পেকট্রাম কাণ্ডে কানিমোজি, আর্থিক তছরূপে জগনমোহন রেড্ডি, খনি মামলায় ইয়েদুরাপ্পা, সোহরাবুদ্দিন মামলায় অমিত শাহর আইনজীবী ছিলেন তিনি।
বাবা রামদেব, আশারাম বাপু, লালুপ্রসাদ যাদব, সুব্রত রায়, জয়ললিতা, অরবিন্দ কেজরীবালরা অভিযুক্ত হয়ে রাম জেঠমলানীর শরণ নিয়েছিলেন।১৯৭৫-১৯৭৭ সালে তিনি ছিলেন বার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান। ইন্দিরা গান্ধীর সমালোচনা করায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরে ভারতে আইনজীবী মহলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠায় তা নাকচ হয়ে যায়। ওই বিতর্কের মধ্যেই জেঠমলানী কানাডা চলে যান। দেশে ফেরেন ১০ মাস পরে, জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর।
সত্তরের দশকের শেষ থেকে শুরু পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক জীবন। বিজেপির টিকিটে জয়ী হয়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম লোকসভার সদস্য হন। ১৯৯৬ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে আইনমন্ত্রী হন। ১৯৯৮ সালে দায়িত্ব পান কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের। এর পর ১৯৯৯ সালে ফের আইনমন্ত্রী হন। তার আগে ১৯৯৫ সালে নিজের দল তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সে যাত্রা বেশি দীর্ঘ হয়নি
২০০৪ সালে নির্দল প্রার্থী হিসেবে লখনৌ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন অটলবিহারী বাজপেয়ীর বিরুদ্ধে। কিন্তু পরাজিত হন। আবার ২০১০ সালে বিজেপি-র টিকিটে রাজস্থান থেকে রাজ্যসভার সদস্য হন। দলবিরোধী মন্তব্যের জেরে তিনি বিজেপি থেকে বহিষ্কৃত হন ২০১২ সালে।
২০১৭ সালে জীবনাবসান ঘটে তার। ৯৬ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ আগে চলে গেলেন। ২০১৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। রেখে যাওয়া ব্যাটন তুলে নিয়েছেন তার ছেলে মহেশ এবং মেয়ে রানি। দু’জনেই প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।