অন্যরকম খবর ডেস্ক : ‘নতুন আত্মীয়তা করতে কনে বা বর দেখার সুবাদে যারা গ্রামে আসেন, দুর্গন্ধে কেউ রাস্তা থেকেই বিদায় নেন, আবার কেউ বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে বিদায় নেন। অনেকে আবার গ্রামের নাম শুনেই আত্মীয়তা করার আগ্রহ হারান। যারা সব মেনে নিয়ে আত্মীয়তা করেন, তাদের সংখ্যা নেহাতই কম। পুরোনো আত্মীয়ের বাড়ি এলেও খুব একটা সময় অবস্থান করেন না।’ কথাগুলো বলছিলেন সরকারি এম এম আলী কলেজের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও ঘাটাইল উপজেলার লক্ষীন্দর ইউনিয়নের সিদ্দিখালী গ্রামের রমজান আলী। এমন ভোগান্তি প্যারাগন নামে একটি ডিম ও জৈবসার উৎপাদক কোম্পানির কারণে। শুধু সিদ্দিখালী গ্রাম নয়, দুর্গন্ধে উত্তর লক্ষীন্দর, বাঘারা, ডিগ্রিভূমি, সানবান্দাসহ দুলালিয়া গ্রামেও অন্য এলাকার মানুষ আত্মীয়তা করতে চায় না। কোম্পানির নির্গত বিষাক্ত গ্যাসে জনজীবন নাকাল হলেও ঠিকই মিলেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র।
ঘাটাইল উপজেলার ঘনবসতিপূর্ণ গ্রাম সানবান্দা। এই গ্রামে ১০ বছর আগে ২০১৪ সালে স্থাপন করা হয় প্যারাগন নামে একটি কোম্পানি। এর ১০০ গজের ভেতরে সানবান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সরকারি আবাসন প্রকল্প। অল্প একটু দূরেই সিদ্দিখালী নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ওই কোম্পানিতে দু’দিন গেলেও প্রবেশের অনুমতি মেলেনি। কোথাও কোনো সাইনবোর্ড, এমনকি দেয়ালেও লেখা নেই কোম্পানিটির নাম। তবে ফটকে থাকা নিরাপত্তারক্ষী এবং এলাকাবাসী জানান, এটি ডিম এবং জৈবসার উৎপাদনকারী কোম্পানি, যার নাম ‘প্যারাগন’।
স্থানীয়রা জানান, বিশাল আয়তন নিয়ে করা এই কোম্পানিতে ডিম পাড়া মুরগির সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। মুরগির বাচ্চা ১ লাখ। এই মুরগি থেকে যে বিষ্ঠা হয়, তা দিয়ে তৈরি করা হয় জৈবসার। জৈবসার প্রস্তুতের সময় মূলত সৃষ্টি হয় দুর্গন্ধ। মুরগির কাঁচা বিষ্ঠা উচ্চমাত্রায় বৈদ্যুতিক তাপ প্রয়োগ করে শুকিয়ে এ সার উৎপাদন করা হয়। উচ্চমাত্রায় তাপ প্রয়োগের ফলে বিষ্ঠার জলীয় অংশ বাষ্প হয়ে বাতাসে মিশে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। গন্ধ তীব্র ঝাঁজাল। এ ছাড়া যে মুরগিগুলো মারা যায়, সেগুলো খোলা জায়গায় পোড়ানো হয়। প্রতি রাতেই আগুনে মরা মুরগি পোড়ানোর গন্ধ আসে।
লক্ষীন্দর গ্রামের মেহেদি হাসান বলেন, দুর্গন্ধে দিনে ভাত খেতে হয় দরজা-জানালা বন্ধ করে। সবসময় মুখে মাস্ক পরে থাকতে হয়। এমনকি রাতে ঘুমানোর সময়ও। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে।
সিদ্দিখালী গ্রামের রমজান আলী বলেন, দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্টকর। দম বন্ধ হয়ে আসে। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর সঙ্গে সখ্য রয়েছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের। কোম্পানির পক্ষ থেকে তাদের জন্য নাকি মাসোহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেউ কিছু বলতে গেলে ওই সুবিধাভোগীদের দিয়ে হুমকি দেওয়া হয়। যার কারণে ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহসটুকুও এখন হারিয়ে ফেলেছেন এলাকাবাসী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ভোগান্তি থেকে নিস্তার পেতে বিভিন্ন সময় এলাকাবাসী গণস্বাক্ষর করে ইউএনও থেকে শুরু করে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর চারবার লিখিত অভিযোগ করেছে। কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পোহাচ্ছেন বৃদ্ধ ও শিশুরা।
দুলালিয়া গ্রামের বৃদ্ধ আব্দুল জলিল বলেন, দুর্গন্ধে রাতে ঘুম ভেঙে যায়, সহজে আর ঘুম আসে না। শ্বাসকষ্ট হয়।
কথা হয় সিদ্দিখালী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সামিয়া আক্তার ও সপ্তম শ্রেণির সাদিয়া আক্তারের সঙ্গে। তারা বলে, দুর্গন্ধে বাড়ি কিংবা স্কুলে কোথাও লেখাপড়ার পরিবেশ নেই।
সিদ্দিখালী নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনীন্দ্র চন্দ্র দাস বলেন, ‘দুর্গন্ধের মাত্রা যখন ছাড়িয়ে যায়, শিক্ষার্থীদের আবেদনের ভিত্তিতে স্কুল ছুটি দিতে বাধ্য হই। শ্রেণিকক্ষে কথা বলাই অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে দুই বছর আগে মানববন্ধন করা হয়। লিখিতভাবে জানানো হয় ইউএনও ও স্থানীয় এমপিকে। কিন্তু কোনো কাজে আসছে না। এরই মধ্যে অনেক
ছাত্রী স্কুল থেকে অন্যত্র চলে গেছে। এর একটা সমাধান হওয়া দরকার।’
প্যারাগন কোম্পানির সহকারী ম্যানেজার মো. কায়সারের ভাষ্য, মুরগির বিষ্ঠা থেকে জৈবসার তৈরি করা হয়। দুর্গন্ধ সবসময় সৃষ্টি হয় না, মাঝেমধ্যে হয়। এমন হলে ওষুধ প্রয়োগ করে দুর্গন্ধ দূর করা হয়।
ইলন মাস্ক চাকরির সাক্ষাৎকারে মিথ্যাবাদীদের শনাক্ত করেন যেভাবে
লক্ষীন্দর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, দুর্গন্ধের কারণে ওই এলাকায় মানুষ ঘরবাড়িতে থাকতে পারে না। উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েও কাজ হচ্ছে না। নতুন করে যে মানুষ ওই গ্রামগুলোতে আত্মীয়তা করতে চায় না, এ কথা সত্য।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠান কীভাবে ছাড়পত্র পেল? এমন প্রশ্নের জবাবে টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সজীব কুমার ঘোষ সমকালকে জানান, ছাড়পত্রটি প্রায় ১০ বছর আগে নেওয়া। এলাকাবাসীর ভোগান্তির বিষয়ে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঘাটাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইরতিজা হাসান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি অবগত নই। বিষয়টি জানতে পারলাম, অতিদ্রুতই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।