হক ফারুক আহমেদ : দেশে প্রতি বছর বিষধর সাপের কামড়ে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে দেরি করে চিকিৎসা নেওয়াকে দায়ী করা হলেও দেশে সাপের কামড়ের চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিভেনমের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুসারে সাপের কামড়ের চিকিৎসার কার্যকর সমাধান পেতে নিজ দেশের বিভিন্ন জাতের বিষধর সাপের বিষ থেকে এন্টিভেনম তৈরি করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো কোনো এন্টিভেনম তৈরি করে না।
ভারত থেকে এন্টিভেনম আনা হয়। সেখানকার সাপের বিষ থেকে এ এন্টিভেনম তৈরি করা হয়। তবে একই প্রজাতির ভারতীয় সাপ ও বাংলাদেশের সাপের বৈশিষ্ট্য এক নয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ কারণে ভারতীয় এন্টিভেনম ব্যবহার করে অনেক ক্ষেত্রে সুফল মেলে না।
দেশে প্রতি বছর কত ভায়াল এন্টিভেনম প্রয়োজন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও চিকিৎসায় ব্যবহৃত ভারতীয় এন্টিভেনমের সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় কম। জটিল ও সময়সাপেক্ষ বিষয় হলেও সাপের কামড়ে কার্যকরী চিকিৎসায় দেশীয় বিষধর সাপ থেকে এন্টিভেনম তৈরিই প্রকৃত সমাধান হিসাবে দেখছেন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা।
দেশে বিষধর সাপের বিষ সংগ্রহ এবং ‘এন্টিবডি’ তৈরির কার্যক্রম শুরু হলেও প্রশাসনিক অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
ডব্লিউএইচও’র মতে, প্রতি বছর বিশ্বে এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। ২০২২ সালের ৫ নভেম্বর ভারতীয় পত্রিকা দ্য হিন্দু’র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি বছর দেশটিতে সাপের কামড়ে ৬৪ হাজার মানুষ মারা যায়।
বাংলাদেশের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনসিডিসি) এক সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী-দেশে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয় এবং সাড়ে সাত হাজার মানুষ মারা যায়। অনেকে সাপের কামড়ে বেঁচে গেলেও অঙ্গহানিসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। সাপের কামড়ের এ হার অনেক দেশের তুলনায় উদ্বেগজনক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসেলস ভাইপার দেশে আরও ছড়িয়ে পড়লে মৃত্যুর সংখ্যা আগামীতে আরও বাড়তে পারে।
দেশে মূলত যে কয় ধরনের সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যু হয়-তার মধ্যে অন্যতম পদ্ম গোখরা এবং কয়েক প্রজাতির কেউটে বা কালাচ। এর সঙ্গে ১৪ বছরে নদী অববাহিকা হয়ে দেশে আসা রাসেলস ভাইপার (চন্দ্রবোড়া সাপ) যুক্ত হয়েছে। পিট ভাইপার বা সবুজবোড়া সাপ কামড়ানোর ঘটনা বেশি হলেও মৃত্যু কম। তবে অঙ্গহানি হয়। সাপের বিষ নষ্ট করার উপায় হলো এন্টিভেনমের প্রয়োগ (নির্বিষ করা)। এন্টিভেনম দুই ধরনের হয়।
পলিভেলেন্ট স্নেক এন্টিভেনম, যা দুই বা ততোধিক সাপের বিষক্রিয়ায় কাজ করে। অন্যটি মনোভেলেন্ট স্নেক এন্টিভেনম, যা নির্দিষ্ট একটি সাপের বিষক্রিয়া নষ্ট করতে কাজ করে। দেশের হাসপাতালগুলোতে যে এন্টিভেনম ব্যবহার করা হয় তা পলিভেলেন্ট স্নেক এন্টিভেনম। এটি ভারত থেকে আসে এবং ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস বাজারজাত করে।
মূলত ভারতীয় গোখরা, কালাচ, রাসেলস ভাইপার এবং স স্কেলড ভাইপারের বিষ থেকে এ এন্টিভেনম তৈরি করা হয়। বিষধর সাপ কামড়ানোর পর শরীরে বিষের লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে ১০টি করে এন্টিভেনম ইনজেকশন দিতে হয়। ১০টি ভায়ালে একটি ডোজ। ক্ষেত্র বিশেষে বেশিও দিতে হতে পারে।
দেশে এন্টিভেনমের চাহিদা ও যোগানের বিষয়ে জানতে চাইলে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, দেশে সাপের কামড়ের প্রতিবেদনগুলো সঠিকভাবে এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) হয় না। ইনজুরির মধ্যে চলে আসে। এর মধ্যে বার্নিং, পয়জনিং সব আছে। এ কারণে এন্টিভেনমের সঠিক চাহিদা আমরা জানি না। আমরা বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এন্টিভেনম কিনে সরবরাহ করি।
সাপ নিয়ে গবেষণা করা অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, বছরে সাপেকাটা মানুষের মৃত্যু সাত হাজার হলে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা আরও অনেক বেশি। বছরে ন্যূনতম ১০ হাজার সাপেকাটা রোগীর জন্য ১০টি ভায়াল হিসাব ধরেও কমপক্ষে এক লাখ ভায়াল এন্টিভেনম দরকার। কিন্তু দেশে এর অনেক কম এন্টিভেনম সরবরাহ করা হয়।
দেশে বর্তমানে সাপের এন্টিভেনমের চাহিদা অনুযায়ী যোগান নেই-স্বীকার করে ডা. রোবেদ আমিন বলেন, এন্টিভেনমের অর্ডার দুই-তিন মাস আগে দিলেও পাওয়া যায় না। গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট অর্ডার হলেও ইনসেপটার মাধ্যমে আনতে হয়। বর্তমানে এন্টিভেনমের সাপ্লাই চেইনে সমস্যা আছে। এ বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যে ডব্লিউএইচও’র সঙ্গে আলাপ করেছি। তাদের মাধ্যমে এন্টিভেনম তাড়াতাড়ি পাব বলে আশা করছি।
ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালসের সিনিয়র মার্কেটিং ম্যানেজার ফারহানা লাইজু বলেন, বছরের অন্যসব সময়ের তুলনায় বর্ষা এবং বন্যার সময়ে এন্টিভেনমের চাহিদা বেড়ে যায়।
দেশীয় বিষধর সাপ থেকে এন্টিভেনম তৈরিই প্রকৃত সমাধানের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে ডা. রোবেদ আমিন বলেন, আমাদের নিজস্ব এন্টিভেনম তৈরি করতে হবে। ভারতের সাপ ও বাংলাদেশের সাপের বৈশিষ্ট্য এক নয়। ভারতীয় এন্টিভেনমগুলো প্রতিরোধক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ কাজ করতে পারে। যদি যথাযথ চিকিৎসার কথা বলা হয়-তাহলে নিজস্ব এন্টিভেনমেই সমাধান খুঁজতে হবে। এজন্য ভেনম রিসার্চ সেন্টারের উদ্যোগ নিয়েছে এনসিডিসি। যাতে দেশীয় সাপের বিষ সংগ্রহ করা যায়। এন্টিভেনম তৈরির প্রক্রিয়া সহজ নয়, দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। তবে শুরু করা গেছে। বিষ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
পাঁচ বছর আগে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনসিডিসি) কর্তৃপক্ষের কাছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টার একটি গবেষণার জন্য আবেদন করে। এন্টিভেনম তৈরির প্রক্রিয়া হিসাবে দেশীয় বিষধর সব সাপের জাত সংগ্রহ, তাদের লালন-পালন, বিষ সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর আওতায় এখন পর্যন্ত ৩৫০টি সাপ সংগ্রহ করা হয়। ইতোমধ্যে সাপগুলো থেকে ৫০০ গ্রামের বেশি বিষ সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে রাসেলস ভাইপারের বিষ থেকে ‘এন্টিবডি’ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ভেনম রিসার্চ সেন্টার সূত্রে জানা যায়, এ কাজে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে সাপ সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য কাজ। সাপ প্রকৃতিতে থাকে। কিন্তু তাকে বাক্সবন্দি করে লালন পালন বেশ জটিল প্রক্রিয়া। সাপের বিষের নানা পরীক্ষা বিশ্বের মাত্র কয়েকটি ল্যাবে হয়। চাইলেই বিষ বাইরে থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে আসা যায় না।
দেশের বাইরে এ বিষ পাঠানোর জন্য অনেক আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিতে হয়। জানা গেছে, কোবরা বা রাসেলস ভাইপারের বিষ সংগ্রহ কিছুটা সহজ। কারণ তাদের বিষের পরিমান বেশি থাকে। কিন্তু কেউটে বা কালাচ সাপের বিষ উৎপন্ন হয় খুব অল্প। এন্টিভেনম তৈরি করতে গেলে যথেষ্ট পরিমাণে বিষের প্রয়োজন হয়। ভেনম রিসার্চ সেন্টারের সঙ্গে এরইমধ্যে ডব্লিউএইচও যুক্ত হয়েছে। তাদের ল্যাব স্থাপনের জন্য যন্ত্রপাতি, ল্যাবরেটরি সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে।
দেশীয় সাপের বিষ থেকে এন্টিভেনম পেতে কতটা সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ভেনম রিসার্চ সেন্টারের সমন্বয়ক ডা. আবদুলল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, এটি বলা মুশকিল। আমরা কতটা এগুতে পারি-এর উপর নির্ভর করবে অনেক বিষয়। সব মিলিয়ে দুই-তিন বছর লাগতে পারে। ডব্লিউএইচও’র ভূমিকা ও তাদের সহযোগিতায়, যেসব ল্যাবে বিষের পরীক্ষা হবে সেসবের সহযোগিতা, বিষ সংগ্রহের পরিমাণ, প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার সমাধানসহ বেশ কয়েকটি নিয়ামকের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে।
ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, দেশের সব বিষধর সাপের এন্টিভেনম তৈরি করা আমাদের দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য। এটি ধীরে ধীরে বিকাশ করতে হবে। এন্টিভেনম তৈরি একটি লম্বা সময়ের জটিল প্রক্রিয়া।
থাইল্যান্ডে কুইনস ওভাবা মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট ১৯১২ সালে তাদের কাজ শুরু করে। তাদের যে ডেভেলপ তা খুব বেশি দিন আগে হয়নি। আমরা আরেকটু আগে শুরু করলে ভালো হতো। তবে পৃথিবীর অনেক দেশ এখনো শুরুই করতে পারেনি। সেই তুলনায় আমরা এগিয়ে আছি। সূত্র : যুগান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।