রোগজীবাণু কিংবা ক্ষতিকারক জিনিসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য দেহে দুই ধরনের সুরক্ষাব্যবস্থা (immune system) রয়েছে—সহজাত (innate) ও অভিযোজনমূলক/অর্জিত (adaptive/acquired)। সহজাত সুরক্ষা অনেকটা মোটা দাগের ব্যবস্থা। সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিটি হুমকির মোকাবিলা আলাদা উপায়ে না করে সেটা অনেকটা একই ধাঁচে কাজ করতে থাকে।
যেমন: একটা নির্দিষ্ট আকারের থেকে বড় এবং ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত গৎবাঁধা নকশাওয়ালা কোনো অণু বা অণুসমষ্টি পেলেই ডেনড্রাইটিক কোষ তা কোষভক্ষণ (phagocytosis) প্রক্রিয়ায় খেয়ে হজম করে ফেলে। সেই বস্তুটি আসলে কিসের এবং কী ধরনের ঝুঁকি তার থাকতে পারে অথবা আদৌ সেটা খাওয়া ঠিক হচ্ছে কি না কিংবা কীভাবে তা ভবিষ্যতে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করা যায়, এত সব বাছবিচার করে না।
অন্যদিকে ভিন্ন ভিন্ন ঝুঁকির জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিশেষায়িত সমাধান দেয় অর্জিত সুরক্ষাব্যবস্থা। প্রায় ৪০ কোটি বছর আগে কনড্রিকথিস শ্রেণিভুক্ত (অর্থাৎ হাঙর প্রভৃতি চোয়ালবিশিষ্ট তরুণাস্থিময় মাছ) জীবে প্রথম উদ্ভূত এই ব্যবস্থা কিন্তু আগে থেকে থাকা সহজাত সুরক্ষাব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
যেমন: ডেনড্রাইটিক কোষ যখন কোনো কিছু খেয়ে হজম করে, এরপর সেই জিনিসের ছোট ছোট টুকরো (antigen) তার নিজের কোষঝিল্লির বাইরের দিকে লাগিয়ে রেখে একরকমের প্রদর্শনী করতে থাকে। একে বলে অ্যান্টিজেন উপস্থাপন (antigen presentation)।
অর্জিত সুরক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত কোনো কোষ যেমন: লিম্ফোসাইট সেই উপস্থাপিত টুকরোটির সঙ্গে নিজের কোষঝিল্লির বিশেষ প্রোটিনের সংযোগ স্থাপন করতে পারলে উদ্দীপ্ত হয় এবং সুনির্দিষ্টভাবে সেই টুকরোটির আসল বাহকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজ শুরু করতে পারে। আমাদের দেহের অর্জিত সুরক্ষাব্যবস্থা এ রকম প্রায় ১০ লাখ থেকে এক কোটি (107–108) ধরনের ভিন্ন ভিন্ন অ্যান্টিজেন আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারে এবং সেগুলোর প্রতিটির বিরুদ্ধে পৃথকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে।
প্রত্যেক প্রকার অ্যান্টিজেনের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট সংযোগ স্থাপন করতে হলে কমপক্ষে তত প্রকার প্রোটিন দরকার। আর প্রত্যেক প্রকার প্রোটিন তৈরির সংকেত দেওয়ার জন্য কমপক্ষে একটি করে জিন দরকার। কিন্তু মানুষের জিনের সংখ্যা তো সাকুল্যে কুড়ি হাজারের মতো!
এ সমস্যার সমাধান বের করে ১৯৮৭ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পান জাপানের সুসুমু তোনেগাওয়া। তিনি দেখান, গুটিকতক জিন নিজেদের মধ্যে বিন্যাস-সমাবেশ ঘটিয়ে লাখো-কোটি ধরনের ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিন তৈরির সংকেত দিতে পারে। অর্জিত সুরক্ষার অন্যতম কোষ লিম্ফোসাইটগুলো। যখন জন্মায়, তখন সেগুলোর মধ্যে উল্লিখিত জিনগুলোর ওলট-পালট ঘটে অনেকটা র৵ান্ডম বা দৈবচয়ন ভিত্তিতে।
তাই কোনো একটি বিশেষ অ্যান্টিজেনের সঙ্গে সংযোগ ঘটানোর মতো প্রোটিন তৈরি হয় মাত্র গুটিকতক (10-1000) লিম্ফোসাইটের মধ্যে। বি-লিম্ফোসাইট ও টি-লিম্ফোসাইটের ক্ষেত্রে সেই প্রোটিনকে যথাক্রমে অ্যান্টিবডি এবং টি-সেল রিসেপ্টর (TCR) বলে। এ রকম হতে পারে যে হয়তো সেই অ্যান্টিজেনের সংস্পর্শে জীবনে কখনোই আসা হলো না কিংবা প্রকৃতিতে হয়তো সেই অ্যান্টিবডি বা টিসিআরের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার মতো অ্যান্টিজেনই নেই।
কিন্তু যদি এমন কোনো অ্যান্টিজেন দেহে ঢোকে, যেটা লিম্ফোসাইটের সিলেবাসে ‘কমন’ পড়েছে? অর্থাৎ লক্ষাধিক প্রকারের অ্যান্টিবডি বা টিসিআরের মধ্যে কোনো একটির সঙ্গে তা সুনির্দিষ্টভাবে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষমতা রাখে, তাহলে সেই বিশেষ প্রোটিন ধারণকারী গুটিকতক লিম্ফোসাইট সাঁই সাঁই করে নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলে। এরপর ওই অ্যান্টিজেন ও তার বাহককে আক্রমণ করতে থাকে।
ডেঙ্গু ভাইরাসের ক্ষেত্রে আক্রমণ বলতে বোঝানো হচ্ছে মূলত দুটি বিষয়। প্রথমত, ডেঙ্গু ভাইরাসের ই এবং প্রি-এম প্রোটিনের সঙ্গে আটকে যেতে পারে, এমন অ্যান্টিবডি দিয়ে ভাইরাসটিকে রীতিমতো চারপাশ থেকে আবৃত করে ফেলা যেতে পারে। ফলে সেটা নতুন করে কোনো কোষে ঢুকতে না পারে।
কেননা, ওই প্রোটিনগুলোই তো ভাইরাসের কোষে ঢোকার চাবি। সেই চাবির আকৃতি পাল্টে গেলে তা আর কাজ করবে না। দ্বিতীয়ত, এনএস১ অ্যান্টিজেন উপস্থাপনকারী কোষগুলোর সঙ্গে টি-লিম্ফোসাইটের উপযুক্ত টিসিআর আটকে দিয়ে সেই কোষটিকে ধ্বংস করে ফেলা। কেননা, এনএস১–বাহী কোষটির পেটের ভেতর নিশ্চয়ই ডেঙ্গু ভাইরাস কিলবিল করছে। নইলে এনএস১ আসবে কোত্থেকে! এ জন্যই ডেঙ্গু জ্বরের তিন থেকে চার দিন পর থেকে এটা রক্ত পরীক্ষায় আর শনাক্ত করা যায় না। কেননা, এনএস১বাহী কোষগুলো এর মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।