ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই উঠে পড়েন ফারহানা আক্তার। ঢাকার অলিগলির শব্দ এখনো তাকে স্পর্শ করেনি। নিঃস্তব্ধতার এই নির্মল মুহূর্তে তার হাতে একমাত্র সঙ্গী – পবিত্র কোরআন মজিদ। কয়েক মাস আগেও তার দিন শুরু হতো অফিসের তাড়া বা সংসারের চিন্তায়। কিন্তু আজ? আজ তার সকালের প্রতিটি মিনিট ছেয়ে যায় কোরআনের বাণীতে, আয়াতের মধুর ধ্বনিতে। শুধু ফারহানা নন; রাজশাহীর কৃষক আব্দুর রহিম, চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সাকিব, এমনকি কুমিল্লার গৃহিণী সালমা – প্রতিদিনের জীবনের ব্যস্ততার মাঝেও তারা খুঁজে নিয়েছেন এক অমূল্য সময়। দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতি শুধু একটি অভ্যাস নয়; এটি তাদের জীবনে এনেছে এক গভীর প্রশান্তি, দিয়েছে দিকনির্দেশনা, তৈরি করেছে এক অদৃশ্য কিন্তু মজবুত ভিত। কোরআন মুখস্থ করা কি তাহলে শুধু কিছু গুণী মানুষের জন্যই সংরক্ষিত? একেবারেই না! নিয়মিত, ছোট ছোট পদক্ষেপে, সহজ উপায়ে যে কেউ চাইলেই তার হৃদয়ে স্থান দিতে পারেন মহান আল্লাহর বাণী। আসুন, জেনে নেই সেই সহজ পদ্ধতি, যার মাধ্যমে আপনিও আপনার দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলতে পারেন কোরআন মুখস্থ করার এই মহৎ সাধনাকে।
Table of Contents
দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতি: কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
কোরআনুল কারিম শুধুমাত্র একটি ধর্মগ্রন্থ নয়; এটি মুমিনের জীবনের পরিপূর্ণ দিকনির্দেশিকা, সান্ত্বনার উৎস এবং আধ্যাত্মিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে আমরা শুধু শব্দগুলোই আয়ত্ত করি না, বরং এর গভীর অর্থ ও বার্তাকে হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগ পাই, যা আমাদের দৈনন্দিন চিন্তা, আচরণ ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।
- আধ্যাত্মিক সংযোগ ও প্রশান্তি: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে কোরআনের সাথে বসা মানে মহান রবের সাথে সরাসরি কথোপকথনের সুযোগ তৈরি করা। এই মুহূর্তগুলোতে মন প্রশান্ত হয়, দুশ্চিন্তা দূর হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্মীয় পাঠ বা ধ্যান মনস্তাত্ত্বিক চাপ কমাতে সহায়ক (সূত্র: আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন গবেষণা)।
- জীবন পরিচালনার দিকনির্দেশনা: কোরআনের প্রতিটি আয়াত আমাদের জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবেলার পথ দেখায়। সুরা আল-বাকারার আয়াতগুলো যেমন ধৈর্য ও তাওয়াক্কুলের শিক্ষা দেয়, তেমনি সুরা আর-রহমান সৃষ্টির সৌন্দর্য ও আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মুখস্থ থাকলে এই শিক্ষাগুলো সহজেই প্রয়োগ করা যায়।
- মানসিক স্বাস্থ্য ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি: নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াত ও মুখস্থ করা মস্তিষ্কের জন্য এক ধরনের ব্যায়াম। এটি স্মৃতিশক্তি, একাগ্রতা এবং বোধশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। বিশেষ করে দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতি অনুসরণ করলে মস্তিষ্কের নিউরোপ্লাস্টিসিটি বাড়ে।
- সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ়করণ: পরিবারের সদস্যরা একসাথে বসে কোরআন তিলাওয়াত ও মুখস্থ করলে পারস্পরিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়, ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা হয় এবং একটি পবিত্র পরিবেশ তৈরি হয়। মা-বাবার মুখস্থ করা সন্তানের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়।
- পরকালীন সফলতার সোপান: হাদিসে কোরআনের ধারক-বাহকদের (হাফেজ/হাফেজা) জন্য বিশেষ মর্যাদা ও সুসংবাদের কথা উল্লেখ আছে। দৈনিক এই চর্চা সেই মহান লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রথম ধাপ।
বাস্তব জীবনের প্রেরণা: খুলনার এক কর্মব্যস্ত ব্যাংক কর্মকর্তা, রিয়াজ উদ্দিন। প্রতিদিন অফিস যাওয়ার আগে মাত্র ২০ মিনিট করে তিনি সুরা মুখস্থ করেন। শুরু করেছিলেন ছোট একটি সুরা দিয়ে। আজ তিন বছরে তিনি প্রায় দেড় পারা মুখস্থ করে ফেলেছেন। তাঁর মতে, “এই দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতি আমার দিনকে গুছিয়ে দেয়। যানজটেও কোরআনের আয়াত ঝালাই করি। মনে শান্তি পাই, কাজে মনোযোগ বাড়ে।
দৈনিক সুরা মুখস্থ করার সহজ ও কার্যকরী পদ্ধতি: ধাপে ধাপে গাইডলাইন
কোরআন মুখস্থ করা একটি পবিত্র সফর। এই সফরকে আনন্দময় ও ফলপ্রসূ করতে প্রয়োজন দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতির সঠিক অনুসরণ। আসুন জেনে নেই সেই সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবসম্মত কৌশলগুলো:
১. নিয়ত ও মনোবল: অটুট আন্তরিকতা
- পরিষ্কার নিয়ত: মুখস্থ করার পেছনে একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাঁর বাণীকে অন্তরে ধারণ করা। দুনিয়াবী কোনো স্বার্থ (যেমন, শুধু সমাজে সম্মান পাওয়ার জন্য) প্রাধান্য পেলে প্রকৃত ফায়দা কমে যায়।
- দৃঢ় সংকল্প (আযম): মনে রাখবেন, এটি একটি ম্যারাথন, স্প্রিন্ট নয়। প্রতিদিন অল্প অল্প করেই এগোতে হবে। হাফেজ হওয়ার চিন্তা নয়, বরং আজকের নির্ধারিত অংশটুকু ঠিকমতো আয়ত্ত করার দিকে মনোনিবেশ করুন।
- ধৈর্য ধারণ: ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক। হতাশ না হয়ে বারবার চর্চা করুন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোরআন পড়ে আর তা মুখস্থ করে, কিন্তু তা তার জন্য সহজ মনে হয়, সে দ্বিগুণ সওয়াব পাবে।” (বুখারী)।
২. সময় ও স্থান নির্ধারণ: অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি
- সবচেয়ে উত্তম সময়: ফজরের নামাজের পরের সময়টুকুকে সর্বোত্তম মনে করা হয়। মন তখন সতেজ, পরিবেশ শান্ত থাকে। বিকেল বা রাতের শান্ত সময়ও ভালো বিকল্প।
- স্থায়ী স্থান: ঘরের একটি নির্দিষ্ট কোণ, মসজিদের শান্ত অংশ বা যে কোনো জায়গা যেখানে ন্যূনতম বিরক্তির সম্ভাবনা থাকে, সেটি বেছে নিন। এই স্থানটিকে কোরআনের জন্য নির্ধারিত করে ফেলুন।
- সময়ের পরিমাণ: প্রতিদিন অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ করুন। শুরুতে মাত্র ১৫-২০ মিনিট দিয়েই শুরু করুন। সামর্থ্য অনুযায়ী ধীরে ধীরে সময় বাড়াতে পারেন (৩০-৪৫ মিনিট)। গুরুত্বপূর্ণ: প্রতিদিনের জন্য ছোট, বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ঠিক করুন (যেমন: আজ ৩-৫ লাইন মুখস্থ করব)।
৩. প্রস্তুতি ও পদ্ধতি: বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মুখস্থকরণ
ক. সঠিক উচ্চারণ শেখা (তাজবিদের প্রাথমিক জ্ঞান)
- আদর্শ শিক্ষকের সন্ধান: মুখস্থ করার আগে সুরাটির সঠিক উচ্চারণ শেখা অপরিহার্য। কোনো অভিজ্ঞ হাফেজ, স্থানীয় মসজিদের ইমাম বা বিশ্বস্ত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম (যেমন: Quran.com বা Bayyinah TV-এর বাংলা রিসোর্স) থেকে তাজবিদের মৌলিক নিয়ম (নুন সাকিনা, মিম সাকিনা, মদ্দ, গুননা ইত্যাদি) শিখুন। ভুল উচ্চারণে মুখস্থ করা থেকে বিরত থাকুন।
- অডিওর সহায়তা: মিশারী রশিদ আল-আফাসি, আব্দুল বাসিত আব্দুস সামাদ বা মাহমুদ খলিল আল-হুসারির মতো প্রসিদ্ধ কারিদের তিলাওয়াত শুনুন। তাদের অনুসরণ করে বারবার পড়ার চেষ্টা করুন।
খ. ধাপে ধাপে মুখস্থকরণ পদ্ধতি
- পঠন ও পর্যবেক্ষণ (Read & Observe): প্রথমে নির্ধারিত অংশটি (যেমন: ৩-৫ আয়াত) মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। শব্দগুলো দেখুন, আয়াতের শুরু-শেষ চিহ্নিত করুন। অর্থ বোঝার চেষ্টা করুন (তাফসিরের সহায়তা নিন)।
- শ্রবণ ও পুনরাবৃত্তি (Listen & Repeat): কারির তিলাওয়াত শুনুন এবং তার সাথে সাথে জোরে জোরে পুনরাবৃত্তি করুন। এই ধাপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- বিভাজন করে মুখস্থ (Chunking): বড় আয়াতকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করুন (যেমন: একটি আয়াতকে দু’ভাগে)। প্রথম অংশটি বারবার পড়ে মুখস্থ করুন। তারপর পরের অংশ। শেষে পুরো আয়াতটি একসাথে পড়ুন।
- লিখন (Writing): মুখস্থ করার সময় হাতে লিখে ফেলুন। এটি একটি শক্তিশালী স্মৃতি-সংবদ্ধকরণ কৌশল।
- পুনরাবৃত্তি ও একত্রীকরণ (Repetition & Consolidation): একটি আয়াত বা অংশ মুখস্থ হওয়ার পরপরই তা কমপক্ষে ১০-১৫ বার জোরে জোরে পড়ুন। তারপর আগের দিনের বা সপ্তাহের মুখস্থকৃত অংশের সাথে মিলিয়ে পড়ুন।
- অর্থের সাথে সংযোগ স্থাপন (Connecting with Meaning): যে অংশটি মুখস্থ করছেন, তার বাংলা অনুবাদ বা সংক্ষিপ্ত তাফসির জেনে নিন। অর্থ বুঝলে মুখস্থ করা সহজ হয় এবং তা হৃদয়ে গেঁথে যায়।
গ. পুনর্বীক্ষণ (Revision): সফলতার মূল চাবিকাঠি
- নিয়মিত পুনরাবৃত্তি: দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো পুনর্বীক্ষণ। প্রতিদিন নতুন অংশ মুখস্থ করার আগে অবশ্যই গতকালের মুখস্থকৃত অংশটি কমপক্ষে ৫ বার পড়ুন।
- সাপ্তাহিক ও মাসিক রিভিশন: সপ্তাহের শেষে পুরো সপ্তাহের মুখস্থকৃত অংশ একসাথে পড়ুন। মাস শেষে পুরো মাসের অংশ রিভিশন করুন।
- নামাজে ব্যবহার: ফরজ ও সুন্নত নামাজে নিজে যে সুরাগুলো মুখস্থ করেছেন, সেগুলো পড়ার চেষ্টা করুন। এটি সর্বোত্তম অনুশীলন।
৪. সহায়ক উপকরণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার
- মানসম্পন্ন মুসহাফ: স্পষ্ট অক্ষর, সঠিক রঙের চিহ্ন (যেমন: লাল, নীল, সবুজ) সম্বলিত একটি নির্ভরযোগ্য কোরআনের কপি ব্যবহার করুন।
- মোবাইল অ্যাপস: Memorize Quran for Kids & Adults, Quran Progress, Tarteel, Quranic (বাংলা ইন্টারফেস সহ) ইত্যাদি অ্যাপ মুখস্থ করতে, ট্র্যাক রাখতে ও শুনতে সাহায্য করে।
- ডিজিটাল টাফসির ও অডিও: Tanzil.net, Quran.com, বা Alim.org থেকে বাংলা অনুবাদ ও তাফসির পড়ুন। YouTube-এ বাংলায় কোরআন তিলাওয়াত ও তাফসিরের চ্যানেল (যেমন: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের অফিসিয়াল চ্যানেল) অনুসরণ করুন।
মুখস্থকরণে বাধা ও তার সমাধান: অধ্যবসায়ই সাফল্যের চাবি
দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতির পথে কিছু বাধা আসবেই। সেগুলোকে চিনে সঠিক সমাধান জানা থাকলেই জয় নিশ্চিত:
ক. ভুলে যাওয়া
- কারণ: স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মস্তিষ্ক সময়ের সাথে সাথে তথ্য মুছে ফেলে যদি তা বারবার পুনরাবৃত্তি না হয়।
- সমাধান: নিয়মিত রিভিশনই একমাত্র পথ। পেছনের সুরাগুলো বারবার পড়ুন। নামাজে ব্যবহার করুন। অডিও শুনুন।
খ. সময়ের অভাব
- কারণ: ব্যস্ত জীবনে সময় বের করা কঠিন মনে হতে পারে।
- সমাধান:
- দিনের “ডেড টাইম” ব্যবহার করুন (যেমন: যানজটে বসে, লাঞ্চ ব্রেকের কিছু সময়, রাতে ঘুমানোর আগে ১৫ মিনিট)।
- অগ্রাধিকার নির্ধারণ করুন। কোরআনের জন্য ছোট্ট একটি সময়কে অলঙ্ঘনীয় করুন।
- পরিবারের সদস্যদের সাথে শেয়ার করুন, যাতে এই সময়টুকু তারা সম্মান করে।
গ. মনোযোগের অভাব
- কারণ: বিভিন্ন চিন্তা, মোবাইল নোটিফিকেশন, পরিবেশের শব্দ মনোযোগ বিঘ্নিত করে।
- সমাধান:
- নিরিবিলি স্থান বেছে নিন।
- মোবাইল ফোন সাইলেন্ট বা এয়ারপ্লেন মোডে রাখুন।
- মুখস্থ করার আগে ২-৩ মিনিট চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে দুআ করুন, মন স্থির করুন।
- ছোট ছোট সেশনে ভাগ করুন (১৫ মিনিট পড়া, ৫ মিনিট বিরতি)।
ঘ. আত্মবিশ্বাসের অভাব
- কারণ: “আমি পারব না”, “বয়স হয়ে গেছে”, “স্মৃতিশক্তি ভালো না” – এমন নেতিবাচক চিন্তা।
- সমাধান:
- ছোট থেকে শুরু করুন। একটি ছোট সুরা দিয়ে বিজয়ী বোধ করুন।
- নিজের অগ্রগতি ট্র্যাক করুন। একটি ডায়েরি বা অ্যাপে লিখে রাখুন প্রতিদিন কী মুখস্থ করলেন।
- অন্যের সফলতার গল্প শুনুন (যেমন: বৃদ্ধ বয়সে কোরআন মুখস্থ করা ব্যক্তিদের কাহিনী)।
- আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। তিনি সাহায্য চাওয়া বান্দাকে সাহায্য করেন।
দৈনিক জীবনে মুখস্থকৃত সুরার প্রয়োগ: বাস্তব জীবনে কোরআনের আলো
দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতির প্রকৃত সার্থকতা তখনই, যখন মুখস্থকৃত আয়াতগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আচরণ, চিন্তা ও সিদ্ধান্তকে আলোকিত করে।
- কঠিন সময়ে সান্ত্বনা ও ধৈর্য: যখন কষ্ট বা দুঃখ আসে, সুরা আদ-দুহা বা আল-ইনশিরাহর আয়াতগুলো হৃদয়ে ভেসে উঠুক, আল্লাহর রহমত ও ভবিষ্যতের সুসংবাদ স্মরণ করিয়ে দিক।
- সিদ্ধান্ত গ্রহণে দিকনির্দেশনা: কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে “ইস্তেখারা”র দুআ পড়ার পাশাপাশি মুখস্থকৃত আয়াত যেমন, সুরা আল-ইমরানের ১৫৯ নং আয়াত (“…আর যখন তুমি কোনো কাজ করার সংকল্প কর, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর…”) হৃদয়ে জাগ্রত হোক।
- আত্মসংযম ও নৈতিকতা: ক্রোধের মুহূর্তে সুরা আল-ফুরকানের ৬৩ নং আয়াত (“রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে…”) স্মরণ করুন। লোভ বা অন্যায়ের প্রলোভনে সুরা আল-হাশরের ১৮-১৯ নং আয়াত (“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর…”) মনে করুন।
- কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে সুরা আর-রহমান বা সুরা আন-নাহলের আয়াতগুলো পড়ুন। মুখস্থ থাকলে যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ সম্ভব।
- দাওয়াত ও শিক্ষাদান: পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, বিশেষ করে সন্তানদের কাছে মুখস্থকৃত আয়াত সহজেই শোনাতে ও শিক্ষা দিতে পারবেন।
বাস্তব উদাহরণ: সিলেটের এক স্কুল শিক্ষিকা, আয়েশা বেগম। তিনি প্রতিদিন সকালে সুরা ইয়াসিন মুখস্থ করেন। তিনি বলেন, “এই সুরাটি মুখস্থ থাকার কারণে যখনই কোনো অসুস্থ আত্মীয়ের কাছে যাই, তাদের জন্য তা পড়তে পারি। তাদের চোখে যে শান্তি দেখি, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এটাই আমার দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”
বিশেষ পরিস্থিতি ও বয়সভিত্তিক টিপস
দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতি সব বয়সী, সব পেশার মানুষের জন্য প্রযোজ্য, শুধু পদ্ধতিতে সামান্য রদবদল লাগতে পারে:
- শিশু-কিশোরদের জন্য (৫-১৫ বছর):
- গল্পের ছলে শেখান (সুরা আল-ফীল, সুরা আল-কাওসার ইত্যাদির পটভূমি)।
- রঙিন চার্ট, ফ্লাশ কার্ড, গেমের মতো উপকরণ ব্যবহার করুন।
- ছোট ছোট সুরা দিয়ে শুরু করুন। প্রতিদিনের লক্ষ্য খুবই ছোট রাখুন (১-২ লাইন)।
- পুরস্কার ও উৎসাহের ব্যবস্থা করুন।
- তাদের সাথে একসাথে শুনুন ও পড়ুন।
- ব্যস্ত পেশাজীবী/গৃহিণীর জন্য:
- দিনের “অপচয় হওয়া সময়”কে কাজে লাগান (যাতায়াত, রান্নার ফাঁকে, শিশু ঘুমানোর পর)।
- অডিও শোনাকে অগ্রাধিকার দিন। হেডফোন ব্যবহার করুন।
- লম্বা সুরার বদলে ছোট ছোট সুরা বা বড় সুরার ছোট অংশ মুখস্থে মনোনিবেশ করুন।
- সাপ্তাহিক লক্ষ্য ঠিক করুন (যেমন: সপ্তাহে ১টি ছোট সুরা)।
- বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য:
- চাপ নেবেন না। ধীরে সুস্থে অগ্রসর হোন।
- দৃষ্টি সমস্যা থাকলে বড় অক্ষরের মুসহাফ বা ট্যাবলেট/মোবাইলে জুম করে পড়ুন।
- শোনার উপর বেশি জোর দিন। কারিদের তিলাওয়াত অনুসরণ করুন।
- নিয়মিত রিভিশন অপরিহার্য।
- হাফেজ হওয়ার লক্ষ্যে:
- দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতির সাথে একজন অভিজ্ঞ উস্তাদের (শাইখ/শাইখা) তত্ত্বাবধানে থাকা জরুরি।
- প্রতিদিনের পরিমাণ ও রিভিশনের পরিমাণ বাড়াতে হবে (উস্তাদের পরামর্শে)।
- সাপ্তাহিক/মাসিক টেস্ট বা শুনানির ব্যবস্থা করতে হবে।
- নিয়মিত পুরো পারা রিভিশন দিতে হবে।
অভিজ্ঞদের পরামর্শ: ঢাকার প্রখ্যাত ক্বারী ও হিফজ শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল কাদের বলেন, “দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতির সাফল্য নির্ভর করে তিনটি জিনিসের উপর: ইখলাস (আন্তরিকতা), ইস্তিকামাহ (ধারাবাহিকতা – প্রতিদিনই কিছু না কিছু করা), এবং ইসতিমরার (নিয়মিত রিভিশন)। যে ব্যক্তি এই তিনটি জিনিস ধরে রাখতে পারবে, ইন শা আল্লাহ, সে অবশ্যই সফল হবে।”
(Final Paragraph)
দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতি তাই শুধু কিছু আয়াত কণ্ঠস্থ করার কৌশল নয়; এটি আপনার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোরআনের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করার এবং এক আধ্যাত্মিক শান্তির সন্ধান পাওয়ার এক অনন্য যাত্রা। ফারহানা, রিয়াজ, আয়েশা কিংবা আপনার প্রতিবেশীরা এই পথের পথিক হয়েছেন। ভুলে যাওয়া, সময়াভাব, বা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি সাময়িক বাধা হতে পারে, কিন্তু ধৈর্য, নিয়মিত চর্চা এবং আল্লাহর উপর অগাধ ভরসাই আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ছোট্ট একটি সুরা দিয়ে শুরু করুন আজই। প্রতিদিনের সেই ১৫ মিনিটকে আপনার দিনের সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্তে পরিণত করুন। দেখবেন, অল্প দিনেই কোরআনের মধুর বাণী আপনার হৃদয়কে আলোকিত করবে, জীবনে নামাবে এক অনাবিল প্রশান্তি। এখনই সময় শুরু করার। আপনার কোরআনের সফর শুরু হোক আজ থেকেই।
জেনে রাখুন (FAQs)
দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর:
প্রশ্ন: প্রতিদিন কতটুকু সময় দিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে?
উত্তর: গুণগত মানের উপর ফোকাস করুন। শুরুতে ১৫-২০ মিনিট নিয়মিত দেওয়াই যথেষ্ট। গুরুত্বপূর্ণ হল প্রতিদিনের ধারাবাহিকতা। ধীরে ধীরে সময় বাড়ানো যায়। এই ২০ মিনিটে ভালোভাবে ৩-৫ লাইন বা একটি ছোট সুরার অংশ মুখস্থ ও রিভিশন করা সম্ভব। সময় কম হলেও নিয়মিত করাই মুখ্য।প্রশ্ন: আমি বয়স্ক, স্মৃতিশক্তি এখন তেমন ভালো না। তবুও কি মুখস্থ করা সম্ভব?
উত্তর: অবশ্যই সম্ভব! বয়স মুখস্থ করার ক্ষেত্রে বাধা নয়। বরং বয়সের সাথে ধৈর্য ও একাগ্রতা বাড়ে। দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতিয় বয়স্কদের জন্য টিপস হলো: ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিন, বারবার শুনুন (অডিওর সাহায্য নিন), প্রতিদিন রিভিশন করুন, নিজের উপর চাপ নেবেন না এবং মূলত তিলাওয়াতের সওয়াব ও অর্থ বুঝতে পারার দিকেই নজর দিন। ধীরে ধীরে অগ্রসর হলেও তা মহান আল্লাহর নিকট অতি মূল্যবান।প্রশ্ন: মুখস্থ করার সময় বারবার ভুলে যাই, হতাশ লাগে। কী করব?
উত্তর: ভুলে যাওয়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। এটি মুখস্থ করার প্রক্রিয়ারই অংশ। হতাশ হওয়া যাবে না। সমাধান হল নিয়মিত ও ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি (Revision)। যে অংশ ভুলে যাচ্ছেন, তাকে আরও বেশিবার পড়ুন। গতকালের মুখস্থকৃত অংশটি আজ নতুন মুখস্থ শুরুর আগে ৫-৭ বার পড়ুন। সপ্তাহের শেষে পুরো সপ্তাহের অংশ একসাথে পড়ুন। নামাজে ব্যবহার করুন। ধৈর্য ধরুন, ভুল কমতে থাকবে।প্রশ্ন: কোন সুরা দিয়ে শুরু করা সবচেয়ে ভালো?
উত্তর: সাধারণত শেষের দিকের ছোট ছোট সুরা (৩০তম পারা – সুরা আন-নাস থেকে সুরা আদ-দুহা পর্যন্ত) দিয়ে শুরু করা সহজ এবং অনুপ্রেরণাদায়ক। যেমন: সুরা আল-ইখলাস, সুরা আল-ফালাক, সুরা আন-নাস, সুরা আল-কাওসার, সুরা আল-আসর, সুরা আদ-দুহা, সুরা আল-শারহ ইত্যাদি। এগুলোর আয়াত কম, উচ্চারণ তুলনামূলক সহজ এবং অর্থ গভীর। সফলতা অনুভব করতে এগুলো দিয়ে শুরুই উত্তম।প্রশ্ন: শুধু অডিও শুনে বা পড়ে মুখস্থ করা যায় কি?
উত্তর: অডিও শোনা খুবই কার্যকর, বিশেষ করে সঠিক উচ্চারণ শেখা ও ধরে রাখার জন্য। তবে দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতির জন্য শুধু শোনাই যথেষ্ট নয়। আপনাকে সক্রিয়ভাবে কোরআন দেখে দেখে জোরে জোরে পড়তে হবে এবং বারবার পুনরাবৃত্তি করতে হবে। লিখে ফেলাও বেশ সাহায্য করে। অর্থাৎ শোনা, দেখে পড়া, জোরে পড়া এবং লেখা – এই কয়টি পদ্ধতি একসাথে ব্যবহার করলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।- প্রশ্ন: মুখস্থ করার জন্য কি একজন উস্তাদের (শিক্ষক) প্রয়োজন?
উত্তর: শুরুতে সঠিক উচ্চারণ (তাজবিদ) শেখার জন্য একজন যোগ্য উস্তাদের সাহায্য নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভুল উচ্চারণে মুখস্থ করা থেকে বিরত থাকুন। একবার মৌলিক তাজবিদ ও উচ্চারণ রপ্ত করে গেলে, নিয়মিত চর্চা ও রিভিশনের জন্য আপনি নিজেও দৈনিক সুরা মুখস্থ করার পদ্ধতি চালিয়ে যেতে পারেন। তবে হাফেজ হওয়ার লক্ষ্য থাকলে নিয়মিত উস্তাদের কাছে শুনানো বাধ্যতামূলক।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।