জুমবাংলা ডেস্ক : দেশের অন্য প্রান্তে যখন চা শ্রমিক ন্যায্য মজুরির দাবিতে আন্দোলনে, ঠিক সেই সময়ে উল্টো চিত্র সমতলের চা শিল্প পঞ্চগড়ে। এখানকার শ্রমিকরা স্বাধীনভাবে চুক্তিভিক্তিক কাজ করে থাকেন। এরা চা পাতা সংগ্রহের কাজের পাশাপাশি অন্য কাজও করেন। প্রতি কেজি তিন টাকা মজুরিতে বাগান মালিকদের ডাকে পাতা সংগ্রহ করে দেন এই শ্রমিকরা।
বেশিরভাগ শ্রমিক কাজ করে থাকেন রাত ৩টা থেকে। আবার কেউ ভোর থেকে পাতা সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। পাতা তোলা শেষ হয়ে যায় সকাল ৯ টার মধ্যেই।
তবে এরা চট্টগ্রাম বা সিলেটের মতো হাত দিয়ে পাতা তোলেন না। এই শ্রমিকরা ধারাল চাকু বা কাঁচি দিয়ে কেটে পাতা সংগ্রহ করেন। মাত্র পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা কাজ করেই তারা দৈনিক ৫০০ থেকে হাজার টাকা রোজগার করেন। বাড়ি ফিরে কেউ করেন বাড়ির কাজ আবার কেউ দিনমজুরের কাজ করে আরও কিছু রোজগার করেন। চা পাতা কাটার কাজ করে পঞ্চগড়ের অধিকাংশ শ্রমিকের সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা।
রাত গভীর হলেই মাথায় টর্চ লাইট নিয়ে দলবেঁধে নেমে পড়েন চা পাতা সংগ্রহ করতে। হঠাৎ কেউ দেখলে ভয়ে পেয়ে যেতে পারেন। এরা পঞ্চগড় সমতলের রাতের চা শ্রমিক। আগে দিনের বেলাতে চা পাতা কাটলেও এখন তারা রাতের শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে পাতা সংগ্রহ করছেন। এতে তাদের ভোগান্তি কমার পাশাপাশি দ্বিগুণ রোজগার হচ্ছে। মাত্র ৫/৬ ঘণ্টা কাজ করেই আয় হচ্ছে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। আবার দিনের বাকিটা সময় করছেন আলাদা কাজও।
প্রান্তিক জেলা পঞ্চগড়ের সমতলে গড়ে উঠেছে প্রায় আট হাজার ছোট বড় চা বাগান। বেশিরভাগ বাগান ক্ষুদ্রায়তনের। কৃষি ফসলের মতো কেউ এক বিঘা, কেউ এক একর আবার কেউ ১০ একর জমিতে চা বাগান করেছেন। এসব বাগানে শ্রমিকরা চুক্তিভিত্তিক কাজ করে থাকেন। পাতা বড় হলেই খবর দেয়া হয় শ্রমিক দলকে। তিন টাকা কেজি দরে পাতা কেটে দেন তারা। এ জেলার শ্রমিকদের একটা বড় অংশ পাতা কাটার কাজ করে থাকেন রাতের আঁধারেই। তাদের উপার্জনও হয় দ্বিগুণ। দিনের বাকি সময়টুকুও অন্য কাজ বা বাড়ির কাজে ব্যয় করেন তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঘড়ির কাঁটায় রাত তিনটে বাজার সাথে সাথে সরব হয়ে উঠে পঞ্চগড়ে চা বাগানগুলো। পঞ্চগড় সদর উপজেলার তালমা এলাকায় মাথায় টর্চ লাইট আর হাতে ধারালো চাকু নিয়ে চা শ্রমিকরা ছুটছে চায়ের পাতা সংগ্রহ করতে। নদীর পাড় ঘেঁষেই চা বাগান। বাগানজুড়ে জ্বলছে জোনাকির মতো লাইট। দূর থেকে হঠাৎ কেউ দেখলে ভয় পেয়ে যেতে পারেন। গল্প গুজব, গানের মাধ্যমে চলছে পাতা কাটার কাজ। দলটিতে ২০ থেকে ২২ জন সদস্য রয়েছেন। চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে কেউ বাইসাইকেলে আবার কেউ মোটরসাইকেলে করে পাতা কাটতে এসেছেন। মাথায় টর্চ লাইট বেঁধে বিরামহীনভাবে চলছে পাতা কাটার কাজ। পাতা কেটে নিজের বস্তায় ভরে রাখছেন সবাই। যে যতটুকু পাতা সংগ্রহ করতে পারবে ওজন মেপে তেমনি দাম পাবে। অল্প সময়ের মধ্যেই এক একর জমির পাতা কাটা শেষ হয়ে গেলো।
শ্রমিকরা জানান, এক সময়ে দিনের বেলাতে সূর্যের কড়া তাপ সয়েই তারা চা পাতা কাটার কাজ করতেন। এতে যেমন ভোগান্তি পোহাতে হতো তাদের তেমনি শুকিয়ে যেতো পাতা। অনেক পাতা পড়ে যেতো মাটিতে। কারখানা মালিকরাও নিতে চাইতেন না শুকনো পাতা। গত কয়েক বছর ধরে শ্রমিকরা মধ্য রাত থেকে পাতা কাটার কাজ শুরু করে। রাতের নীরব শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে খুব সহজেই চা পাতা কাটতে পারেন তারা। সকাল ৯টার আগেই তাদের পাতা সংগ্রহের কাজ শেষ হয়। এতে রোদের তাপ থেকে যেমন তারা রক্ষা পাচ্ছেন তেমনি কারখানায় সতেজ পাতা সরবরাহ করতে পারছেন তারা।
একজন রাতের শ্রমিক প্রতিদিন পাতা কাটতে পারেন দুশ থেকে সাড়ে তিনশ কেজি। সেই হিসেবে তাদের দৈনিক আয় হয় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। চা বাগানে সাপ, শেয়াল ও পোকামাকড় থাকলেও লাইটের আলোতে সব সরে যায় বলে জানান শ্রমিকরা। এদিকে, রাতের বেলা চা পাতা কাটার কাজ করে দিনের বেলা পরিবার কিংবা অন্য কাজ করতে পারেন এই শ্রমিকরা। দ্বৈত আয়ে সুন্দরভাবে চলছে তাদের সংসার। অর্থকষ্টে থাকা এই শ্রমিকদের পরিবারে এখন স্বচ্ছলতা এসেছে। দিন দিন রাতের চা শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে।
এদিকে নারী শ্রমিকসহ অন্যরা পাতা কাটার কাজ শুরু করেন ভোর থেকে। তারাও কাজ করেন সকাল ৯টা পর্যন্ত। এতে দৈনিক কখনো তিনশ আবার কখনো পাঁচশ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। তিন টাকা কেজি চুক্তি ভিত্তিক হওয়ায় যে যতো বেশি পাতা কাটতে পারেন তিনি ততো বেশি মজুরি পান। এক সময়ে ঘরে বসে থাকা নারীরা এখন পঞ্চগড়ের চা বাগানে পাতা কাটার কাজ করে সংসারে হাল ধরেছেন। ভোর থেকে ৫/৬ ঘণ্টা কাজ করে বাকিটা সময় সংসারের কাজে লাগান তারা।
রাতের চা শ্রমিক আব্দুল হাই বলেন, দিনে সূর্যের কড়া তাপে বেশিক্ষণ কাজ করতে পারতাম না। আবার পাতাও শুকিয়ে যেতো। অনেক পাতা নিচে পড়ে যেতো। রাতে ঠান্ডা পরিবেশে পাতা কাটতে ভালো লাগে। আরামে পাতা তোলা যায়। আর সকালে সূর্যের তাপ বাড়ার আগেই আমরা কাজ শেষ করে বাড়িতে চলে যাই। দিনের বাকিটা সময় আর অন্য কাজ করে বাড়তি আয় করি। কাজ না থাকলে পরিবারে সময় দেই।
শ্রমিক দলনেতা বাবুল হোসেন বলেন, আমরা লাইট জ্বালিয়ে বাগানে ঢুকার সাথে সাথে সাপ পোকামাকড় সব দূরে সরে যায়। আমরা সুন্দরভাবে পাতা কাটতে পারি। তিন টাকা কেজি দরে আমরা চুক্তিতে মানুষের বাগানের পাতা কেটে দেই। রাত ৩টা থেকে সকাল ৯টার মধ্যেই পাতা ওজন করে গাড়িতে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরি। দৈনিক গড়ে আমরা তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ কেজি কাটতে পারি। এতে আমাদের সংসার সুন্দরভাবে চলে যায়।
জয়ফুল বেগম নামের এক নারী শ্রমিক বলেন, আগে আমরা বেকার বসে ছিলাম। আমাদের এলাকায় চা বাগান হওয়ার পর থেকে আমরা বাগানে পাতা কাটার কাজ করি। আমরা ফজরের নামাজের পর থেকে ৯টা পর্যন্ত পাতা কাটি। এতে আমাদের দৈনিক তিনশ থেকে পাঁচশ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। দিনের বাকিটা সময় সংসারের কাজ করি। ছেলেমেয়েদের সময় দেই। এভাবে আমরা সংসারের হাল ধরেছি।
বাগান মালিক সায়েদ আলী বলেন, রাত থেকে সকাল পর্যন্ত পাতা তুললে পাতাগুলো সতেজ থাকে। দিনে পাতা তুললে তা শুকিয়ে যায়। তাই রাতে পাতা তুললে শ্রমিকরাও যেমন আরামে পাতা তুলতে পারে আমরাও সতেজ পাতা কারখানাতে দিতে পারি।
পঞ্চগড় চা বোর্ডের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, সমতলের চা শিল্পে পঞ্চগড়ের আর্থ সামাজিক পরিবর্তন আসার পাশাপাশি প্রায় ২০ হাজার শ্রমিকের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। এখন শ্রমিকরা রাতেই পাতা তুলছেন। দিনের বাকিটা সময় তারা অন্য কাজ করে বাড়তি আয় করছেন। এভাবে দ্বৈত আয়ে তাদের সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে।
বছরে প্রুনিংয়ের দুই মাস বাদে বাকি ১০ মাসই পাতা তোলার কাজ করেন এই শ্রমিকরা। পঞ্চগড়ের সমতলে প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে প্রায় আট হাজার ক্ষুদ্র চা বাগান গড়ে উঠেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।