আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সোমবার গভীর রাতের ঘটনা। লাদাখের সুউচ্চ পর্বতমালায় গালওয়ান নদীর পূর্ব পাড় ধরে পেট্রোলিংয়ে বেরিয়েছিল ভারতীয় সেনার বিহার রেজিমেন্টের একটি পেট্রোলপার্টি। তাদের সঙ্গেই চীনের সেনাদের সংঘর্ষ হয়। গত প্রায় এক মাস ধরে এই অঞ্চলটি নিয়ে বিতর্ক চলছে ভারত এবং চীনের।
ভারতের অভিযোগ, লাইন অফ কন্ট্রোল উপেক্ষা করে ভারতে ঢুকে পড়েছে চীনের সেনা। চীনের পাল্টা অভিযোগও একই রকম। বিষয়টি নিয়ে সীমান্তে ভারত এবং চীনের সেনা একাধিকবার হাতাহাতিতে জড়িয়েছে। দুই পক্ষই সেনা এবং অস্ত্র মজুত করেছিল সীমান্তের খুব কাছে। তারই জেরে গত সপ্তাহে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকও হয় সীমান্তে। কিন্তু সোমবার রাতের ঘটনা সেই পুরো প্রক্রিয়াটাতেই জল ঢেলে দিয়েছে।
ভারতীয় সেনার এক আহত জওয়ান জানান, মাঝ রাতে পেট্রোলিংয়ের সময় বিহার রেজিমেন্ট দেখতে পায় গালওয়ান নদীর পশ্চিম প্রান্তে লাইন অফ কন্ট্রোল পার করে পেট্রোল পয়েন্ট ১৪তে টেন্ট তৈরি করেছে চীনের পিপলস আর্মি। সামান্য হাতাহাতি শুরু হতেই চীনের সেনা রডে কাঁটাতার জড়িয়ে আক্রমণ করে। পাল্টা আঘাত করে ভারতীয় সেনারাও। ওই উচ্চতায় গভীর রাতে ঠান্ডার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াই কঠিন। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নীচে। সঙ্গে অক্সিজেনের সমস্যা। তার মধ্যে দুই পক্ষের সংঘর্ষ চরমে পৌঁছায়। আহত সেনা জওয়ানরা নদীতে পড়ে যায়। পরে মঙ্গলবার সকালে মৃতদেহ নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
ভারতের দাবি, ওই এলাকাটি ভারতের। ফলে পেট্রোলপার্টি দ্রুত সেখানে পৌঁছায় এবং তর্ক শুরু হয়। প্রায় আট ঘণ্টা ধরে দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই চলতে থাকে। দুই পক্ষের সেনাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ভারতের অভিযোগ, চীন বেশ কিছু ভারতীয় সেনাকে আটক করে নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁদের উপর অত্যাচার চালানো হয়। পরে মঙ্গলবার সকালে দুই পক্ষ বৈঠকে বসলে তাঁদের ছাড়া হয়।
তবে মঙ্গলবার দুপুরে প্রথম সংঘাতের কথা স্বীকার করে বিবৃতি প্রকাশ করেছিল ভারতীয় সেনা। মঙ্গলবার গভীর রাতে ফের তারা বিবৃতি প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে একজন অফিসার। আহত আরও অনেক।
ডয়চে ভেলেকে ভারতীয় সেনা সূত্র জানিয়েছে, আজ (১৭ জুন) সকালে নিহতের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় ১১০ জন গুরুতর আহত। ফলে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
চীনের সেনা বাহিনীর তরফ থেকে অবশ্য এখনও কোনও বিবৃতি প্রকাশ করা হয়নি। সরকারিভাবে ক্ষয়ক্ষতির কথাও জানানো হয়নি। তবে চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সে দেশেও বেশ কিছু সেনার মৃত্যু হয়েছে। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআইয়ের দাবি, ভারতীয়র সেনা চীনের রেডিও ইন্টারসেপ্ট করে জানতে পেরেছে অন্তত ৪৩ জন চীনের সেনা নিহত হয়েছেন।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র লাদাখে ভারত এবং চীনের সংঘাত যে আবারও তীব্র হবে, বিশেষজ্ঞদের অনেকেই তা মনে করছেন। বস্তুত, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বৈঠক করেন দেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীর প্রতিটি উইংয়ের কমান্ডারদের সঙ্গে। পরে গভীর রাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বৈঠকে বসেন নরেন্দ্র মোদী, রাজনাথ সিংহ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। এর আগে তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। এ ছাড়াও ওই বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর যোগ দিয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছে। যদিও বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, সে বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি।
তবে ভারতের বিরোধী দল এর মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে সরকারের বিবৃতি দাবি করেছে। লাদাখে ঠিক কী ঘটেছে তা জানতে চেয়ে রাতেই টুইট করেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী।
মঙ্গলবার রাতে সেনা বাহিনীর তরফ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তাতে স্পষ্টভাবেই চীনের দিকে আঙুল তোলা হয়েছে। ভারতীয় সেনার অভিযোগ, চীন সীমান্তে উত্তেজনা জারি রেখেছে। উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সোমবার রাতের ঘটনা ফের নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি করেছে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছে, ভারতীয় সেনা সীমান্ত পার করেছিল বলেই এই ঘটনা ঘটেছে। তাদের দাবি, সাদা পতাকা ছাড়াই প্রোটোকল উপেক্ষা করে সীমান্ত পার করে চীনের টেন্টের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল ভারতীয় সেনার পেট্রোলবাহিনী। তারপরেই দুই পক্ষ হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। ফলে এর দায় ভারতকেই নিতে হবে।
এদিকে গোটা ঘটনার দিকে কড়া নজর রেখেছে বিশ্ব রাজনীতি। আমেরিকা জানিয়েছে, বিষয়টির দিকে তারা নজর রাখছে। মঙ্গলবার যা ঘটেছে তা অভিপ্রেত। অন্য দিকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলও দুই পক্ষকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের পরে ১৯৬৭ সালে সিকিমে নাথুলার কাছে ফের দুই পক্ষ তীব্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। তাতে দুই পক্ষের বহু সেনার মৃত্যু হয়। ১৯৭৫ সালে অরুণাচলে ফের দুই পক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে অরুণাচল সীমান্তে। সেই ঘটনাতেও দুই পক্ষের বেশ কিছু সৈন্য নিহত হন। এরপর ২০১৭ সালে ডোকালমে ভারতীয় এবং চীনা সেনা হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। পাথর বৃষ্টিও হয়। কিন্তু কারও মৃত্যু হয়নি। এ বছরেও সিকিম এবং লাদাখে দুই পক্ষ একাধিকবার হাতাহাতিতে জড়িয়েছে। তবে সোমবার রাতের ঘটনা নজিরবিহীন বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল। এখনই এর উত্তাপ কমবে বলেও তাঁরা মনে করছেন না। সূত্র: ডিডব্লিউ, ডয়চে ভেলে, এএনআই, পিটিআই
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।