ধর্ম ডেস্ক : শেষ নবী মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সা. পৃথিবীর জন্য রহমত হিসেবে এসেছেন। আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেন, আমি তো তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি। (সুরা আল আম্বিয়া ১০৭)
সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের মাস রবিউল আউয়াল। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এই মাসে তিনি পৃথিবীতে আগমন করেন। তার জন্মের সময় পৃথিবীতে অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। এ ঘটনাগুলোই শ্রেষ্ঠ নবীর আগমনকে মানুষের সামনে স্পষ্ট করে তোলে। এমনই কিছু ঘটনা আজ আলোচনা করবো।
এক. বিশ্ব নবী সা.-এর জন্মের কিছুদিন আগে আবরাহার হস্তী বাহিনীর বিনাশ ঘটে। আসহাবে ফিল অর্থাৎ আবরাহার হস্তী বাহিনী আল্লাহর ঘর কাবা শরিফের ওপর আক্রমণ করেছিল। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আবাবিল নামক কিছু ক্ষুদ্র পাখির মাধ্যমে কঠিন শাস্তি দেন। মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন। এ ঘটনাটি বিশ্ব নবীর জন্মের বরকতের সূচনা ছিল বলে সিরাতের কিতাবগুলোতে উল্লেখ রয়েছে।
দুই. হযরত উসমান ইবনে আবুল আস রা.-এর মা হযরত ফাতেমা বিনতে আবদুল্লাহ রা. বলেন, রসুল সা.-এর জন্মের মুহূর্তে আমি মা আমিনার কাছে ছিলাম। আমি দেখলাম, বিবি আমিনার ঘরটি আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। আকাশের সব তারকা নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ল। আমার মনে হতে লাগল, তারকাগুলো যেন আমার ওপর এসে পড়বে। (ফাতহুল বারি ৬/৭২৬)
তারকারাজির নিম্নমুখী হয়ে ঝুঁকে পড়ার দ্বারা এই ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে যে, অচিরেই পৃথিবী থেকে কুফর ও শিরকের অমানিশা দূর হবে। হেদায়েতের উজ্জ্বল আলোকে এ পৃথিবী আলোকিত হয়ে উঠবে।
পবিত্র কোরআনে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় তোমাদের কাছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এসেছে (হেদায়েত) আলো ও সুস্পষ্ট কিতাব। যারা তার সন্তুষ্টি কামনা করে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এই হেদায়েতের আলোকবর্তিকা ও কিতাবের সাহায্যে শান্তির পথে পরিচালনা করেন এবং তারই অনুমতিক্রমে কুফর, শিরকের অন্ধকার থেকে তাদেরকে হেদায়েতের পথে নিয়ে আসেন। (সুরা মায়েদা ১৫-১৬)
তিন. হযরত ইরবাজ ইবনে সারিয়া রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুল সা.-এর সম্মানিত মা রসুল সা.-এর শুভজন্মক্ষণে এক নূর দেখেন, যার মাধ্যমে সিরিয়া এলাকার প্রাসাদগুলো উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। (মাজমাউ যাওয়ায়েদ ৮/২২২)
চার. মহানবীর জন্মক্ষণে একদিকে পৃথিবীর মূর্তিশালায় নবুয়তের সূর্যোদয়, অপরদিকে পারস্য সম্রাট কিসরার রাজপ্রাসাদে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
এই ভূমিকম্পের দরুন রাজপ্রাসাদের ১৪টি গম্বুজ ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। পারস্যের এক অগ্নিকুণ্ড, যা এক হাজার বছরব্যাপী বিরতিহীনভাবে জ্বলছিল তা সেই শুভ মুহূর্তে হঠাৎ নিভে যায়। সাওয়াহ নামক এক নদীতে যথারীতি পানি প্রবাহিত হচ্ছিল, নবীর আগমন মুহূর্তে হঠাৎ তার অথৈ জলরাশি শুকিয়ে যায় (সিরাতে মুস্তফা: ১/৬৯) প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল অগ্নিপূজাসহ সব ভ্রান্তির অবসানের ইঙ্গিত।
পাঁচ. সহিহ হাদিসে বর্ণিত, জন্মের সময় বিশ্ব নবীর মায়ের পেট থেকে এমন একটি নূরের বিচ্ছুরণ ঘটেছিল, যার আলোকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত সবকিছু আলোকিত হয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, বিশ্ব নবী সা. যখন ভূমিতে আবির্ভূত হলেন তখন উভয় হাতের ওপর ভর দিয়ে ছিলেন। অতঃপর এক মুষ্টি মাটি নিয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। (মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া)
ছয়. হযরত ইবনে সুফিয়ান বর্ণনা করেছেন, আয়শা রা. বলেন, বিশ্ব নবী সা.-এর জন্মগ্রহণের সময় এক ইহুদি ব্যবসার উদ্দেশ্যে মক্কা নগরীতে বসবাস করত। যে রাতে নবী পৃথিবীতে আগমন করেন, সে রাত-পরবর্তী সকালে সে কুরাইশদের কাছে জিজ্ঞেস করল, গত রাতে এ এলাকাতে কোনো শিশুর জন্ম হয়েছে কি? উপস্থিত কুরাইশের লোকেরা বলল, এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না।
লোকটি বলল, তোমরা এ বিষয়টির অনুসন্ধান করো। কেননা এই রাতে বর্তমান উম্মতের নবী ভূমিষ্ঠ হয়েছেন। তার কাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বিশেষ নিদর্শন (অর্থাৎ মোহরে নবুয়ত) রয়েছে। জন্মের পরপর শিশুটির মুখে জিন আঙুল পুরে রাখার দরুন শিশুটি দু-দিন ধরে কারও দুধ পান করবে না। কুরাইশের লোকেরা সন্ধান করে জানতে পারল, আবদুল মুত্তালিবের প্রিয় পুত্র আব্দুল্লাহর এক পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। ইহুদিকে এ সংবাদ জানানো হলে সেও শিশুটিকে দেখার আগ্রহ ব্যক্ত করে বলল, চলো। আমিও শিশুটিকে দেখব।
ইহুদি লোকটি যখন শিশুটিকে দেখল, তার দুই কাঁধের মাঝে মোহরে নবুয়তের নিদর্শনও দেখতে পেল, তখন সে চিৎকার দিয়ে বেঁহুশ হয়ে গেল। হুঁশ ফিরে আসার পর লোকটি বলল, ‘নবুয়তে বনি ইসরাইল আজ থেকে শেষ হয়ে গেল। হে কুরাইশ সম্প্রদায়! ভবিষ্যতে এই শিশু তোমাদের প্রতি এমন এক আক্রমণ পরিচালনা করবে, যার সংবাদ পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। (ফাতহুল বারী ৬/৪২৫)
সাত. নবীজির জন্মের আগে বেশ কয়েক বছর আরবে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। তাঁর জন্মের বছর আরবের সেই দুর্ভিক্ষ কেটে যায়। আরবের ঘরে ঘরে আনন্দের ফল্গুধারা বইতে থাকে। যেহেতু একই বছরে কুরাইশরা আবরাহার বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল এবং দুর্ভিক্ষ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল, তাই বছরটিকে আরবরা ‘সানাতুল ফাতহ ওয়াল ইবতিহাজ’ বা ‘বিজয় ও আনন্দের বছর’ নাম দিয়েছিল। (আস-সিরাতুল হালাবিয়া ১/৭৮)
আট. অন্য বর্ণনায় এসেছে, হযরত আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সা. বলেন, আমি তোমাদের আমার প্রাথমিক বিষয় সম্পর্কে বলছি। আমি হলাম ইবরাহিম আ.-এর দোয়া ও ঈসা আ.-এর সুসংবাদ। আমার মায়ের স্বপ্ন, যা তিনি আমাকে প্রসব করার সময় দেখেছিলেন, তা হলো, এমন এক নূর উদ্ভাসিত হয়েছে, যার মাধ্যমে আমার আম্মাজানের জন্য সিরিয়ার প্রাসাদও উজ্জ্বল হয়েছিল। (দালায়েলুন নবুওয়াত লিল-বায়হাকি: পৃ.৩৫)
নয়. প্রিয় নবী সা.-এর আম্মাজান যখন তাকে গর্ভে ধারণ করলেন তখন অগণিত আশ্চর্য ঘটনা প্রকাশ পেয়েছিল। এমনকি ৯ মাস পূর্ণ গর্ভকালীন তিনি কোনো কষ্ট অনুভব করেননি।
মাতৃগর্ভে থাকাকালে মা আমিনা অনেক শুভ স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নযোগে তাকে নবীপাক সা.-এর পবিত্র নাম মুবারক বলে দেওয়া হয়। এমনকি এও বলা হয় যে হে আমিনা, তোমার গর্ভে আমানত আছেন দুই জাহানের সর্দার ও সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
দশ. প্রিয় নবী সা.-এর পূর্বপুরুষরা আপন সময়ের অত্যন্ত সৌভাগ্যবান, বিজ্ঞ ও সম্ভ্রান্ত ছিলেন। প্রিয় নবীজি সা.-এর দাদা, আব্দুল মুত্তালিবের অসিলা নিয়ে আরবের লোকেরা আল্লাহর কাছে দোয়াও করত।
ইমাম শিহাব উদ্দিন কাস্তালানি রহ. বলেন, কুরাইশ গোত্রে যখন দুর্ভিক্ষ নেমে আসত তারা আবদুল মুত্তালিবের হাত ধরে ছবির পাহাড়ে নিয়ে যেত। তার উসিলা নিয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করত ও বৃষ্টির জন্য দোয়া করত। (আল মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ১/৮৮)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।