দেশে কয়েক দিন ধরেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত করার জন্য নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সংখ্যা বেড়ে গেছে দ্রুতগতিতে। গতকাল শুক্রবার সকাল পর্যন্ত সারা দেশে মোট সাত হাজার ৩৫৯টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এসব নমুনা পরীক্ষায় ৯৪.২৪ শতাংশ বা ছয় হাজার ৯৩৫টি নমুনার ফলাফল নেগেটিভ বা করোনাভাইরাসমুক্ত বলে চিহ্নিত হয়েছে। বাকি মাত্র ৫.৭৬ শতাংশ বা ৪২৪টি নমুনার ফল পজিটিভ বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছে।
এমন পরিসংখ্যান দেখে অনেকের মধ্যেই নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে—আক্রান্ত যদি এত কমই হয়ে থাকে তবে মানুষ এত আতঙ্কিত কেন হচ্ছে? সেই সঙ্গে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কারো কারো মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে—নমুনা সংগ্রহ বা পরীক্ষা উপযুক্ত সব প্রটোকল মেনে ঠিকঠাক হচ্ছে কি না? পাশাপাশি আরেকটি প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে যে, যদি ৯৪ শতাংশের মধ্যে করোনার উপস্থিতি না থাকে, তবে যে উপসর্গের কারণে তাদের পরীক্ষা করতে হয়েছে সেই উপসর্গ কী কারণে হয়েছে। তারা তবে কোন রোগে আক্রান্ত?
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশে পজিটিভ হওয়ার হার ০.৭৫ শতাংশ বেশি। সব শেষ হিসাব অনুসারে ভারতে গত ২১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ৯১৯টি। এর মধ্যে পজিটিভ হয়েছে মাত্র ৬৪১২টি বা ৫.০১ শতাংশ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজির অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েক দিন পর্যন্ত আমি পরীক্ষা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি, কেমন যেন কিছুটা গোলমেলে মনে হচ্ছে। কয়েক দিন বাড়ল কিন্তু গতকাল হঠাৎ করে আবার কমে গেল কেন? আবার ঢাকায় পরীক্ষা হচ্ছে কিন্তু ঢাকার বাইরে কম হচ্ছে কেন সেটাও আরো কয়েক দিন দেখার পরে বোঝা যাবে।’ তিনি বলেন, ‘নমুনা সংগ্রহপ্রক্রিয়া সঠিক হয় কি না—সেটা আরো ভালো করে মনিটরিং দরকার।’
জানতে চাইল রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘পরীক্ষার ক্ষেত্রে সব শতকরা হার এক রকম না। জাতীয়ভাবে যে হার দেখা যাচ্ছে সেটা সেন্টারভিত্তিক কম-বেশি হয়। যেমন আজ (গতকাল) আইইডিসিআরে ১৯৬টি পরীক্ষা করে তার মধ্যে পজিটিভ এসেছে ৫৩ জনের (২৭ শতাংশ)। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কিংবা আইসিডিডিআরবিতেও পজিটিভের হার বেশি। ঢাকার বাইরে তুলনামূলক নেগেটিভ বেশি।’
নমুনা সংগ্রহ ঠিকভাবে হচ্ছে কি না—জানতে চাইলে ড. ফ্লোরা বলেন, ‘ঢাকায় যেসব প্রতিষ্ঠানে হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে যদি কখনো নমুনা সঠিকভাবে না পাওয়া যায় তখন আমরা দ্রুত আবার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করছি। এ ছাড়া এখানে যাঁরা নমুনা সংগ্রহ করছেন তাঁদের সবাই ভালোভাবেই প্রশিক্ষিত। ঢাকার বাইরে যাঁরা কাজ শুরু করেছেন তাঁদেরকেও অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সিভিল সার্জনদের বিষয়টি মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আশা করি তাঁরা বিষয়টি দেখছেন।’
অন্যদিকে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘রোগতত্ত্বের কিছু প্রটোকল আছে, যা সাধারণ মানুষ বা অন্য বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা না বুঝে কিছু কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য এখানে সেখানে বলছেন। সে কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের বাড়তি আতঙ্ক তৈরি হতেই পারে।’ তিনি বলেন, অনেকেই যেমন কিছুদিন ধরে বলতে শুরু করেছেন সবার ঢালাও পরীক্ষার জন্য। এতে প্রশাসনের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়, সেখান থেকে তখন ঢালাওভাবে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এমনটা হলে তো স্বাভাবিকভাবেই নেগেটিভ ফল বেশি হবে। ডা. মুশতাক মনে করেন, সবচেয়ে ভালো হয় ক্লাস্টার বা হটস্পট খুঁজে বের করে সে অনুসারে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা।
ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘গণপরীক্ষায় সব সময়ই ফলস বা নেগেটিভ রেজাল্ট বেশি আসবে। আবার জনবল, সময়, অর্থসহ সব ধরনের সম্পদেরও অপচয় বেশি হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরেক বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা বলেন, ‘শুরু থেকেই একটি মহল পরীক্ষাটি প্রাইভেট সেক্টরে নিয়ে যাওয়ার জন্য নানা কৌশলে বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি ও ক্ষেত্রবিশেষে পরোক্ষ চাপ প্রয়োগেরও চেষ্টা চালাতে থাকে। যার পেছনে বাণিজ্যই মূল লক্ষ্য। বিশেষ করে করোনাভাইরাস পরীক্ষাটি এখন সরকার ফ্রি করছে। যাতে মানুষের উপকার হচ্ছে। কিন্তু কোনো মতে যদি এটা প্রাইভেট সেক্টরের হাতে চলে যায়, তবে প্রতিটি পরীক্ষা পাঁচ-ছয় হাজার টাকা লেগে যাবে।’ তিনি মনে করেন, সারা দেশে যদি করোনা পরীক্ষা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেনতেনভাবে শুরু হয়ে যায়, তবে মানুষ ডেঙ্গু পরীক্ষার মতো সামান্য উপসর্গ হলেই ছুটবে পরীক্ষার জন্য; খরচ জোগাতে অনেকেই হয়রানির শিকার হবে নানাভাবে।
তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসিক সায়েন্স বিভাগের সাবেক এক গবেষক বলেন, মানুষ আতঙ্কিত বেশি হলে পরীক্ষা তো বেশি হবেই, আবার পরীক্ষা বেশি হলে ফলস রেজাল্ট বেশি হবে। কিন্তু এখন একটা বিষয় দেখা জরুরি, যেভাবে বা যাঁরা নমুনা সংগ্রহ করছেন তাঁরা কতটা দক্ষ বা প্রটোকলগুলো ঠিকঠাক মানছেন কি না। আবার পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রটোকল মেনে সব কিছু হচ্ছে কি না, যাঁরা এই কাজগুলো করছেন তাঁদের প্রশিক্ষণ ঠিকমতো দেওয়া হয়েছে কি না সেগুলো নিয়ে ভাবা দরকার খুবই গুরুত্বের সঙ্গে। তা না হলে নমুনা থেকে সঠিক ফলাফল না-ও আসতে পারে।
মৃত্যুহার নিয়েও অনেকের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা জানান, গতকালের হিসাব অনুসারে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুহার ৬.৩৬ শতাংশ। কোনো কোনো দেশের তুলনায় বেশি হলেও বৈশ্বিক হারের তুলনায় কম। এ ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে বেশি কেন—সেই প্রশ্নটি তুলছেন অনেকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশ নিয়ে গঠিত আঞ্চলিক পরিচালনা কাঠামোর আওতায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক থেকে কোন পর্যায়ে রয়েছে তা নিয়ে জানতে চান অনেকেই। গতকাল পর্যন্ত হিসাব অনুসারে দেখা যায়, ভারতে সর্বোচ্চ ৬৪১২ জন আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ১৯৯ জন। ইন্দোনেশিয়ায় সর্বোচ্চ ৩০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে ৩৫১২ জন। যা ভারতের তুলনায় কম। এরপর থাইল্যান্ডে ২৪৭৩ জন আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে ৩৩ জন। বাংলাদেশে আক্রান্ত হয়েছে ৪২৪ জন, মারা গেছে ২৭ জন, শ্রীলংকায় আক্রান্ত ১৯০ জন এবং মারা গেছে সাতজন, মিয়ানমারে আক্রান্ত ২৭ জন, মারা গেছে তিনজন, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান ও ইস্ট তিমুরে কেউ মারা যায়নি, আর আক্রান্তও অনেক কম; যথাক্রমে ১৯, ৯, ৫ ও ১। এই অঞ্চলের আওতায় থাকা উত্তর কোরিয়া কোনো তথ্য দেয় না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আঞ্চলিক ১০ দেশের (উত্তর কোরিয়া বাদে) মধ্যে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি মিয়ানমারে ১১.১১, তারপর ইন্দোনেশিয়ায় ৮.৭১। এর পরই তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ ৬.৩৬। এ ছাড়া শ্রীলংকায় ৩.৬৮, ভারতে ৩.১০, থাইল্যান্ডে ১.৩৩। অন্যগুলোতে মৃত্যু নেই। মৃত্যুহার বিষয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক বলেন, যারা মারা গেছে তাদের বেশির ভাগই জটিল অবস্থায় ছিল। এখন পর্যন্ত যে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে কয়েকজন মারা যাওয়ার পর নমুনা সংগ্রহ করে পজিটিভ পাওয়া গেছে। আবার কয়েকজন ঢাকায় কোনো ক্লাস্টারে থেকেও বিষয়টি গোপন করে অন্য জেলায় চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আবার ঢাকায় আসতে আসতে অবস্থা আরো খারাপ হয়ে পড়েছে। মৃতদের মধ্যে একজন আছেন যিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য হলো, ‘আমরা এখন সবাইকে উপসর্গ লুকিয়ে না রেখে পরীক্ষার কথা বলছি। তবে একই সঙ্গে এটাও বলছি—পরীক্ষার ফল বেশি নেগেটিভ হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে কোথাও একজন পজিটিভ হওয়ায় তার সংস্পর্শে ছিল বলে অনেককে সন্দেহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে; যাদের হয়তো কোনো উপসর্গও নেই।’
ড. ফ্লোরা বলেন, যাদের রেজাল্ট নেগেটিভ আসছে কিন্তু কোনো না কোনো উপসর্গ আছে, তাদের ক্ষেত্রে একটি বিষয় নজর রাখা দরকার। তারা পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে যেকোনো হাসপাতালে গেলে যথাযথ চিকিৎসা পেতে সুবিধা হবে। কারণ এখন ফ্লু এবং ডেঙ্গুর মৌসুম। ফলে করোনা নেই বলে একদম চুপ করে থাকাটাও ঠিক হবে না। আর চিকিৎসকদের এ বিষয়টি খেয়াল রাখা উচিত—যারাই জ্বর বা অন্য উপসর্গ নিয়ে যাবে সবাই যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সেটাও ভাবার কারণ নেই। সূত্র: কালের কণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।