জুমবাংলা ডেস্ক: তার নাম মারি বোনাপার্ত। কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে আগ্রহের বিষয় ছিল নারীর যৌনতা। তার দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন যেসব নারী, তাদের একজন একবার দেখতে পান মারি হস্তমৈথুন করছেন। তিনি মারিকে বলেছিলেন, ‘‘এটা পাপ কাজ, এটা অন্যায়’।
মারি ১৯৫২ সালে তার ডায়েরিতে লিখেছেন। তখন তার বয়স আট অথবা নয়। মৃত্যুভয়ে তিনি তা বন্ধ করে দেন। ছোটবেলা থেকে তার মধ্যে একটা বিদ্রোহী মনোভাব ছিল। মেয়ে বলে মাথা নিচু করে থাকতে হবে, সবকিছু মেনে নিতে হবে- এই ধারণা তিনি মেনে নেননি।
এই নিয়ে গবেষণা এবং মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। অনেকের কাছে তিনি নারীর যৌনতা বিষয়ে গবেষণায় পথিকৃৎ। জানা যায় মারি ছিলেন অনেকের কাছে শুধুই ধনী ও প্রভাবশালী মহলের ঘনিষ্ঠ এক নারী।
কিন্তু মারি বোনাপার্ত-এর (১৮৮২-১৯৬২) আসল পরিচয়- তিনি ফ্রান্সের রাজা প্রথম নেপোলিয়ানের বংশধর এবং ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী ডিউক অফ এডিনবারা-প্রিন্স ফিলিপের চাচি।
মারি নিজেও ছিলেন রাজকুমারী- প্রিন্সেস। সব কিছুর ওপরে মারি বোনাপার্ত ছিলেন একজন ‘মুক্তমনা নারী’। তার জীবনীকার লিখেছেন, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ নারী, বৈজ্ঞানিকদের বলয়ে যেমন, তেমনই বিশ্বের রাজন্য মহলে তার ছিল সমান দক্ষতায় পদচারণ। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল নারীর যৌনতা নিয়ে গবেষণায় তার ঔৎসুক্য।
মারি বোনাপার্ত জন্মেছিলেন প্যারিসে এক অভিজাত ধনী রাজপরিবারে। ফ্রান্সের রাজকুমার রোলান্ড নেপোলিয়ান বোনাপার্ত ও মারি ফেলিক্সের কন্যা ছিলেন তিনি। তার মাতামহ ছিলেন মন্টি কার্লো ক্যাসিনোর প্রতিষ্ঠাতা ও বিশাল ধনকুবের ব্যবসায়ী। মারি বোনাপার্ত তার শৈশবে ছিলেন একাকী এবং কিশোরী বয়সে হয়ে ওঠেন বিদ্রোহী। তার জীবন শুরু হয়েছিল দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মধ্যে দিয়ে। জন্মের সময় তিনি প্রায় মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন। আর তার জন্মের এক মাসের মধ্যেই মারা গিয়েছিলেন তার মা। শৈশব তার সুখের ছিল না। তিনি ছিলেন খুব একা।
বাড়িতে আর কোনো শিশু না থাকায় তার কোন খেলার সাথী ছিল না। তিনি ছিলেন বাবার ভক্ত। বাবা ছিলেন নৃতত্ত্ববিদ এবং ভুগোল বিশারদ। আর পিতামহ ছিলেন রাশভারী- তাকে বাঘের মত ভয় করতেন মারি। ছোটবেলা থেকেই তার গভীর আগ্রহ ছিল বিজ্ঞান, সাহিত্য, আর লেখায় আর সেই সঙ্গে শরীর সম্পর্কে ছিল তার দারুণ কৌতূহল।
কিশোর বয়সে তিনি ইংরেজি ও জার্মান ভাষা শিখতে শুরু করেন। তার শিক্ষা খুবই ভালো এগোচ্ছিল, কিন্তু তার বাবা ও দাদী তার আর কোনোরকম পরীক্ষায় বসা এরপর নিষিদ্ধ করে দেন। তিনি রাজকুমারী হলেও নারীর যৌনতা নিয়ে পড়াশোনা তিনি চালিয়ে গেছেন।
মারি তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘আমার নাম, আমার বংশপরিচয়, আমার ভাগ্যকে ধিক্কার জানাচ্ছি- বিশেষ করে আমি যে মেয়ে সেটাকে। কারণ আমি ছেলে হলে ওরা আমাকে আটকাতো না।’
বয়স বিশ হবার আগেই যখন তার যৌনতার শুরু হচ্ছে, তখন মারি তার বাবার এক সহকারীর প্রেমে পড়েন। তিনি ছিলেন বিবাহিত। সেই প্রেম নিয়ে কেলেঙ্কারি শেষ পর্যন্ত গড়ায় ব্ল্যাকমেইলের ঘটনায় এবং মারির জন্য তা বয়ে আনে পারিবারিক কলঙ্ক। তার বাবা মারির থেকে ১৩ বছরের বড় গ্রিস ও ডেনমার্কের রাজপুত্র প্রিন্স জর্জের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন । এথেন্সে ১৯০৭ সালে তাদের বিয়ে হয়। তাদের দুটি সন্তান হয়- এক ছেলে, এক মেয়ে।
তাদের বিয়ে ৫০ বছর স্থায়ী হলেও সেই বিয়ে সুখের হয়নি। অল্পদিনের মধ্যেই মারি বুঝতে পেরেছিলেন তার স্বামীর আসল মানসিক আবেগ ও প্রেম যে মানুষটির প্রতি, তিনি তার স্বামীর চাচা ডেনমার্কের আরেক রাজপুত্র প্রিন্স ভল্ডেমার। মারি সব কিছু ভুলতে পড়াশোনার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দেন।
তিনি নারীর কামনা ও যৌনতা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন: তিনি ১৯২৪ সালে একটি প্রবন্ধ লেখেন এ.ই. নারজানি এই ছদ্মনামে। যার বিষয় ছিল যৌনমিলনের সময় নারী কেন কঠিন ও অসাড় থাকে। কেন আনন্দ পায় না। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি দেখেছিলেন নারীর যৌনতা একটা উপেক্ষিত বিষয়, যৌনসুখ শুধু পুরুষের জন্য।
তিনি গবেষণা শুরু করেন এর কারণ: যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায় এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কিম ওয়ালেন বলছেন, মারি তার গবেষণার ফলাফলে দেখাতে চেষ্টা করেন অনেক নারীর যৌনাঙ্গের গঠন এর জন্য দায়ী। মারি তার তত্ত্ব প্রমাণের জন্য ১৯২০এর দশকে প্যারিসে ২৪০ জন নারীর যৌনাঙ্গের গঠন নিয়ে গবেষণা করেন।
অধ্যাপক ওয়ালেন বলছেন, মারি কোন পদ্ধতিগতভাবে নিজে এসব নারীর শরীরের গঠন নিয়ে কাজ করেননি। এসব নারীর চিকিৎসকের কাছে থেকে তিনি তথ্য সংগ্রহ করে তার নিজের তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন। মারি বোনাপার্ত প্রথম বলার চেষ্টা করেন প্রত্যেক নারীর শরীরের গঠন আলাদা। প্রত্যেক নারীর যোনির গঠন আলাদা। এবং যৌনসুখের বিষয়টা এর সঙ্গেই মূলত সম্পর্কিত। তবে কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন এক্ষেত্রে একজন নারীর মানসিক অনুভূতির দিকটা তিনি পুরো উপেক্ষা করে গিয়েছিলেন।
মারি বোনাপার্ত তার তত্ত্ব সঠিক বলে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি বলেছিলেন নারী যদি অস্ত্রোপচার করে তার ভগাঙ্কুরকে যোনিমুখের কাছে আনতে পারে, এই সমস্যা সে কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু তার এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।
‘বেশ কিছু নারীর জন্য এধরনের অস্ত্রোপচার বিপর্যয়ের কারণ হয়েছিল। তাদের স্নায়ু এমনভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে তারা স্নায়বিক অনুভূতি চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলেছিলেন। শুধু তাই নয়, মারি নিজেও অস্ত্রোপচার করান এবং তা সফল হয়নি। একবার নয়, তিনবার মারি একই অস্ত্রোপচার করিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন।’
ফ্রয়েডের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব: মারি হাল ছাড়েননি। তিনি নারীর যৌনতা নিয়ে তার গবেষণায় অটল ছিলেন। তিনি ১৯২৫ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে যান। প্যারিসের চিকিৎসা জগতে তখন একজন মনস্তত্ত্ববিদ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন। তার নাম সিগমান্ড ফ্রয়েড।
গবেষক নেলি টমসন, যিনি মারি বোনাপার্তের জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি বলছেন, ‘ফ্রয়েডের মধ্যে মারি একজন নতুন বাবাকে খুঁজে পেলেন, যাকে বাবার মত ভালবাসা যায়, শ্রদ্ধাভক্তি করা যায়।’ মারি বোনাপার্ত ছিলেন বুদ্ধিমতী, উৎসাহী ও ধনী। তিনি ফ্রয়েডের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক করতে ভালবাসতেন।
মারি বোনাপার্ত পরিণত বয়সে পেশাগতভাবে আরও জ্ঞান অর্জনের পর নারীর যৌনতা নিয়ে তার মতবাদ বদলান। নারীর যৌনতা নিয়ে মারি তার আদি তত্ত্ব পুরোপুরি নাকচ করে দেন। তিনি ১৯৫০ সালে নতুন একটি বই প্রকাশ করেন ‘নারীর যৌনতা’ নামে, সেখানে তার প্রথমদিককার গবেষণা পুরোটাই তিনি খারিজ করে দেন।
তিনি বলেন যৌনতার সঙ্গে নারীর শরীরের গঠন, গড়নের কোনো সম্পর্ক নেই। এর সঙ্গে নারীর মন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যখন তিনি একথা লেখেন, তখন প্রায় ২৫ বছর ধরে মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষকের পেশায় কাজ করার অভিজ্ঞতা তিনি সঞ্চয় করেছেন।
অন্দরমহলের নারী হয়ে, তিনি প্রথম জীবনে এমন একটা বিষয় নিয়ে যেসব কাজ করেছেন তা ছিল অত্যন্ত সাহসী। মারি ছিলেন একজন সত্যিকার বিপ্লবী নারী। নিজের জীবনে প্রেম, ভালবাসা, যৌনতা নিয়ে তিনি অনেক অসুখী হলেও, তিনি নিঃসন্দেহে বিংশ শতাব্দীর একজন অগ্রগণ্য নারী আন্দোলনকারী হিসেবে ইতিহাস স্বীকৃত হয়ে থাকবেন।
সূত্র: বিবিসি অবলম্বণে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।