নিউটনের সূত্রের সঙ্গে আইনস্টাইনের তত্ত্বের গড়মিল দেখা গেলে এটা নিয়ে যত কাহিনি হয় তা অনেকেই জানে না। নিউটন অবশ্য ব্যাখ্যা করতে পারেননি কীভাবে মহাকর্ষ বল এত দূর থেকে একে অপরকে আকর্ষণ করে। এবং এই ব্যর্থতার বিষয়টি তিনি তাঁর একটি লেখার ফুটনোটে উল্লেখও করে গেছেন। প্রায় দুই শ বছর পর্যন্ত ফুটনোটের কথা সবার অজানাই ছিল। আইনস্টাইনই প্রথম বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন।
আইনস্টাইন এই সিদ্ধান্তে আসেন যে মহাকর্ষ বল নিশ্চয়ই মহাশূন্যের দ্বারাই প্রযুক্ত হয়। কিন্তু কীভাবে, সেটাই প্রশ্ন। ১৯১৫ সালে তিনি এই বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গাণিতিক সূত্র উপস্থাপন করেন। তাঁর চমত্কার ব্যাখ্যাটি হলো এ রকম: মহাশূন্যে সূর্য ও পৃথিবীর মতো বস্তুগুলোর প্রভাবে তাদের চারপাশের মহাশূন্য (স্পেস) বক্রাকার (কার্ভ) ধারণ করে। মহাশূন্যের এই বাঁকানো আকৃতির কারণে তার পাশ দিয়ে অতিক্রমের সময় অন্য বস্তুর গতিপথ প্রভাবিত হয়। এভাবে মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে মহাকর্ষ বল কাজ করে।
আইনস্টাইনের এই আবিষ্কার নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ বলের সূত্রকে পূর্ণতা দান করে। আইনস্টাইন তখন বার্লিনে একজন অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছিলেন। তাঁকে প্রুশান একাডেমি অব সায়েন্সেসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এ সময় স্ত্রী মিলেভাম্যারিকের সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। দুই সন্তান নিয়ে স্ত্রী চলে যান জুরিখে।
এই দুঃসময় অবশ্য তাঁকে একটি বিরল সুযোগও এনে দেয়। তিনি দিন-রাত কাজ করে ১৯১৫ সালের ২৫ নভেম্বর বার্লিনে প্রুশান একাডেমি অব সায়েন্সে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের গাণিতিক সূত্র পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেন। এই সূত্রের মাধ্যমে মহাকর্ষ বল সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানা ও বোঝা সম্ভব হয়। গত বছরের নভেম্বরে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের শতবর্ষ পূর্ণ হয়।
মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে মহাকর্ষ বল কীভাবে কার্যকর হয়, তার একটি ব্যাখ্যা আমরা এভাবে দিতে পারি। ধরা যাক, একটি সমতল পিঠের কাঠের খণ্ডের ওপর দিয়ে একটা মার্বেল গড়িয়ে দিলাম। তাহলে মার্বেলটি সোজা পথে গড়িয়ে যাবে। এদিক-ওদিক বাঁকাবে না। কিন্তু যদি পানিতে ভিজে সেই কাঠের খণ্ডটির উপরিতল আঁকাবাঁকা হয়ে যায়, তাহলে মার্বেলটি আর সোজা গড়িয়ে যাবে না, আঁকাবাঁকা পথে চলবে।
ঠিক সে রকম, মহাশূন্যে কোনো বস্তুর প্রভাবে চারপাশের স্পেস যখন বক্রাকার ধারণ করে, তখন সেই স্পেস দিয়ে অতিক্রমের সময় অন্য বস্তুও বক্রাকার পথেই চলে। এ জন্যই সূর্যের চারদিকে পৃথিবী উপবৃত্তাকার পথে ঘুরছে। এভাবেই মহাকর্ষ বল এত দূর থেকেও পৃথিবীর গতিপথকে প্রভাবিত করছে।
মহাকর্ষ বলের এই ব্যাখ্যা আবিষ্কার করতে আইনস্টাইন প্রায় তিন বছর ধরে কাজ করেন। ১৯১২ সাল থেকেই তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হন। তিনি এর সমস্যাটির সমাধান কেমন হতে পারে বুঝতে পারেন। মহাকর্ষ বলের প্রভাবে চারপাশের শূন্যস্থান বক্রাকার ধারণ করার বিষয়টি তাঁর মাথায় আসে। এবং এ কারণেই যে মহাশূন্যে বস্তুগুলো একে অপরকে আকর্ষণসূত্রে আবদ্ধ করে, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হন।
এটা ছিল মহাকর্ষ-সম্পর্কিত চিন্তার জগতে এক বিরাট উল্লম্ফন। আইনস্টাইনের ব্যতিক্রমী চিন্তা এখানেই যে, তিনি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করলেন যেহেতু সূর্য ও পৃথবীর মধ্যে শূন্যস্থান ছাড়া আর কিছু নেই, তাহলে আকর্ষণ বল নিশ্চয়ই এই শূন্য (স্পেস) দ্বারাই কার্যকর হচ্ছে। তার মানে, মহাশূন্যে প্রতিটি বস্তু চারপাশের স্পেসকে প্রভাবিত করছে এমনভাবে যে, তা একে অপরকে আকর্ষণ করে।
উপরন্তু তিনি আরও বড় কিছু করলেন। আইনস্টাইন উপলব্ধি করলেন যে, একই কারণে সময়ও প্রভাবিত হতে পারে। সাধারণত আমরা ধরে নিই, একটি ঘড়ি যেখানেই থাকুক, তার কাঁটা সমান হারেই ঘুরবে। কিন্তু আইনস্টাইন প্রস্তাব করলেন, ঘড়ি কোনো বেশি ভরের বস্তুর যত কাছাকাছি থাকবে, তার কাঁটা তত ধীরগতিতে চলবে বা সময় ধীরগতিতে চলবে (একে বলে কাল দীর্ঘায়ন বা টাইম ডায়ালেশন)। আইনস্টাইনের সিদ্ধান্ত হলো, বিভিন্ন বস্তু সেই সব অবস্থানের দিকেই যায়, যেখানে সময় আরও ধীরগতিতে চলে।
স্থানকাল (স্পেস-টাইম) সম্পর্কিত মৌলিক আবিষ্কারের পরও আইনস্টাইনের আবিষ্কার করলেও একটি সমস্যা থেকে গেল। তাঁর মৌলিক কাঠামোগত আবিষ্কারটি যে যুগান্তকারী, সেটা দাবি করার জন্য একে গাণিতিক কাঠামোতে প্রমাণ করতে হবে। অর্থাৎ, একটি সমীকরণের সাহায্যে স্থান, কাল বা সময় ও বস্তুর (ম্যাটার) সমন্বিত অবস্থান প্রকাশ করে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের সুনিশ্চিত প্রমাণ উপস্থিত করার প্রয়োজন দেখা দিল।
জুরিখে তাঁর এক গণিতবিদ সহকর্মী মার্সেল গ্রসম্যানের সাথে কাজ করেছিলেন আইনস্টাইন। সে সময় তিনি তাঁর সমস্যার সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছে যান। বছর খানেকের মধ্যে তিনি মহাকর্ষকে জ্যামিতিক কাঠামোয় এনে স্থান-কাল বা স্পেস-টাইমের পুনঃসূত্রায়ণ করেন।
কিন্তু এরপর তাঁর আবিষ্কৃত নতুন সমীকরণগুলো পরীক্ষা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লেন। পরীক্ষা করে দেখার সময় একটি টেকনিক্যাল ত্রুটির জন্য তাঁর মনে হলো সব ভুল। তিনি ভাবলেন, গতির সাধারণ সূত্র সঠিকভাবে বর্ণনা করতে তিনি ব্যর্থ। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। বারবার তাঁর সূত্র পরীক্ষার কাজ অব্যাহত রাখলেন।
বছর দুয়েকের মধ্যে তিনি আশার আলো দেখেন। সমীকরণ পরীক্ষার সময় যে টেকনিক্যাল ত্রুটি হয়েছিল, সেটা তিনি সংশোধন করেন এবং সাধারণ আপেক্ষিকতা আবিষ্কারের সমাপনী অধ্যায়ে পৌঁছান।
কিন্তু শেষ মুহূর্তের গাণিতিক সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশের সময় ঘটনাবলি হঠাৎ যেন এক বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পড়ে যায়। সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার কয়েক মাস আগে প্রখ্যাত জার্মান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্টের সঙ্গে আইনস্টাইনের পরিচয় হয়। তাঁর সঙ্গে আইনস্টাইন তাঁর নতুন মহাকর্ষ তত্ত্ব সম্পর্কিত সব চিন্তাভাবনা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেন।
কিন্তু পরে আইনস্টাইন জানতে পারেন যে তাঁর আলোচনায় হিলবার্ট দারুণ উদ্যোগে নিজেই আইনস্টাইনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। আইনস্টাইন হতাশ হন। এরপর সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে দুজনের মধ্যে যেসব চিঠি ও পোস্টকার্ড চালাচালি হয়, তাতে বোঝা যায় তাদের মধ্যে আন্তরিকতা সত্ত্বেও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল।
হিলবার্ট ভাবছিলেন, একটি অসম্পূর্ণ মহাকর্ষ তত্ত্বকে চূড়ান্ত পর্যায়ে সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে তিনি একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা করছেন। আর আইনস্টাইন একে তাঁর একক সাফল্যের চূড়ান্ত পর্বে হিলবার্টের একটি খারাপ ধরনের কাজ বলে ধরে নিয়েছিলেন। আইনস্টাইনের এই দুর্ভাবনা একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না।
১৯১৫ সালের ১৩ নভেম্বর হিলবার্ট একটি চিঠিতে আইনস্টাইনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, তিনি আইনস্টাইনের ‘বিরাট সমস্যার সমাধান’ বের করেছেন। এ সম্পর্কে জানার জন্য হিলবার্ট আইনস্টাইনকে গোটিনজেনে আমন্ত্রণ জানান। আইনস্টাইন এতে আপত্তি তোলেন এবং গোটিনজেনে যেতে অস্বীকৃতি জানান।
এর কয়েক দিন পরই হিলবার্ট তাঁর গাণিতিক সূত্র লিখে পাঠান। আইনস্টাইন তাঁর বিরক্তি ঢেকে রেখে উত্তর দেন, ‘তোমার সমাধান, যা দেখছি, ঠিক আমার সঙ্গে মিলে গেছে, যেটা কয়েক সপ্তাহ আগে আমি বের করেছি এবং একাডেমিতে জমা দিয়েছি।’
এক সপ্তাহ পর ২৫ নভেম্বর প্রুশান একাডেমিতে হল ভরা শ্রোতাদের সামনে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের চূড়ান্ত সমীকরণ উপস্থাপন করেন।
কেউ জানে না শেষ এক সপ্তাহে কী ঘটেছে। আইনস্টাইন কি নিজেই তাঁর সমীকরণ চূড়ান্ত করেছিলেন? হিলবার্টের সমীকরণ কি ঠিক ছিল? নাকি তিনি আইনস্টাইনের কিছু তথ্য সংযোজন করেছিলেন? মজার ব্যাপার হলো, হিলবার্টের লেখার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পাতা পরে উধাও হয়ে যায়।
যা-ই হোক, পরে হিলবার্ট বলেন, সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের ক্রেডিট আইনস্টাইনেরই। এবং কার্যত সেটাই হয়েছে। আইনস্টাইনই এই তত্ত্বের জনক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।তবে হিলবার্টও তাঁর প্রাপ্য সম্মান পেয়েছেন। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণ প্রকাশের প্রায়োগিক কৌশলগত দিক দিয়ে উপযুক্তভাবে প্রকাশের ক্ষেত্রে দুজনের নামই উল্লেখিত হয়েছে। হিলবার্টের অবদান অস্বীকার করা হয়নি।
আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী দূরের কোনো তারার আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে হলে সূর্যের পাশ দিয়ে আসার সময় আলোর পথ বেঁকে যাবে। এটা ঠিক কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দিনের বেলা তো আকাশের তারা দেখা যায় না। তাহলে কীভাবে পরীক্ষা করে দেখা যাবে যে তারার আলো বাঁকা পথ ঘুরে আসে কি না?
বিজ্ঞানীরা ভেবে দেখলেন এটা পরীক্ষা করা সম্ভব সূর্য গ্রহণের সময়। তখন চারদিক অন্ধকার হয়ে যায় এবং সে সময় তারার আলোর গতিপথ পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু পরবর্তী সূর্যগ্রহণের তারিখ ছিল ২৯ মে ১৯১৯। বিজ্ঞানীরা সে পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। নির্দিষ্ট দিনে সূর্যগ্রহণের সময় বিজ্ঞানীরা ব্রাজিল, আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল প্রভৃতি স্থান থেকে পূর্ণ সূর্যগ্রহণের ছবি তোলেন। এরপর প্রায় চার মাস সেই সব ছবি পরীক্ষা করে দেখা হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।