এম আব্দুল মান্নান: নদীবেষ্টিত একটি দুর্যোগপূর্ণ জেলা শরীয়তপুর। এ জেলার চরাঞ্চল বেষ্টিত অন্যতম একটি উপজেলা নড়িয়া। পদ্মা নদীর মাঝ চরে অবস্থিত চরআত্রা এবং নওপারা এ উপজেলার দু’টি ইউনিয়ন। এ দুটি ইউনিয়নের পূর্ব দিকে চাদপুর, উত্তরে মুন্সিগঞ্জ আর দক্ষিণে নড়িয়া উপজেলা সদর। যেদিকেই যাওয়া হোক না কেন নদী পথে দুই ঘন্টা পাড়ি দিতে হবে। বন্যা আর নদী ভাঙন এ এলাকার মানুষের দুঃখের অন্যতম কারণ। তাঁদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে পদ্মার মাছ। পদ্মায় রাতভোর মাছ ধরে সে মাছ তারা পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে বিক্রি করে যা পেতো তাই দিয়েই তাঁদের সংসার চলে যেতো। আর যারা মাছ ধরতে পারেন না তারা ধান, পাট ও মরিচ চাষাবাদ করতেন। কৃষি বলতে তারা এটাকেই বুঝেন।
পদ্মার পলিবেষ্টিত এই জমিতে বাণিজ্যিকভাবে অন্যান্য ফসল বিশেষত শাকসবজি চাষাবাদ সম্ভব সে ধারনা তাঁদের ছিল না। শুধু নিজেদের খাওয়ার জন্য বসতবাড়ির আশপাশে কোন রকম একটু জায়গায় সবজি চাষ করতো। যা তাঁদের নিজস্ব চাহিদাই মেটাতে পারতো না।
নদী তীরবর্তী এই এলাকাকে কৃষি বিপ্লবের সম্ভাবনা হিসেবে ধরে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তা নিয়ে ২০১৭ সালে PACE প্রকল্পের আওতায় সাধারণ ও উচ্চমূল্যের নিরাপদ সবজি চাষে কৃষকের আয়বৃদ্ধিকরণ উপ-প্রকল্পের কাজ শুরু করে স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এসডিএস (শরীয়তপুর ডেভলপমেন্ট সোসাইটি)।
প্রকল্পের সহায়তায় চরআত্রা ও নওপারা ইউনিয়নের সাত হাজার কৃষকের মধ্য থেকে ৮০০ কৃষককে নিরাপদ সবজি চাষের ওপর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং নিরাপদ উপকরণ (হলুদ ফাঁদ, ফেরোমন ফাঁদ, জৈবসার ভার্মি-কম্পোস্ট,অনুজীবসার ও মালচিং পেপার) সরবরাহের মাধ্যমে সাধারণ ও উচ্চমূল্যের সবজির প্রদর্শনী প্লট স্থাপনসহ ভার্মি কম্পোস্ট, অনুজীব সার, সবজি নার্সারী স্থাপন করে দেয় সংস্থাটি।
চরআআত্রার সবজি চাষী সেলিম মালত বলেন, বাণিজ্যিকভাবে যে সবজি চাষ করা যায় আমরা আগে সেটা জানতাম না। আগে আমরা ধান, পাট, মরিচ এগুলো করতাম। এসডিএস এর ভাইয়েরা আসার পর বর্তমানে আমরা ধুন্দল, চিচিংগা, শসা, করলা, স্কোয়াশ, বেগুন, ফুলকপি, ব্রোকলিসহ বিভিন্ন ধরনের তরি-তরকারি চাষাবাদ করছি। সেগুলো নিজে খাওয়ার পাশাপাশি এখন বাজারে বিক্রি করতে পারছি।
অপর এক সবজি চাষী আলম সরদার জানান, একটা সময় এই এলাকায় সবজি চাষ বলতে কোন কথা ছিলো না। এসডিএস এর ভাইয়েরা এসে আমাদের বিভিন্ন সবজি চাষ করা শিখিয়েছে। তাদের পরামর্শে আমরা এখানে সবজি চাষ করছি। আগে তরি-তরকারি কিনতে হলে অনেক দূর দূরান্তে যেতে হতো। এখন হাতের নাগালে সব রকমের সবজি পাওয়া যায়। এখানকার মানুষই এখন ঐসব এলাকার নিয়ে গিয়ে সবজি বিক্রি করে। এক কথায় বলতে সবজি চাষ শুরুর পর এই এলাকার মানুষের আয়-রোজগার বেড়েছে। কৃষি কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।
প্রকল্পের এভিসিএফ সুব্রত মজুমদার জানান, পেইজ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৭ সাল থেকে আমরা সবজি চাষের নানা বিষয়ের উপর এখানকার কৃষকদের দক্ষতা উন্নয়নে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছি। এর পাশাপাশি বানিজ্যকভাবে সবজি চাষে তাঁদের উদ্ধুদ্ধ করতে সাধারন ও উচ্চ মূলের সবজি চাষ প্রদর্শনী দিয়ে যাচ্ছি। ফলে এই এলাকার বাজারে এখন সারা বছর বিভিন্ন জাতের সবজি পাওয়া যায়। যেখানে আগে তারা চাঁদপুর, দিঘিরপার,নড়িয়াসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রলার যোগে সবজি ক্রয় করে এনে স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করতো। আর এখন তারা নিজেরাই বানিজ্যিকভাবে সবজি উৎপাদন করে স্থানীয় বাজারের চাহিদা পুরন করে উল্টোসেই চাঁদপুর ও দিঘীর পাড়, নড়িয়ার আড়ৎদারের কাছে বিক্রয় করছে।
তিনি আরও বলেন, সবজি উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য কৃষকেরা রাসায়নিক সারের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব জৈব সার (ভার্মি কম্পোষ্ট, অনুজীব সার) উৎপাদন ও ব্যাবহার করছে। পোকামাকড় দমনের জন্য তারা রাসায়নিক কীটনাশক এর পরিবর্তে হলুদ বোর্ড, সেক্স ফেরোমন ফাদ, জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করছে ফলে তাঁদের উৎপাদন খরচ কমে আয় বাড়ছে। আমরা এই চর এলাকার জন্য বেড করে সবজি চাষ, মালচিং পেপারের ব্যাবহার, বোর্দ মিক্সচার,লাইন করে সবজি লাগানোর কৌশল দেখিয়ে দিয়েছি। তারা সাধারণ সব্জির পাশাপাশি বিদেশি স্কোয়াস, ব্রোকলি, লেটুস,ক্যাপসিকাম, বীটরুট ইত্যাদিও এখন চাষাবাদ করছে। যা এই প্রকল্পের একটি বড় সফলতা।
চরআত্রা ইউপি মেম্বার মনির মুন্সি জানান, আমাদের এখানে আগেও সবজি চাষ হতো তবে সেটা বাড়িতে করতো। এসডিএস আসার পর এখন সবাই জমিতে বড় করে সবজি চাষ করছে। এসডিএস অনেক কাজ করছে।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ইমাম হাসান রনি বলেন, আমি এই এলাকার ৮/৯ মাস ধরে আছি। দেখছি এসডিএস’র ভাইয়েরা কৃষকদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করছেন। আমরাও কৃষি অফিস থেকে কৃষকদের বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনী, বীজ ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা করছি।
তিনি আরও বলেন, এখনকার বেশিরভাগ লোকই এখন সবজি চাষ করেন। তাদের জীবনযাত্রার মান আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। আগে তাঁদের শুধু পদ্মার মাছের উপর নির্ভরশীল থাকতে হতো এখন সবজি সহ বিভিন্ন ফসল করছেন ফলে একক মাছের উপর তাঁদের নির্ভরশীলতা কমেছে এবং আয়-রোজগার বেড়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।