জুমবাংলা ডেস্ক : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হাসিনা সরকার পতনের দিন বিকেলেও পুলিশ গুলি চালায়। আর এসব গুলিতে অনেকে নিহত হয়, এদের কারো কারো মরদেহের হদিস মেলেনি এখনো। এর মধ্যে গাজীপুরের কোনাবাড়ী থানা এলাকায় পুলিশের গুলিতে ওই দিন নিহত হন মো. হৃদয় (২০) নামের এক কিশোর। ঘটনার দিনের একটি ভিডিও অতিসম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
কিন্তু সেই হত্যা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে স্থানীয় পাঁচ সাংবাদিককেও আসামি করা হয়েছে। এভাবে সরকার পতনের পর থেকে রাজনীতি ও ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সাংবাদিকদের নামে হত্যা, গুলি ও ভাঙচুরের অভিযোগে মোট ১৪টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় ৩৭ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে।
জানা যায়, এসব হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকা, বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ও সম্পাদকদের বিরুদ্ধেও। এ নিয়ে কালের কণ্ঠের করা প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত তুলে ধরা হলে-
কোনো কোনো সাংবাদিককে একাধিক হত্যা মামলায় জড়িয়ে একাধিকবার রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। আর ঢালাওভাবে এভাবে সাংবাদিকদের নামে মামলা দেওয়াটা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) ও কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
কোনাবাড়ীতে ঘটনার দিনের প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ছেলেটিকে গুলি করার পর বস্তায় ভরে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
ওই দিন তাঁর মতো আরো কয়েকজনের মরদেহ গুম করেছে থানা পুলিশ। তাঁদের মধ্যে মো. হূদয়ের হদিস না মেলায় পাঁচ স্থানীয় সাংবাদিককেও হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে।
কোনাবাড়ীর ঘটনায় যে পাঁচ সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে, তাঁরা হলেন, দৈনিক সমকালের কালিয়াকৈর প্রতিনিধি এম তুষারী, বাংলা টিভির গাজীপুর প্রতিনিধি মো. শহিদুল ইসলাম, দৈনিক ভোরের ডাকের গাজীপুর প্রতিনিধি এম মোমিন রানা, দৈনিক সময়ের দেশ পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি মো. কবির হোসেন ও দৈনিক সকালের সময় পত্রিকার কোনাবাড়ী থানা প্রতিনিধি মো. মোখলেসুর রহমান।
মামলা প্রসঙ্গে সমকালের কালিয়াকৈর প্রতিনিধি এম তুষারী বলেন, তিনি কালিয়াকৈর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কোনাবাড়ী এলাকায় যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
আগে প্রকাশিত কোনো সংবাদের জের ধরে কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাঁর নামসহ অন্য সংবাদকর্মীদের নাম জড়িয়ে দিয়েছে। মোমিন রানা বলেন, তিনিসহ পাঁচ সাংবাদিকের কেউ রাজনীতি করেন না। ঘটনার দিন সেখানে ছিলেনও না। শত্রুতাবশত কেউ মামলায় তাঁদের নাম জাড়িয়ে থাকতে পারে। মামলার বাদী মো. ইব্রাহীম সাংবাদিকদের বলেন, তিনি সাংবাদিকদের কাউকে চেনেন না। যে দোকান থেকে মামলার এজাহার টাইপ করা হয়েছে সেখান থেকে তাঁদের নাম দেওয়া হতে পারে। এজাহারে প্রথমে পুলিশের নাম ছিল। পরে পুলিশের নাম বাদ দিতে পরামর্শ দেওয়া হয় থানা থেকে। পরে পুলিশের নাম বাদ দিয়ে এজাহার দেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে ভারপ্রাপ্ত কমিশনার মো. জিয়াউল হক বলেন, সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে। এ ছাড়া তদন্ত ছাড়া কাউকে অযথা হয়রানি করা হবে না।
গাজীপুর প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শাহ রিপন বলেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাংবাদিকদের নাম মামলায় জড়ানো হয়েছে। এটি বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী। দ্রুত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যথায় আন্দোলনসহ বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিনা অপরাধে যেন কেউ নির্যাতনের শিকার না হয় সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। তবে সাংবাদিকরাও সমালোচনা বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নন। তাঁদেরও কোনো মতাদর্শ থাকতে পারে। কিন্তু সেটা ফলাতে গিয়ে যদি তাঁদের লেখালেখি বা বক্তব্যে কেউ আহত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হন, সেটার আইনি ব্যবস্থা আছে। তাই বলে যত্রতত্র মামলা টুকে দেওয়া ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এতে মামলা ও বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি হবে।
জয়পুরহাটে পাঁচ মামলায় সাত সাংবাদিকও আসামি : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জয়পুরহাটে নিহত ও আহতদের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত দায়ের হওয়া পাঁচ মামলায় সাতজন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। গত রবিবারও তিনজন সাংবাদিকসহ আওয়ামী লীগের ৯২ নেতাকর্মীর নামে মামলা করা হয়েছে। এসব মামলার আসামিরা হলেন কালের কণ্ঠ’র জেলা প্রতিনিধি আলমগীর চৌধুরী, এটিএন বাংলার রফিকুল ইসলাম, চ্যানেল ২৪-এর স্টাফ রিপোর্টার হারুনর রশিদ, নাগরিক টেলিভিশনের মাহফুজার রহমান, কালের কণ্ঠ’র পাঁচবিবি উপজেলা প্রতিনিধি সুমন চৌধুরী এবং ক্ষেতলালের স্থানীয় সংবাদকর্মী আব্দুর রাজ্জাক এবং মিলন হোসেন। এর মধ্যে হত্যা ও গুলিতে আহতের চারটি মামলায় কালের কণ্ঠ’র জেলা প্রতিনিধি আলমগীর চৌধুরীকে আসামি করা হয়েছে। আরো মামলা করারও হুমকি দেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জেলার সংবাদকর্মীরা। তাঁদের অভিযোগ, সত্যকে আড়াল করার জন্যই একটি কুচক্রী মহল সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তাঁরা অবিলম্বে সাংবাদিকদের হয়রানি বন্ধে তথ্য ও আইন উপদেষ্টার সহযোগিতা কামনা করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি সাংবাদিকদের নামে ১৪টি মামলার মধ্যে তিনটি হত্যা মামলা হয়েছে ঢাকায়। বগুড়া ও গাজীপুরে একটি করে, জয়পুরহাটে দুটি হত্যা ও তিনটি গুলি করার অভিযোগে মামলা, সিলেটে একটি বিস্ফোরক মামলা, রংপুরে দুটি মামলার মধ্যে একটি হত্যা ও অপরটি ভাঙচুরের মামলা হয়েছে। এ ছাড়া রাজশাহীতে চাঁদাবাজি ও সাইবার আইনে একটি মামলা করা হয়েছে।
২৯ আগস্ট আইনজীবী এম এইচ গাজী তামিম জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনের সময় গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনা ও ৩২ জন সিনিয়র সাংবাদিকসহ ৫২ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ করেছেন। একই দিন আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগে ৩০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ করেন আব্দুর রাজ্জাক নামের আরেক ব্যক্তি। তিনি আন্দোলনে নিহত রিয়ানের বাবা।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, কেউ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকলে কিংবা হুকুম দিলে অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হবে। তবে যারা ঘটনার ধারে কাছেও নেই, তাদের নামে হত্যা মামলা হলে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করবে।
মাওলানা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক উমর ফারুক বলেন, ‘সাংবাদিকসহ অন্যদের বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো হচ্ছে, সেগুলোর প্রকৃত মেরিট কম। এসব মামলা ফাইনাল জাজমেন্টে টিকবে না। তাই সুস্পষ্টভাবে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে মামলা করতে হবে।’
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘যদি কোনো সাংবাদিক অন্যায় কাজ করে থাকেন, অবশ্যই তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কিন্তু কাউকে হেয়প্রতিপন্ন কিংবা হয়রানি করতে যত্রতত্র মামলায় আসামি করা মোটেও উচিত না। এতে করে সুবিচার করার প্রক্রিয়াকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।’ আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরে অনেক সাংবাদিকের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। যার বেশির ভাগই দিয়েছে তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে লেখালেখি বন্ধ করতে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম এক-দুটি ছাড়া অন্য মামলা প্রমাণ করতে পারেনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।