ড. আলা উদ্দিন : গত ১১ অক্টোবর ২০২৪, নরওয়ের নোবেল কমিটি জাপানি সংগঠন নিহন হিদানকিয়োকে এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এই পুরস্কারটি পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব অর্জনের প্রচেষ্টা এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার না করার পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য দেওয়া হয়েছে সংগঠনটিকে। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত জাপানি সংগঠনটি হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ১৯৪৫ সালে ঘটে যাওয়া পরমাণু বোমা হামলার শিকারদের নিয়ে গঠিত হয়।
সংগঠনটির উদ্দেশ্য হলো পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্বকে সচেতন এবং পরমাণু যুদ্ধ প্রতিরোধে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করা। তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম এবং জনসাধারণের মাঝে আলোচনা ও প্রচারণার মাধ্যমে পরমাণু অস্ত্র নির্মূলের পক্ষে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। নিহন হিদানকিয়ো বিশ্বাস করে যে, মানবতার ভবিষ্যৎ পরমাণু অস্ত্রমুক্ত একটি বিশ্বে নিহিত এবং তারা এই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
ইতিহাসের শিক্ষা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট পারমাণবিক বোমা হামলা করেছিল। বোমার বিস্ফোরণে হিরোশিমা শহরের সাড়ে তিন লাখ মানুষের মধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যান। নাগাসাকিতে মারা যান ৭৪ হাজার মানুষ। তবে পরমাণু বোমার তেজস্ক্রিয়তার শিকার হয়ে পরবর্তী সপ্তাহ, মাস এবং বছরগুলোতে আরও বহু মানুষ মারা গিয়েছিলেন। যারা এই বোমার শিকার হয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা ‘হিবাকুশা’ (সার্ভাইবার) বলে পরিচিত।
তাদের ভয়ংকর শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে বাকি জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। এই ভয়াবহ ঘটনা কেবল মানব জীবনের প্রতি একটি নৃশংসতম আঘাত ছিল না, বরং এটি বিশ্ব ইতিহাসের একটি মর্মান্তিক অধ্যায়। বিস্ফোরণের ফলে তৈরি হওয়া ধ্বংসযজ্ঞ, মানুষের জীবনের চরম মূল্য এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা আজও বিশ্ববাসীর মনে দাগ কাটে।
এই ভয়াবহতার স্মৃতি নিয়ে ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নিহন হিদানকিয়ো সংগঠনটি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এই হামলার ফলে আক্রান্তদের অভিজ্ঞতা এবং সচেতনতা তৈরি করা। যাতে ভবিষ্যতে কখনোই এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। সংগঠনটি বোমা হামলায় বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের (হিবাকুশা) কাহিনী সংগ্রহ এবং সেগুলোকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে। তারা বিশ্ববাসীর কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে চায় যে, যুদ্ধের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হতে পারে এবং শান্তির পথে এগিয়ে যাওয়াই একমাত্র সমাধান। ইতিহাসের এই শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানবতা বাঁচাতে এবং পৃথিবীকে নিরাপদ রাখতে সচেতনতা ও সংহতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নোবেল পুরস্কারের অর্থ
নিহন হিদানকিয়োকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার মধ্যে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। এটি বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, পরমাণু অস্ত্র একটি অভিশাপ, যা মানবজাতির অস্তিত্বকে ফেলে হুমকির মুখে। এই পুরস্কার শুধু একটি সংবর্ধনা নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী উদ্বুদ্ধকরণ যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পরমাণু যুদ্ধের ফলে সৃষ্টি হওয়া ধ্বংসের চিত্র আমাদের মনে চিরকাল গেঁথে থাকবে। নিহন হিদানকিয়োর কাজের মাধ্যমে আমরা আশা করতে চাই, বিশ্ববাসী একসঙ্গে কাজ করবে পরমাণু অস্ত্র নির্মূল করার জন্য।
শান্তির জন্য এই সংগ্রামের মাধ্যমে তারা আমাদের দেখিয়েছে কিভাবে দুঃখ এবং যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা মানবতাকে একত্রিত করতে পারে। তাদের প্রচেষ্টা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের উচিত ভবিষ্যতের জন্য একটি নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলা। এটি কেবল জাপানের মানুষের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবতার জন্য একটি শিক্ষা। পারমাণবিক অস্ত্র নির্মূল এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। এই নোবেল পুরস্কার আমাদের আহ্বান করে, যেন আমরা সংঘাত ও হিংসার পরিবর্তে আলোচনা এবং সমঝোতার পথ অনুসরণ করি।
হিরোশিমায় একদিন
গত ৩ মে ২০২৩ একটি গবেষণার সূত্র ধরে আমাদের দুই মেয়েকে (নোরা ও জারা) নিয়ে জাপানের হিরোশিমায় গিয়েছিলাম। যেখানে অবস্থিত হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল (জেনবাকু ডোম), যা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। সেখানে আমরা বোমা বিস্ফোরণের হাইপোসেন্টার বা কেন্দ্রবিন্দুর কাছে অবস্থিত ধ্বংসাবশেষ ও নানা স্মৃতিচিহ্ন দেখেছি। আমরা পরমাণু বোমার স্মৃতিচিহ্ন, টিকে থাকা ক্ষত-বিক্ষত ভবন, মিউজিয়ামসহ অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন দেখতে পেয়েছি। হিরোশিমার ক্ষত-বিক্ষত স্থানগুলোতে দাঁড়িয়ে থাকা বেদনার ইতিহাস আমাদের মনকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। সেখানে জ্বলন্ত মশাল ও সাদাকো সাসাকির স্মৃতিমূর্তি আমাদের মনে এক নতুন উপলব্ধি নিয়ে এসেছে, যা মনে করিয়ে দেয় মানবতার প্রতি পরমাণু অস্ত্রের নিষ্ঠুরতার কথা।
আমার ছোট মেয়ে (৬ বছর বয়সী) এই বোমা হামলার কথা জেনে ভীষণভাবে ব্যথিত হয়েছিল। সে প্রশ্ন করেছিল, ‘আমেরিকা কেন এই কাজটি করল? তারা কি খারাপ?’ তার মনে দারুণ সংশয় ছিল এবং এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে এক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসেছে। ও অনেক দিন ধরে হিরোশিমার ছবিগুলো দেখছিল এবং একের পর এক প্রশ্ন করছিল। এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে তার বিশাল কৌতূহল এবং মানবিক বোধ ফুটে উঠেছিল। নোরা-জারা অনুভব করেছে যে, যুদ্ধের পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে এবং এই ধরনের ভয়াবহতা মানবজাতির জন্য কতটা বিপজ্জনক।
পিস মেমোরিয়াল পার্কে শিশুদের একটি শান্তি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে, যা পারমাণবিক বোমার হামলায় নিহত শিশুদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত। বিশেষভাবে, এটি সাদাকো সাসাকি এবং হাজার হাজার শিশুর স্মরণে নির্মিত হয়েছে, যারা ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় বোমা বিস্ফোরণের শিকার হয়েছিল। সেখানে নির্মিত মূর্তিটি ১৯৫৮ সালের ৫ মে উন্মোচিত হয়। মূর্তির ওপরে সাদাকোকে একটি তারের কাগজের ক্রেন মাথার ওপরে ধরে থাকা অবস্থায় দেখানো হয়েছে। সাদাকোর ইচ্ছা ছিল, এক হাজার কাগজের ক্রেন বানানোর মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন একটি শান্তিময় পৃথিবীর স্বপ্ন পূরণ হবে।
বিশ্বজুড়ে শিশু এবং দর্শনার্থীরা এই স্মৃতিস্তম্ভে হাজার হাজার কাগজের ক্রেন উৎসর্গ করে, যা একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বের আকাক্সক্ষার প্রতীক। সাদাকো তার মৃত্যুর আগে এই ইচ্ছার জন্য কাগজের ক্রেন বানাতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার ইচ্ছা পূর্ণ হওয়ার আগেই, ১৯৫৫ সালের ২৫ অক্টোবর, ১২ বছর বয়সে সাদাকো লিউকেমিয়ায় মারা যান। এখনো প্রতিদিন হাজার হাজার বিশ্ববাসী হিরোশিমায় গিয়ে এই ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতিস্মারক মেমোরিয়াল পার্ক পরিদর্শন করে। আর হিরোশিমার বিখ্যাত ওকোনোমিয়াকি উপভোগ করে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্মারক হলো, শান্তির মশাল। এটি নির্মাণ করা হয়েছে সেই হাজার হাজার মানুষের আত্মাকে সান্ত¡না দেওয়ার জন্য, যারা পানি চাইতে চাইতে মারা গিয়েছিল। একই সঙ্গে এটি পারমাণবিক অস্ত্রের বিলুপ্তি ও স্থায়ী বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার আশার প্রতীক হিসেবে নির্মিত। ১৯৬৪ সালের ১ আগস্ট মশালটির প্রজ্বলন শুরু হয় এবং তখন থেকে এটি অনবরত জ্বলছে পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। এটি পৃথিবী থেকে শেষ পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত জ্বলতেই থাকবে।
নোবেল পুরস্কারের তাৎপর্য
নিহন হিদানকিয়োর নোবেল শান্তি পুরস্কারটি শুধু একটি সম্মান নয়, এটি একটি শক্তিশালী বার্তা। এটিকে কেবল পুরস্কার হিসেবে না দেখে এর বার্তাকে সমাজে ও বিশ্বে প্রতিফলিত করে প্রধানত এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বিশ্বে শান্তির জন্য আমাদের সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শান্তির জন্য এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, বিশেষ করে একটি সংগঠনের মাধ্যমে, আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে পরিবর্তন করে।
আমাদের ভেবে দেখতে বাধ্য করে যে, মানবতার কল্যাণে আমাদের একত্রিত প্রচেষ্টা কতটা জরুরি। আমাদের উচিত এই পুরস্কারকে একটি উদ্বুদ্ধকরণরূপে গ্রহণ করা, যাতে মানবতা সব সময় একটি নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ এবং পরমাণু অস্ত্রমুক্ত পৃথিবীর দিকে এগিয়ে চলে। এটি শুধু যুদ্ধ ও সংঘর্ষের অবসান নয়, বরং এটি সকলের জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ গড়ে তোলার আহ্বান। আজকের দিনে, যখন অনেক দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সামাজিক অস্থিরতা বিরাজমান, তখন এই পুরস্কার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়, যা মানবতার প্রতি সহানুভূতি, সাম্য এবং সম্মান বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার, ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে, আমাদের একটি সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্যোগ নিতে উদ্বুদ্ধ করে, যাতে আমরা একটি আরও নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তুলতে পারি। এই পুরস্কার জাতিগত বা আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে আবদ্ধ নয়; এটি একটি বৈশ্বিক আহ্বান, যা সকল মানুষের মনে শান্তির বীজ বপন করবে।
নিহন হিদানকিয়োর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিশ্বে শান্তির একটি শক্তিশালী বার্তা নিয়ে এসেছে। এই পুরস্কারটি কেবল একটি সংগঠনের সাফল্য নয়, বরং এটি মানবতার প্রতি একটি বৃহত্তর আহ্বান। এটি আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, মানবতার জন্য একত্রিত হওয়া এবং সহমর্মিতা প্রদর্শন করা জরুরি। এই সংগঠনের লড়াই পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে, যা মানবজাতির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পৃথিবীকে একটি শান্তিপূর্ণ স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমরা একটি নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, যেখানে শান্তি, প্রেম এবং মানবতার মূল্য অপরিহার্য।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, যাতে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ এবং শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব হয়। একসঙ্গে আমরা একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে পারি, যেখানে সকল মানুষের অধিকারের সুরক্ষা করা হয় এবং সংঘর্ষের পরিবর্তে সমঝোতা ও সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠিত হবে। নিহন হিদানকিয়োর নোবেল পুরস্কারে আনন্দের পাশাপাশি শান্তি প্রচেষ্টায় সচেষ্ট থাকাই হবে এই বিশ্বস্বীকৃত মর্যাদার প্রতি শ্রেষ্ঠ সম্মান প্রদর্শন।
লেখক : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।