আন্তর্জাতিক ডেস্ক : যে কারো আলমারিতে একটি পোশাক পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়, আর তা হলো এক জোড়া জিন্স- আর সেগুলো নীল রঙের হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি।
কিন্তু ১৮৭৩ সালে জ্যাকব ডেভিস এবং লেভি স্ট্রস যে ট্রাউজার তৈরি করেছিলেন তা তারা উদ্ভিদ থেকে তৈরি করা বেগুনী নীল রঙে রাঙিয়েছিলেন। ১৮৮২ সাল নাগাদ বেগুনী নীল রঙ রাসায়নিক দিয়ে তৈরি করা শুরু হয়, আর এখন যে ডেনিম ব্লু বা নীল রঙ রয়েছে তাতে ব্যবহার করা হয় বেশ ভাল পরিমাণ পেট্রোলিয়াম দিয়ে। সাথে থাকে বিষাক্ত অনেক উপাদান যেমন ফরমালডিহাইড এবং সায়ানাইড।
এরমধ্যে নীল রঙ যেহেতু পানিতে দ্রবণীয় নয় তাই আরো বেশি পরিমাণ রাসায়নিক যুক্ত করা হয় যা শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিকর এবং জলজ প্রাণীদের জন্য প্রাণঘাতী, সেই রাসায়নিক রঙকে তরলে পরিণত করতে ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু সান ফ্রান্সিসকোর জৈবপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান টিঙ্কটোরিয়াম মনে করে যে এর প্রতিকার রয়েছে: জৈব প্রকৌশলের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়াকে জাপানের নীল উৎপাদনকারী উদ্ভিদ পলিগোনাম টিঙ্কটোরিয়ামের মতো ব্যবহার করা যেতে পারে, যা নীল রঙ তৈরি ও এটিকে দীর্ঘস্থায়ী করে।
“যেহেতু ব্যাকটেরিয়া শক্তিশালী বিভাজক, তাই এগুলোকে যদি সঠিক অবস্থায় রাখা যায় তাহলে এগুলোর সহায়তায় আমরা বেশি পরিমাণে রঙ তৈরি করতে পারি এবং এগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় যা পেট্রোলিয়ামের উপর নির্ভরশীল নয়,” বলেন টিঙ্কটোরিয়ামের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী মিশেল ঝু।
শুরুর দিকে লেভি’স উদ্ভিদ থেকে উৎপাদিত রঙ ব্যবহার করতো
প্রতিষ্ঠানটি এরইমধ্যে সুতা উৎপাদন শুরু করেছে এবং আগামী দুই বছরে তারা এমন প্রক্রিয়ায় জিন্স তৈরি করার পরিকল্পনা করছে যা মিস ঝু এর মতে ব্যয় এবং দামে প্রচলিত পদ্ধতির সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারবে।
জৈবপ্রকৌশলের মাধ্যমে ক্ষতিকর রাসায়নিককে প্রতিস্থাপনের চেষ্টাকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয় টিঙ্কটোরিয়াম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ফ্রান্সের পিলি’র কথা, যারা বলছে যে, প্রতি টন পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে তাদের অণুজীব গাঁজন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে ১০০ টন পেট্রোলিয়াম এবং ১০ টন বিষাক্ত রাসায়নিক বাঁচানো সম্ভব।
“কাঁচামাল হিসেবে পেট্রোলিয়াম ব্যবহার না করে, এই প্রক্রিয়ায় ক্ষতিকর রাসায়নিকের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য কার্বন যেমন কৃষিকাজের বর্জ্য ব্যবহার করা হয় যা তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় মাইক্রো-অর্গানিজম বা অণুজীব,” বলেন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ম্যারি-সারাহ অ্যাডেনিস।
“এই প্রক্রিয়ায় ৫ গুণ কম পানি এবং ১০ গুণ কম জ্বালানি দরকার হয় কারণ অণুজীব ঘরের তাপমাত্রাতেই কাজ করে।”
যেখানে পিলি ২০২১ সালের আগে বাণিজ্যিক উৎপাদনের সম্ভব নয় বলে জানাচ্ছে, সেখানে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক কালারিফিক্স এরইমধ্যে বস্ত্র উৎপাদনকারী যেমন সুইজারল্যান্ডের ফর্সটার রোহনার এবং ভারতের আরভিন্দের সাথে সাথে ফ্যাশন জায়ান্ট এইচএন্ডএম’র সাথেও কাজ করছে।
ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে রঙ তৈরি করতে অনেক বেশি পানি এবং রাসায়নিক দরকার হয়।
২০১৬ সালে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন জেমস আজিওকা, ওর ইয়ারকোনি এবং ডেভিড নুজেন্ট। খাবার পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি সনাক্ত করতে একটি বায়োসেন্সর তৈরির জন্য ওয়েলকাম ট্রাস্টের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে নেপাল সফরের পর তারা এটি তৈরি করে।
“যখন আমরা সেখানে গেলাম এবং শহর ঘুরে দেখছিলাম তখন দেখি যে, সেখানকার নদী এবং জলজ পরিবেশ বিষাক্ত। কাঠমান্ডুর প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে, বস্ত্র শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলছে, আর এগুলোর বেশিরভাগই আসে বস্ত্রের রঙ থেকে,” বলেন মিস্টার আজিওকা।
এর আগের একটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে, মিস্টার আজিওকা এরইমধ্যে রঙ তৈরি করতে জৈবপ্রকৌশল ব্যবহার করেছেন, আর এ সম্পর্কিত আরো গবেষণার পর জন্ম হয় কালারিফিক্স’র।
টিঙ্কটোরিয়াম যেখানে রঙ তৈরির অণুজীবে উদ্ভিদের জিন ব্যবহার করেছিল সেখানে কালারিফিক্সে এ বিষয়ে আরো একধাপ এগিয়ে ছিল।
“আমরা যেটা করতে পারি তা হচ্ছে টিয়াপাখির একটি পালক নিয়ে, এটি থেকে কিছু কোষ নিয়ে সেগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখতে পারি “মেক রেড” বা লাল রঙ তৈরির বিষয়ে জানতে,” মিস্টার ইয়ারকোনি বলেন।
“যদিও সব ধরণের প্রাণীর ডিএনএ আছে, তবে প্রতিটি জীবের ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তাই আমরা এগুলোর এসব বৈশিষ্ট্য অণুজীবে দিয়ে দেই যাতে টিয়াপাখি যেভাবে চিনি আর নাইট্রোজেন ব্যবহার করে রঞ্জক তৈরি করে এটিও ঠিক সেভাবেই রঞ্জক তৈরি করতে পারে,”তিনি বলেন।
কালারিফিক্স প্রাণীদের ডিএনএ পরীক্ষা করে বোঝার চেষ্টা করে যে তারা কীভাবে রঙ তৈরি করে
“আমরা এটি গাঁজন প্রক্রিয়ায় করে থাকি- যে প্রক্রিয়া ব্যবহার করে অ্যালকোহল তৈরি করা হয়। কিন্তু অ্যালকোহল তৈরির পরিবর্তে আমরা রঞ্জক তৈরি করি।”
গাঁজনের একটি সুবিধা হলো এর মূল উপাদানটি হচ্ছে চিনি: যা সহজলভ্য এবং উৎপাদন বা পরিশোধনের জন্য তেমন কোন অবকাঠামোর দরকার হয়না। এবং মিস্টার আজিওকা বলেন, “আমরা জানি যে গাঁজন প্রক্রিয়ায় উৎপাদন প্রক্রিয়া অনেক সস্তা হয়ে থাকে। তা না হলে বিয়ার এতো বেশি সহজলভ্য হতো না।”
এই প্রক্রিয়ার আরো বড় সুবিধা হলো, রঙ তৈরির অন্য প্রযুক্তির তুলনায় এই প্রক্রিয়া বিভিন্ন ধরণের দ্রব্যে কাজ করে থাকে।
“উদাহরণস্বরূপ, পলিয়েস্টার এবং সুতি বস্ত্রে আলাদা ধরণের রঙ এবং আলাদা ধরণের যন্ত্র দরকার হয়। বেশিরভাগ পোশাক এখন পলিকটন এবং আপনি যদি এটি আগে থেকে রঙ করা সুতা দিয়ে না তৈরি করে থাকেন, তাহলে এটি বার বার রঙ করার দরকার হয়, তার মানে হচ্ছে আপনাকে এটি দুইবার করে রঙ করতে হবে,” বলেন ড. ওর।
“আমরা পলিকটন রঙ করতে পারি, তার মানে হচ্ছে অর্ধেক পানিতেই কাজ শেষ হয় এবং রাসায়নিক এবং কার্বন নিঃসরণের পরিমাণও অর্ধেক কমে যায়।”
নীল রঙের মরফো প্রজাপতির মতো প্রাণীদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন গবেষকরা।
ব্যাকটেরিয়া দিয়ে চুলের রঙও তৈরি করা যায়, যদিও এই প্রক্রিয়াটি এখনো প্রাথমিক অবস্থাতেই রয়েছে। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের শিক্ষার্থীরা ইন্টারন্যাশনাল জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড মেশিন প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছেন ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে প্রোটিনে পরিণত করে সেটিকে চুলের রঙ করা, ক্ষতি সারিয়ে তোলা এবং সোজা করতে ব্যবহার করা হয়।
এদিকে, ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ এবং ডাচ বায়োটেকনোলজি কোম্পানি হোয়েকমাইন ব্যাকটেরিয়া ব্যাকটেরিয়ার রূপান্তর ব্যবহার করে কাঠামোগত রঙ অর্থাৎ যে রঙ রঞ্জকের মতো না হয়ে কোন তলের জ্যামিতিক আকারে উৎপাদিত হয়- তা তৈরি করা হচ্ছে।
এই কৌশলটি ময়ূর এবং নীল মরফো প্রজাপতি ব্যবহার করে রঙ তৈরি করে থাকে।
গবেষকরা ব্যাকটেরিয়ার আকার পরিবর্তন করে দেয় কিংবা তাদের নড়াচড়ার সক্ষমতা পরিবর্তন করেন যাতে তাদের প্রতিফলিত আলোক রশ্মির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আলাদা হয় এবং সেই সাথে তাদের উৎপাদিত রঙও।
কেমব্রিজের রসায়ন বিভাগের সিলভিয়া ভিগনোলিনি বলেন, এই কৌশল ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় পরিমাণে এবং দরকার অনুযায়ী ভিন্ন রঙের রঙ উৎপাদন করা যাবে।
“ভবিষ্যতে এ ধরণের রঙ আমাদের গাড়ি এবং ঘরের দেয়ালেও দেখা যেতে পারে,” বলেন ড. ভিগনোলিনি, “শুধু মাত্র আমাদের চাহিদা মতো রঙ আর আদলে রঙ উৎপাদন করলেই হবে।” সূত্র : বিবিসি বাংলা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।