তাকী জোবায়ের: ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ৯টি ব্যাংক। সেপ্টেম্বর শেষে ২৮ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
তিন মাস আগে অর্থাৎ জুন শেষে ব্যাংক খাতের মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ১৩৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ২ হাজার ৭১৯ কোটি টাকার ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্পোরেট সুশাসন এবং ব্যাংকিং ব্যবসার ভিত্তি মজবুত না হওয়ার কারণে এই সংকটের উৎপত্তি বলে অভিমত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে সাধারণ ক্যাটাগরির ঋণের বিপরীতে পরিচালন মুনাফার শূন্য দশমিক ৫ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন হিসেবে রাখতে হয়ে। এছাড়া, খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি অশনি সংকেত, কারণ এটি ব্যাংকগুলোর দুর্বল আর্থিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরে। যা মূলতঃ উচ্চ খেলাপি ঋণের ফল।
তথ্য মতে, সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে রয়েছে বেসরকারি খাতির ন্যাশনাল ব্যাংক। বিভিন্ন দুর্নীতি এবং অনিয়মের কারণে বেশ আলোচিত এই ব্যাংকটি। তাই অন্যদের তুলনায় আমানত সংগ্রহ এবং ঋণ আদায় বেশ পিছিয়ে তারা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৫১৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। খেলাপিসহ অন্যান্য ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির প্রভিশনের প্রয়োজন ছিল ১৫ হাজার ৬৮১ কোটি ৮১ লাখ। কিন্তু ব্যাংকটি এক হাজার ৮৮৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। তাই ১৩ হাজার ৭৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঘাটতিতে পড়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক।
ঘাটতির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। কারণ সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি চার হাজার ৬০০ কোটিতে পৌঁছেছে। তথ্য মতে ১৬ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা খিলাপি হয়ে গেছে ব্যাংকটির ঋণ। যা ব্যাংকের মোট বিতরণের ২৪ শতাংশেরও বেশি।
প্রভিশন ঘাটতিতে এরপরেই রয়েছে বেসিক ব্যাংক। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল চার হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল চার হাজার ১৯৮ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫৪২ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৩৯৯ কোটি, এনসিসি ব্যাংকের ৩৩৫ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২৩৪ কোটি এবং মধুমতি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৯০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দেয় আইএমএফ তা গ্রহণ করে না। তার মানে এই হিসাবের চেয়ে খেলাপি ঋণের মাত্রা অনেক বেশি। এখানে পুনঃতফসিল করা ঋণের হিসাব নেই। আদালতে অনেক খেলাপি ঋণ স্থগিত করা আছে তার হিসাবও আসে না। এগুলো যোগ করলে খেলাপি ঋণের অঙ্ক অনেক বেশি হবে। তাছাড়া অন্যায় ও দুর্নীতি এখন ব্যাংক খাতকে ঘির ধরেছে। তারই প্রমাণ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি। নিয়ম বহির্ভূতভাবে ঋণ দেওয়ার কারণে এখন ব্যাংকগুলো আর ঋণের বিপরিতে প্রভিশন রাখতে পারছে না।’
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ সামান্য কমেছে। তবে বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত সেপ্টেম্বর-২০২৩ প্রান্তিকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
জানা গেছে, রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ জুনে ছিল ৭৪ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা, যা কমে হয়েছে ৬৫ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৭৩ হাজার ৬৩৫ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৮১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৭৫৩ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ১৯৭ কোটি থেকে বেড়ে ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকায় উঠেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।